- অন্বেষা বসু রায়চৌধুরী
‘বাবুমশাই, জিন্দেগি বড়ি হোনি চাহিয়ে, লম্বি নেহি…’
বছর কয়েক আগে দিদনের সঙ্গে বসে ‘আনন্দ’ সিনেমাটা প্রথমবারের মতো টিভির পর্দায় দেখার সময় রাজেশ খান্নার বলা এই সংলাপের অর্থ বিশেষ বোধগম্য হয়নি। দিদন বেশ চেষ্টা করেছিল বোঝাবার, তবে তখন ১৭ বছরের এক কলেজ পড়ুয়ার পক্ষে পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব সুদীর্ঘ করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয়কে উপলব্ধি করতে বেশ অসুবিধাই হয়েছিল। দিদন চলে গেছে বেশ কিছুদিন হল, আজ বুঝতে পারি ‘লম্বি জিন্দেগি’ আর ‘বড়ি জিন্দেগি’-র মধ্যেকার তফাতটা।
শেফালি জরিওয়ালা- চকচকে ক্যামেরার আলো, নাচ, গ্ল্যামার আর চিরযৌবনের এক মায়ার নাম। বয়স মাত্র ৪০ পেরিয়েছিল, কিন্তু তিনি দৃঢ়বিশ্বাসী ছিলেন- যৌবন শুধু অনুভব নয়, সেটি ফিরিয়ে আনা যায়। রোজ ইনজেকশন, গ্লুটাথায়ন, ভিটামিন সি, আরও কিছু কঠিন উচ্চারণযোগ্য ওষুধ বিগত সাত-আট বছর ধরে নিয়মিত নিয়ে আসছিলেন তিনি। এত যত্ন, এত নিয়ম, ফিটনেস ট্রেনিং, এত সচেতনতার পরেও মৃত্যুকে ঠেকাতে পারলেন না। তদন্ত বলছে, ইনজেক্টেড অ্যান্টি-এজিং উপাদানগুলো শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালেন্স, হার্ট রিদম এবং লিভার ফাংশনে ধীরে ধীরে বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল। তার ফলেই সম্ভবত এই পরিণতি। প্রশ্ন জাগে, আমরা কি সত্যিই অমরত্বের কাছাকাছি যেতে পারি, নাকি আমরা কেবল আরও “ভালোভাবে মরার” প্রস্তুতি নিই?
এই অ্যান্টি-এজিং’এর জগতে আরও এক বহুল চর্চিত নাম ব্রায়ান জনসন। ভোর সাড়ে ৫টা। ঘুম ভাঙে না ঘড়ির শব্দে। ভাঙে শরীরের ছন্দে। ব্রায়ান কোনও সাধু নন, বা কোনও ফিটনেস গুরুও নন। তিনি একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, যিনি এখন নিজেকে গড়ে তুলছেন এক জীবন্ত গবেষণাগারে। তিনি মানুষের বার্ধক্যকে থামিয়ে দিতে চান অথবা অন্তত তার গতি শ্লথ করতে চান। বছর দশেক আগে তাঁর জীবন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। হতাশা, ওজন বেড়ে যাওয়া, অনিদ্রা, তিন সন্তানের পিতৃত্বের দায়িত্ব- সব মিলিয়ে এক বিষণ্ণ বাস্তবতা। স্টার্টআপ বানাতে গিয়ে নিজের শরীরকে হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। সেখান থেকেই শুরু ‘ব্লু-প্রিন্ট’- এক নিখুঁত, পরিমিত, তথ্যভিত্তিক জীবন পরিচালনার বিজ্ঞান।
তার বাড়ি এখন যেন আধুনিক সভ্যতার মধ্যকার এক স্বাস্থ্য-আশ্রম। দিনে নির্ধারিত পরিমাণে ব্রকোলি, ফুলকপি, মাশরুম, রসুন, আদা, অলিভ অয়েল, বাদাম, আখরোট, বীজ, বেরি ও বাদাম দুধ, মিষ্টি আলু, ছোলা, টমেটো, অ্যাভোকাডো, লেবু, প্রক্রিয়াজাত চিনি, কাঁচা মাংসের মতো খাবার, ৩০-৩৫ ধরনের পরিপূরক, ২৫টিরও বেশি ব্যায়াম, প্রতিটি হৃৎস্পন্দনের মাপকাঠি। ঘুম? সে-ও নির্ধারিত : অন্ধকার ঘরে, শব্দরোধী পরিবেশে, একই সময়ে শোয়া ও ওঠা। স্লিপ ট্র্যাকিং ডিভাইসের মাধ্যমে ৮ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট ঘুম নিশ্চিত করেন। বেশি ক্যালোরির খাবার ও স্ক্রিন টাইম এড়িয়ে চলেন। নিয়মিত ফেসওয়াশ, সানস্ক্রিন ব্যবহার করেন। তাঁর জীবন এখন ইচ্ছার দাস নয়, তথ্যের দাস। জনসন দাবি করেন, তাঁর শরীরে এখন ১৮ বছর বয়সি তরুণের ফুসফুস, ২৮ বছরের মানুষের ত্বক, আর ৩৭ বছরের একজনের হৃদয়। তিনি নিজেকে বলেন, ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি মাপা মানুষ’। প্রতিটি কোষ, প্রতিটি অঙ্গ- তাঁর কাছে একটি গবেষণার বিষয়। এজন্য বছরে তাঁর খরচ ২ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। তবে প্রশ্ন এখানেই, এই সব কি সত্যিই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে? জনসন জানেন, মৃত্যু আসবেই। তাই তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, আমি একদিন সবচেয়ে বিদ্রূপাত্মকভাবে মারা যাব। আমি চাই, তোমরা সবাই সেটি উপভোগ করো।’ তাঁর এই রসিকতাটি যেন সেই সত্যের সামনে এক নিঃশব্দ দাঁত কপচানো হাসি- অমরত্বের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি আর নিরলস চেষ্টা- সব শেষপর্যন্ত শেষেই গড়ায়।
কারণ বাস্তবতা হল, শরীর ক্ষয় হয়, কোষ মরে, আর মন একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য সচেতনতা, বিজ্ঞান, ডায়েট, ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনশৈলী আমাদের জীবন কিছুটা দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যকর করতে পারে- কিন্তু অনন্তকাল নয়। প্রকৃতি এখনও নিজের নিয়মে চলে- শেষে সবাইকেই যেতে হয়। ফলে, অমরত্বের পেছনে ছুটে আমরা হয়তো মিস করে ফেলি ‘এই মুহূর্তের জীবন’। তবুও, এই চেষ্টা আমাদের শিখিয়ে দেয় নতুন এক ভাষা। শরীরকে সম্মান করা, কোষকে বোঝা, বয়সকে বাধা দেওয়া- এসব মানবজাতির চিরন্তন স্বপ্ন। ব্রায়ান জনসনের ব্লু-প্রিন্ট হয়তো আমাদের অমর করবে না, কিন্তু সে প্রশ্ন তো জাগায়- আমরা ঠিক কীভাবে বাঁচতে চাই? ইচ্ছেমতো? না বিজ্ঞানমতো? সম্ভবত উত্তর লুকিয়ে আছে প্রতিটি শ্বাসে, প্রতিটি ঘুমে, আর সেই আলোতে যা ভোরে তাঁর ঘরে জ্বলে ওঠে… সময়কে থামিয়ে রাখার স্বপ্নে।
আর হয়তো সেই স্বপ্নই প্রতিনিয়ত দেখে চলেছেন ব্রায়ান জনসন কিংবা শেফালি জরিওয়ালার মতো হাজার হাজার বিশ্ববাসী। কারণ তরুণ প্রজন্মের অনেকের মধ্যেই এই বয়স বাড়ার বিষয়টি নিয়ে ভয় পাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এই বার্ধক্যভীতিরই আর এক নাম জেরাসকোফোবিয়া- এক নিঃশব্দ আতঙ্ক অথচ এই ভয়ের মুখোমুখি হওয়া মানেই কি চিরযৌবনের খোঁজে ছুটে চলা? মহানায়িকা সুচিত্রা সেন সেই প্রশ্নের এক নিঃশব্দ উত্তর। গ্ল্যামারের আকাশে দেবীর মতো আবির্ভূত হয়ে তিনি একদিন হঠাৎ আড়ালে সরে গেলেন- নির্জনে, আলোছায়ার বাইরে, সময়ের সীমানায়। তাঁর অদ্ভুত গোপনীয়তা ছিল যেন নিজের বার্ধক্যকেও নিজস্ব মর্যাদায় আবৃত রাখার এক প্রচেষ্টা। হয়তো জেরাসকোফোবিয়া নয়, বরং অমরত্বের এক নির্লিপ্ত সংস্করণ ছিল সেটা। অন্যদিকে, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়- সময়ের সঙ্গে সখ্য করে নেওয়া এক সাহসী নাম। আজও তিনি তার কুঞ্চিত ত্বক কিংবা পাকা চুল নিয়ে দিব্যি অভিনয় করেন, কথা বলেন, দর্শকদের হাসান। তাঁর চোখে বার্ধক্য নেই, বরং আছে জীবনের অভিজ্ঞতায় পুষ্ট এক শৈল্পিক দীপ্তি।
পরিশেষে বলাই যায়, অমরত্ব কেবল বিজ্ঞানের বিষয় নয়, তা নৈতিকতাও, ভারসাম্যও, আত্মসচেতনতাও। কেউ অতিরিক্ত ছুঁতে গেলে চিরতরেই ছুঁয়ে ফেলে সেই ‘শেষ সীমা’, যেখান থেকে আর ফেরা যায় না। বিজ্ঞানের বিকাশ যতই হোক, ‘অমরত্ব’ এখনও কেবল এক ধারণা। জীবনকে ভালোবাসতে হবে, তবে বুঝে নিতে হবে- শেষ হতেই হবে একদিন। অমরত্ব নয়, স্মরণযোগ্যতাই হোক আমাদের সাধনা।