প্রসেনজিৎ দত্ত: বৃহস্পতিবার সকালটাই শুরুই হল হৃদয়বিদারক খবর দিয়ে। কিংবদন্তি হকি তারকা ভেস পেজ আর নেই! কেবল হকি নয়, ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসে এমন ব্যক্তিত্বের জুড়ি মেলা ভার। ক্রীড়াবিদ হওয়ার পাশাপাশি স্পোর্টস মেডিসিনে খ্যাতনামা চিকিৎসক ছিলেন তিনি। ভারতীয় ক্রিকেট, ডেভিস কাপ দল-সহ দেশের একাধিক প্রথম সারির ক্রীড়া সংস্থার ফিজিও এবং চিকিৎসক হিসাবে কাজ করেছেন তিনি। তাঁকে বলা হয়, ক্রীড়াজগতে ‘বিরল সমন্বয়’। মিডফিল্ডার ভেস পেজ অলিম্পিক পদকজয়ীও বটে। ১৯৭২-এর মিউনিখ অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী ভারতীয় হকি দলের সদস্য ছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন মোহনবাগানেও হকি খেলেছেন তিনি।
১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপ জয়ী দলের এক সদস্য মহম্মদ আসলাম শের খান। তাঁর আত্মজীবনী ‘টু হেল উইথ হকি’-তেও ইনাম উর রহমানের হকি শৈলীর কথা পাওয়া যায়। ‘স্মৃতিসত্তায় মোহনবাগান’ গ্রন্থে ত্রিদীপ শিটের ‘হকির আসরে মোহনবাগান’ নিবন্ধে উল্লেখ রয়েছে, এহেন আসলাম শের খান ১৯৭২-এর অলিম্পিয়ান এবং তাঁর বাবা আহমেদ শের খান ১৯৩৬-এর অলিম্পিয়ান। পিতা-পুত্রের এই অলিম্পিক পরম্পরার নজির ভারতবর্ষে হাতে গোনা। বিষয়টা এই লেখায় আনার নেপথ্যে একটাই কারণ, তা হল পরিসংখ্যান। পিতা-পুত্রের এই অলিম্পিক পরম্পরার নজির কিন্তু রয়েছে পেজ পরিবারেও। ভেস পেজ-লিয়েন্ডার পেজ দু’জনেই কিন্তু অলিম্পিক খেলেছন। যেমনটা খেলেছেন ধ্যানচাঁদ এবং তাঁর পুত্র অশোক কুমার।
এই অশোক কুমার সত্তরের দশকে মোহনবাগানে খেলতেন। সেই সময়েই মোহনবাগানে খেলতে এসেছিলেন অলিম্পিয়ান ডা. ভেস পেজ। ত্রিদীপ শিট আলোচনা করছেন, অশোক কুমারের কাছ থেকে সেই সময়ের মোহনবাগান দল সম্পর্কে যা জানা যায়। তা হল ব্যাকে গুরবক্স সিং ও জেনঃ সিং, রাইট হাফে রাজ কুমার, সেন্টার হাফে ডা. ভেস পেজ, লেফট হাফে ওয়াহিদ খান, রাইট আউটে সুলেমান, রাইট ইনে অশোক কুমার, লেফট ইনে ইমান উর রহমান, লেফট আউটে শাহিদ নূর, সেন্টার ফরোয়ার্ড ইক্রাম উর রহমান। এমনই দুর্ধর্ষ টিম ছিল যে, ১৯৭০, ১৯৭১ ও ১৯৭২ টানা তিনবার হকি লিগ জিতল মোহনবাগান। বেটন কাপেও টিম ধারাবাহিকভাবে সাফল্য অর্জন করতে থাকে সবুজ-মেরুন। ১৯৭১-এর বেটন কাপে মোহনবাগান বিএসএফ জলন্ধরের সঙ্গে যুগ্মজয়ী হয়। অশোক কুমার ১৯৭১-এর বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান। ১৯৭২ সালেও এই দুই দল বেটন কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়। তবে এবার মোহনবাগানকে রানার্স আপের ট্রফি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ৭২-এর মিউনিখ অলিম্পিক্সে ভারতীয় হকি দলের ম্যানেজার হন প্রাক্তন মোহনবাগান খেলোয়াড় কেশব দত্ত। ১৯৭৩ সালে ফের যুগ্মজয়ী হয় মোহনবাগান। তবে এবার অপর ফাইনালিস্ট বিএসএফ জলন্ধর ছিল না, ছিল ১৯৭৩-এর বিশ্বকাপের সম্ভাব্য ভারতীয় দল, যার পোশাকি নাম ছিল আইএইচএফ ডার্ক ব্লুস। সেদিন ফাইনালে মোহনবাগান শুধু ডার্ক ব্লুসদের আটকেই দেয়নি, একটা সময় পর্যন্ত এগিয়ে ছিল। ফাইনালে এক বাঙালি সেন্টার ফরোয়ার্ডের দাপট দেখেছিল কলকাতা ময়দান। সেই বাঙালি সেন্টার ফরোয়ার্ডটি হলেন অমিত দাশগুপ্ত। খেলার শেষে অমিত দাশগুপ্তকে কাঁধে তুলে মোহনবাগান সমর্থকদের উল্লাস আজও মোহনবাগানের বয়স্ক সদস্যদের স্মৃতির সরণিতে উজ্জ্বল। এই ম্যাচে আর একজনের কথা আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়, তিনি হলেন ডা. ভেস পেজ। মোহনবাগান হকির সোনালি দিনগুলির কথা উঠলে তাঁর নাম আসবেই। বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, তাঁর হকির স্টিক রূপকথা আঁকত।
সেই ভেজ পেজ বৃহস্পতিবার না ফেরার দেশে চলে গেলেন। পার্কিনসন রোগ এবং বয়সজনিত অসুস্থতার কারণেই দেহান্ত হয়েছে তাঁর। ১৯৭২ অলিলিম্পিকে ভেস পেজের সতীর্থ অজিত পাল সিং শোকপ্রকাশ করে জানিয়েছেন, “স্পোর্টস মেডিসিনের প্রতি এতটাই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন যে, হকি কেরিয়ার শেষ করে এতেই সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেছিলেন।” হকি ছাড়াও ফুটবল, ক্রিকেট এবং রাগবিতেও অবদান রেখেছিলেন তিনি। ১৯৯৬ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ভারতীয় রাগবি ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। একটা সময় বেশ কয়েক বছর ধরে বিসিসিআইয়ের ডোপিং-বিরোধী কর্মসূচিরও অংশ ছিলেন তিনি। পাশাপাশি এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলেও কাজের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। জানা যায়, সুভাষ ভৌমিকের অনুরোধে তিনি ইস্টবেঙ্গল এবং ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক বাইচুং ভুটিয়ার মতো ফুটবলারের সঙ্গেও কাজ করেছিলেন। কলকাতা ক্রিকেট ও ফুটবল ক্লাবের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করা ভেস পেজ প্রাক্তন বাস্কেটবল খেলোয়াড় জেনিফার পেজের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মৃদুভাষী এই মানুষটা ভারতীয় ক্রীড়াজগতে একজন ‘ম্যামথ’।