মার্কিন শুল্ক চাপে ভারত-চিন ঘনিষ্ঠতা: এক নয়া কূটনৈতিক সমীকরণ?

মার্কিন শুল্ক চাপে ভারত-চিন ঘনিষ্ঠতা: এক নয়া কূটনৈতিক সমীকরণ?

জ্যোতিষ খবর/ASTRO
Spread the love


ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে ভারত-চিন সম্পর্ক সবসময় জটিল। তবে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক বাণিজ্যের চাপে এই দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হচ্ছে। যদিও সেই পথ সহজ নয়। সময়ই বলে দেবে এই চাপের ফলাফল কৌশলগত সমঝোতা নাকি কেবল সাময়িক হিসাবের খেলা। লিখছেন ড: শোভিক মুখোপাধ্যায়

বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এক নতুন মোড় নিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে চিনের ওপর শুল্ক আরোপ এবং একই সঙ্গে ভারতীয় পণ্যের ওপরও সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করায় এশিয়ার দুই শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারত ও চিন পরস্পরের দিকে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করছে। যদিও ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে ভারত-চিন সম্পর্ক সবসময় জটিল, তবে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক বাণিজ্যের চাপে এই দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হচ্ছে।

২০২৪ ও ২০২৫ সালে মার্কিন প্রশাসন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির ধারাবাহিকতায় চিনা ইলেকট্রনিক্স, সোলার প্যানেল, ব্যাটারি এবং ইস্পাতজাত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। একই সময়ে ভারতীয় কিছু ওষুধ, ইস্পাত এবং তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবার ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে চিন ও ভারতের রপ্তানির বড় একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং উভয় দেশই বিকল্প বাজার ও কৌশলগত বাণিজ্যিক মিত্র খুঁজতে বাধ্য হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের কাছে চিনের বাজার এবং চিনের কাছে ভারতের প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্ব আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

ভারত ও চিনের মধ্যে সম্পর্ক সব সময়ই ছিল বহুস্তরীয়। সীমান্ত বিরোধ, ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, এবং বিশ্বাসের অভাব এই সম্পর্ককে বহুবার উত্তপ্ত করেছে। গালওয়ান সংঘর্ষের মতো ঘটনাগুলি এখনো তাজা স্মৃতির মতো বিরাজমান। তবে এর পাশাপাশি দুই দেশ একাধিক আন্তর্জাতিক ফোরামে একসঙ্গে কাজ করেছে, যেমন ব্রিকস, সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন, এবং সম্প্রতি রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ নিয়ে আলোচনা। এই মঞ্চগুলোতে অংশগ্রহণ থেকেই বোঝা যায়, দুই দেশই জানে যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা ভবিষ্যতের জন্য লাভজনক হতে পারে। কিন্তু যদি যুক্তরাষ্ট্র তাদের শুল্কনীতি চালিয়ে ভারতের রপ্তানি সম্ভাবনাকে দমন করে রাখে, তবে RCEP-এর মতো এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিশাল মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে যোগদানের অর্থনৈতিক যুক্তি পূর্বের আপত্তিগুলোর চেয়েও অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।

এটি কেবল ভারতকে চিন ও আসিয়ান অর্থনীতির আরও কাছাকাছি নিয়ে আসবে না, বরং আঞ্চলিক ভারসাম্যের এক নাটকীয় পুনর্বিন্যাস এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগকেও নির্দেশ করবে। এর ফলে ভারত ও চিন এমন কাঠামো তৈরি করতে পারে, যেগুলো আঞ্চলিক অর্থনৈতিক মান নির্ধারণের জন্য একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে যদি এমন উন্নয়ন ঘটতে থাকে, তবে তা ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনকে নির্দেশ করবে। ভারত ও চিনের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক মিল— যা আদর্শগত পরিবর্তনের কারণে নয়, বরং কৌশলগত প্রয়োজনে চালিত— গত কয়েক দশকের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রচলিত ধারণাগুলোকেই চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।

মার্কিন শুল্কচাপের কারণে ভারত ও চিনের মধ্যে বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতা বাড়ার কয়েকটি প্রধান দিক রয়েছে। প্রথমত, বিকল্প সরবরাহ শৃঙ্খলা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা একে অপরের বাজারে প্রবেশ করে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। চিনের উৎপাদন দক্ষতা এবং ভারতের প্রযুক্তি ও পরিষেবা খাত একে অপরের পরিপূরক ভূমিকা পালন করতে পারে। একই সঙ্গে, ডলারের উপর নির্ভরতা কমিয়ে ইউয়ান ও রুপির মাধ্যমে লেনদেন বাড়ানো গেলে তা দুই দেশের জন্যই লাভজনক হতে পারে।

ব্রিকস অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিকল্প বাজার খোঁজা এবং একে অপরের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। যৌথ বিনিয়োগ, প্রযুক্তি বিনিময় ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে সদস্যদেশগুলো নিজেদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়াচ্ছে, যাতে মার্কিন বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যায়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং অন্যান্য বহুপাক্ষিক মঞ্চে সমন্বিত অবস্থান নিয়ে মার্কিন শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এছাড়াও, এই ঘনিষ্ঠতায় রাশিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়া পশ্চিমা জোট থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং চীন ও ভারতের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। রাশিয়া এমন কিছু প্রস্তাব রাখতে পারে যা ভারত-চিন সহযোগিতার পথে সহায়ক হতে পারে, যেমন যৌথ শক্তি প্রকল্প, সামরিক-অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং এশিয়া-কেন্দ্রিক নতুন প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম গঠন।

এই ঘনিষ্ঠতার পথে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সীমান্ত পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি, এবং ভারত এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগতভাবে ঘনিষ্ঠ। কোয়াড্রিলাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগ বা ইন্দো-প্যাসিফিক ফোরামে ভারতের অংশগ্রহণ চিনের জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে। এছাড়া দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, জনমত এবং নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ এই সহযোগিতার গতিপথে প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে চাপ ও সুযোগ সব সময়ই পাশাপাশি চলে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি আপাতদৃষ্টিতে ভারত ও চিনের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করলেও, একইসঙ্গে এটি নতুন একটি সুযোগও তৈরি করেছে — দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায় রচনা করার। পারস্পরিক আস্থা ও বাস্তববাদী কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে, ভারত ও চিন ভবিষ্যতে আরও ঘনিষ্ঠ হতে পারে। তবে সেই পথ সহজ নয়। সময়ই বলে দেবে এই চাপের ফলাফল কৌশলগত সমঝোতা নাকি কেবল সাময়িক হিসাবের খেলা।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *