সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: যুদ্ধ, সংঘর্ষ, মৃত্যু, শরণার্থী… মধ্যপ্রাচ্যের নিয়তি! দশকের পর দশক ধরে প্রতিদিন সূর্য ওঠে নতুন সংঘাতের খবর নিয়ে। কখনও সৌদি-ইরান, কিংবা ইরান-ইরাক, কখনও প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল, কখনও বা ইজরায়েল-ইরান। নেপথ্যে থাকে আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো সুপার পাওয়ার। মধ্যপ্রাচ্যে যেন মহাবিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলির খেলার মাঠ, দাবার বোর্ড কিংবা কুরুক্ষেত্র! প্রশ্ন ওঠে, কেন মধ্যপ্রাচ্যই? এই অঞ্চলের মানুষের অপরাধ কী? মারণ যুদ্ধে লাভ কার?
মধ্যপ্রাচ্য মানে মেসোপটেমিয়া। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ সভ্যতা। আরব্য রজনীর রোম্যান্টিক নগর বাগদাদ, দামাস্কাসের মতো শহর তো মধ্যপ্রাচ্যেরই প্রতিনিধি। বর্তমানে যা ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত। এমন অঞ্চল নিয়ে স্থানীয় রাষ্ট্রশক্তি, ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং জঙ্গি গোষ্টীগুলির সংঘাতে জড়ানোর পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। বিষয়টিকে স্পষ্ট করতে হলে টাইম মেশিনে চড়ে ফিরে যেতে হবে শতাধিক বছর পিছনে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯১৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে বড়সড় পরিবর্তন আসে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কাছে পরাজিত অটোমানরা মিশর, লেবানন, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া-সহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারায়। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, কতকটা ভারত-পাকিস্তানের মতোই মধ্যপ্রাচ্যকে চিরকালের সংঘাতভূমিতে পরিণত করতে এক ভাষা, ধর্ম, জাতিগোষ্ঠীকে সুকৌশলে বহুভাগে বহুদেশে বিভক্ত করা হয়। এই কূট অভিসন্ধী বাস্তবায়িত করেন ব্রিটিশ ও ফরাসি কূটনীতিক মার্ক সাইস্ক এবং জর্জ ফিকো।
ফলস্বরূপ, ১৯১৭ সালের পর শিয়া ও সুন্নি মিশ্রণে লেবানন, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, ওমান, জর্ডনের মতো দেশগুলি স্বাধীনতা পায়। ওই সময় থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি লড়াই চরম ওঠে। অন্যদিকে ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও তুরষ্কে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়া কুর্দরা স্বাধীনতার দাবীতে লড়াই চালাতে শুরু করে। শিয়া-সুন্নি-কুর্দি ত্রিমুখী লড়াই মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিভঙ্গের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইহুদিদের নিয়তি ইজরায়েল গঠনে প্ররোচিত করে। ১৯১৭ সালেই ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফো স্বাধীন ইজরায়েলের ঘোষণা করেন।
ওই ঘোষণা বাস্তবায়িত হয় ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে প্যালেস্টাইনকে তিনভাগে বিভক্ত করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে। এতে প্যালেস্টাইনের ৫৬ শতাংশ জায়গায় ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল এবং ৪৩ শতাংশ জায়গায় স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র আর জেরুজালেম চিহ্নিত হয়। প্যালেস্টাইন এবং আরব লিগ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। বিষয়টিকে ইহুদিরা পাত্তা দেয়নি। ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে। এরপর ইহুদি ও আরব মুসলমানদের মধ্যে সংঘর্ষ ভয়ংকর আকার ধারণ করে। যা আজও গাজা ভূখণ্ডে অব্যাহত। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পরেও দু’পক্ষ ক্ষান্ত দেয়নি। উলটে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম বিশ্বও। কেন?
মধ্যপ্রাচ্য পাশ্চাত্যের নজরে এসেছিল সেই ১৯৩৪ সালেই। সেই বছরই তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের খনিগুলি আবিষ্কৃত হয়। শুরু হয় আমেরিকা, রাশিয়া ও ব্রিটেনের মতো তৎকালীন সুপারপাওয়ারগুলির কৌশলী রাজনীতি। জর্ডন, বাহরিন, সৌদি আরব, কুয়েতের বাদশাহদের, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এবং তুরস্কের সামরিক শাসকদের সমর্থন করে আমেরিকা। ইরানের আলিরেজা শাহ এবং মিশরের আনোয়ার সাদাতকে সমর্থন করে ব্রিটেন। রাশিয়ার সমর্থন পায় সিরিয়ার আল আসাদ সরকার। বিনিময়ে শিল্পোন্নত পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও গ্যাসের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যায়। যদিও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কখনই টেকেনি বেশি দিন।
কারণ, ইজরায়েল ও আরবদের যুদ্ধে বারবার ইহুদিদের পাশে দাঁড়িয়েছে পশ্চিম বিশ্ব। গত অর্ধ শতকের ইতিহাস বলছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির শাসকরা ক্রমে বুঝতে পারেন, তেল সেই প্রাণভোমরা যার দৌলতে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো সম্ভব আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেনের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলিকেও। অন্যদিকে এই কৌশলের বিপরীতে সাদ্দামের মতো ফ্র্যাঙ্কেস্টাইনের জন্ম হয়েছে। পাশ্চাত্যের সুপার পাওয়ারদের ইন্ধনেই যাদের বাড়বাড়ন্ত, পরবর্তীকালে সেই হাতের পুতুলকে ছুড়ে ফেলতে দু’বার ভাবেনি শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার এই কৌশলে জন্ম হয়েছে হামাস, হাউতির মতো বহু জঙ্গি গোষ্ঠীর। এতে মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তি বেড়েছে বৈ কমেনি। নতুন করে অশান্তি সৃষ্টি হয় তখন, যখন আরব দুনিয়া পরমাণু শক্তিধর হওয়ার চেষ্টা করে।
চিরশত্রু ইরান পরমাণু বোমা বানানোর চেষ্টা শুরু করলে শঙ্কিত হয় ইজরায়েল। আজ আমেরিকাও নানাভাবে ইরানকে রোখার চেষ্টা করছে। অথচ ১৯৫৭ সালে আমেরিকার সাহায্যেই ‘শান্তির জন্য পরমাণু প্রকল্প’ শুরু করেছিল ইরান। সাতের দশকে পাশ্চাত্যের সহযোগিতাতেই পরমাণু চুল্লি তৈরি হয়েছিল সেদেশে। ১৯৭৯-তে আরব বিশ্ব একজোট হয়ে ‘ইসলামিক বিপ্লব’ করলে ওই সহযোগিতা স্থগিত হয়। এরপর ২০১৫ সালে আমেরিকা ও অন্য দেশের সঙ্গে চুক্তি করে ইরান। ওই চুক্তি অনুসারে ৩.৬৭ শতাংশ সীমার বেশি ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে না দেশটি। ২০১৮ সালে ওই চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। যদিও চুক্তির পরোয়া না করে ২০২৪ সালের মধ্যে ইরান ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, পরমাণু বোমার জন্য লাগে ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ কার্যসিদ্ধির খুব কাছে আয়াতুল্লা আলি খামেনেইয়ের দেশ।
ঠিক এই কারণেই শঙ্কিত ইজরায়েল। ইহুদি দেশটির নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত আমেরিকাও। একই কারণে ১৯৮১-তে ইরাকে আক্রমণ চালিয়েছিল ইজরায়েল। এবার পালা ইরানের। আমেরিকাও চায় না জ্বালানি তেলে সমৃদ্ধ ইরান পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠুক। কারণ সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ইরানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না ওয়াশিংটন। সবচেয়ে বড় কথা, তেলের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণও হারাতে হবে আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেনের মতো পশ্চিম বিশ্বের দেশগুলি। নির্মম সত্যিটা হল, মধ্যপ্রাচ্যকে চিরকালীন ‘কুরুক্ষেত্র’ বানিয়ে রাখলে, যুদ্ধ আর সহিংসতার দিকে ঠেলে দিলে ফায়দা শক্তিশালী দেশগুলিরই।