মিড-ডে মিল এক খিদে সহ্যের পাঠশালা

মিড-ডে মিল এক খিদে সহ্যের পাঠশালা

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


অনিন্দিতা গুপ্ত রায়

‘একটু বাইরে যাব ম্যাডাম? সামনের মিষ্টির দোকানে?’ সংকুচিত গলার প্রশ্ন শুনে মুখ তুলে দেখি রুগ্ন শীর্ণ চেহারায় অনাবিল মুখ এক সদ্য কিশোরী ছাত্রী। ‘কেন রে? বাইরে কেন যাবি? ছুটি হয়নি তো, সবে তো টিফিন হল…’।

‘খুব খিদে পেয়েছে ম্যাডাম। পুরি তরকারি কিনে নিয়েই চলে আসব…’ কেন? মিড-ডে মিল খা। আজ তো ডিমভাত, সঙ্গে ডালসেদ্ধ। তোদের ফেভারিট! খাবি না?’

বর্ণনায় ঢোঁক গিলে মেয়ে, তারপর চোখ নামিয়ে বলে, ‘আমি তো ক্লাস নাইনে উঠলাম এবার। আমার তো মিড-ডে মিল নাই এবার থেকে ম্যাডাম।’

লজ্জিত অপ্রস্তুত হয়ে বলি, ঠিক আছে আজ খেয়ে নে, কাল থেকে টিফিন নিয়ে আসিস, বা স্কুলে মাসির কাছ থেকে কিছু কিনে নিস, কেমন?

‘থ্যাংক ইউ ম্যাডাম’ বলে একছুটে মেয়ে চলে যায়। ম্যাডাম বসে ভাবেন, সত্যিই তো স্কুলে বিক্রি হওয়া ঝালমুড়ি বা বাদামভাজা বা ছোট্ট বাটিতে ঘুগনি কি প্রাইমারি থেকে অভ্যস্ত হওয়া দুপুরের ওই ভাতের খিদের আগুন নেভাতে পারে আদৌ? মিষ্টির দোকানের পুরি তরকারি হয়তো কিছুটা পারে। কিন্তু স্কুলে সে ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়।

কিছু পরেই রান্নার গ্রুপের দিদিরা হাজির। ‘আপনি কি নাইনের মেয়েদের খেতে বলেছেন? আমরা তো পারব না এতজনকে দিতে দিদি’! চুপ করে বসে থাকি নিরুত্তর। একজন মেয়ে খেতে বসায় আরও দশজন থালা নিয়ে লাইনে। এত অসহায় কখনও লাগেনি নিজেকে!

আমরা যারা গ্রামীণ প্রান্তিক স্কুলগুলোয় শিক্ষকতা করি, এই ছবিটা তাদের খুব চেনা। ক্লাস এইট অবধি প্রতিদিন দুপুরে স্কুলে ভাত খেয়ে অভ্যস্ত পেটে ক্লাস নাইনে ওঠার আনন্দ টিফিন পিরিয়ডে ম্লান হয়ে যেতে দেখি প্রতিবার, যার হদিস অপেক্ষাকৃত শহরাঞ্চল বা সম্পন্ন ঘরের ছাত্রছাত্রীভুক্ত স্কুলগুলি ধারণাও করতে পারে না।

অনেক বছর আগে এক শনিবার ক্লাস ছুটির আগে নতুন আসা দিদিমণির মেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে বোকা হয়ে যাওয়া দিনটা আজও স্মৃতিতে অম্লান। ‘কাল রবিবার। তোমরা ভালো করে মাংসভাত খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার পরশু চলে এসো। কী, কাল বাড়িতে ভালো খাওয়াদাওয়া না?’ নিশ্চুপ ছিল ক্লাসঘর। একটি সপ্রতিভ মেয়ে উঠে বলেছিল, ‘ম্যাডাম আমাদের তো দিনে একবার ভাত হয়। সকালে খুব খিদে পায়। ভাত খেয়ে নিই। দুপুরে আর খাই না। স্কুল খোলা থাকলেই বরং দুপুরে খাওয়া হয়।’

স্কুলে অভিভাবক সভা করে বলা হয়, মেয়েদের ছাতু, চিঁড়ে মুড়ি এরকম পেট ভরানোর মতো ঘরোয়া খাবার দিয়ে দেবেন। মায়েরা বলেন, ‘ম্যাডাম ওরা খেতে চায় না। অভ্যেস নেই তো সেই প্রাইমারি থেকে এতদিন স্কুলে ভাত খেয়ে খেয়ে।’ যে দু’এক পার্সেন্ট মেয়ে আমাদের স্কুলেও বরাবর টিফিন নিয়ে আসে, মিড-ডে মিল খায় না, তাদের বরাদ্দ খাবারটুকু দিয়ে অন্য উঁচু ক্লাসের কিছু মেয়েকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেতে দেওয়া হয় এসব স্কুলে। কিন্তু সেই সংখ্যাটা খুবই নগণ্য।

প্রতিবছর মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ভেনু হওয়ার কারণে যখন প্রায় দেড় মাস ক্লাস বন্ধ থাকে, সেসময় বাচ্চাগুলো দুপুরে গরম ডালভাত খেতে পায় কি না আদৌ, সে চিন্তা উঁকি দেয় শুনে অবিশ্বাসের হাসি হাসতেই পারেন কেউ। কিন্তু যে শিক্ষকরা ওই বাচ্চাগুলোর খাওয়ার সময় তৃপ্তির মুখে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের সন্তানস্নেহে খাওয়ান তাঁরা একমত হবেন জানি। যে দিদিমণি ছাত্রী অবস্থায় রোজ সাত সাত চোদ্দো কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে স্কুল যাওয়া-আসা করে অতি কষ্টে ক্ষুদ্র ভাগচাষি পরিবার থেকে লড়াই করে উঠে এসেছেন, তিনি যখন খাবারের মান নিয়ে সামান্যতম আপসে অসন্তুষ্ট হয়ে গলা চড়িয়ে কথা বলেন, প্রধানের চেয়ারে বসে থাকা মানুষটি অনেক ছোট সেই দিদিমণিকে জড়িয়ে ধরেন মনে মনে।

সেল্ফ হেল্প গ্রুপের দিদিরা নালিশ করতে আসেন—‘এই টাকায় এর চেয়ে ভালো কী করে করব বলুন তো?’ ছোট দিদিমণি ফুঁসে ওঠেন, ‘কেন পারবেন না? একটু যত্ন করে দিতে তো পারবেন!’ দিদিমণি, মাস্টারমশাইরা নিজে হাতে বাগান করেন অনেক স্কুলেই বাচ্চাগুলোর মুখে আরেকটু স্বাদু ব্যঞ্জন তুলে দেওয়ার ইচ্ছেয়। সবাই সামাজিক মাধ্যমে তার বিজ্ঞাপন করেন না। আর যদি করেও থাকেন তাতে দোষ দেখি না।

এই সময়েই অতিরিক্ত সুষম খাবারের যে তালিকা বরাদ্দ হয়েছে, তার থেকে বঞ্চিত হল দুটি বড় বোর্ড পরীক্ষার কারণে বন্ধ থাকা স্কুলের বাচ্চাগুলো। তাদের জন্য বরাদ্দ খাদ্য তো তাদের অধিকার! তারা কি পরে তা পাবে আর? মাস্টারমশাইরা সমাজের সফট টার্গেটের অন্যতম। রন্ধ্রে রন্ধ্রে চৌর্যবৃত্তির দোহাই পেড়ে, তাঁদের যে কোনও সদিচ্ছাকেই আক্রমণ করার প্রবণতার মতোই মিড-ডে মিল প্রকল্পটিতে তাঁদের ভূমিকা নিয়েও সন্দেহ ও অবিশ্বাসের আঙুল বা দৃষ্টি সমাজে প্রচলিত।

তার সবটাই মিথ্যেও নয়, সব প্রকল্পের মতো, অবশ্যই। তারপরেও, সমালোচিত হতে হবে জেনেও জানতে ইচ্ছে করে, বিদ্যালয়ে নবম, দশম শ্রেণি দুটোকে কি এই মিড-ডে মিলের আওতায় আনা যায় না সত্যিই? এ কথার প্রেক্ষিতে আক্রমণ ছুটে আসবে তাঁদের দিক থেকে যারা বিন্দুমাত্র খবর রাখেন না, প্রচুর স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের কাছে দুপুরের সামান্য একটু ডালভাত সবজি কতটা আকাঙ্ক্ষিত। যে তৃপ্তি নিয়ে অধিকাংশ বাচ্চা খায়, দেখতে দেখতে সত্যিই মনে হয় খালি পেটে কিছুই হয় না আসলে। মিড-ডে মিল মানে আসলে টাকা চুরির কৌশল এই প্রচলিত গল্পটা শহরে বা সমাজমাধ্যমে যাঁরা তোলপাড় করে আলোচনা করেন, পড়াশোনা লাটে ওঠার কারণ বলে চিহ্নিত করেন, তাঁরা কখনও ওই ক্ষুধার্ত বাচ্চাগুলোর সামনে আসলে দাঁড়াননি।

অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমন অভিভাবক আমাদের স্কুলে আছেন, যিনি এসে কাতর অনুরোধ করেন, ‘এবছর কি মেয়েটাকে ক্লাস এইটে রাখা যায় না আরেকবার ম্যাডাম? এতগুলো পেটের একবারের ভাত জোগাড় করাও খুব মুশকিল আমার। নিজে লোকের বাড়ি রান্না করে দুপুরে খাই, রাতেরটা নিয়ে আসি। ভোরে বেরোই। স্বামী নিরুদ্দেশ। অত সকালে ভাত রান্না করে খেয়ে ও স্কুলে আসতে পারবে না ম্যাডাম!’

এই বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে স্কুলে টিফিনের পরের ক্লাসগুলোয় নিভে আসা মুখগুলোর কাছে ইতিহাস, ভূগোল কিছুই আর বোধগম্য ঠেকে না। তিনটার সময় চুপিচুপি স্কুল থেকে পালিয়ে যেতে উদ্যত মেয়েটি ধরা পড়ে চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে যখন বলে ‘ভুখ লাগে খুব’ দিদিমণির চোখ নেমে যায়, শরীর শিথিল লাগে।

মিড-ডে মিল দেওয়া নিয়ে নানা বাকবিতণ্ডা অশান্তি ঝামেলা ইত্যাদির গল্পের ভিতর শিক্ষাদান আদৌ হারিয়ে যাচ্ছে কি না, প্রতিটি বাচ্চার মুখের খাবার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে কি না, শিক্ষকরা এসব কাজের জন্য মাইনে পান কি না এরকম হাজার প্রশ্ন বিতর্ক বিরক্তির মধ্যেই আমাদের স্কুলের মতো স্কুলগুলিতে প্রতিবছর বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরোয়, নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় আর শিক্ষকদের অসহায়তাও নতুন করে বুকের ভিতর আছড়ে পড়ে। যেখানে মিড-ডে মিলের শেডের দিকে সদ্য নবম শ্রেণিতে ওঠা ছেলে বা মেয়েটি তাকিয়ে থাকে, গরম ডালভাতের গন্ধে ঢোঁক গেলে। তারপর আর সব কষ্ট সহ্য করার মতো ওরা একদিন খিদে সহ্য করতেও শিখে যায়।

(লেখক শিক্ষক ও সাহিত্যিক। জলপাইগুড়ির বাসিন্দা)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *