সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: এ যেন কবি জয় গোস্বামীর মালতিবালা বালিকা বিদ্যালয়! তবে শুধু বালিকা নয়, বালকও রয়েছে।
পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি ব্লকের অযোধ্যা পাহাড়চূড়োর গ্রাম জিলিংসেরেঙ-এ এভাবেই চলছে মালতির বিনা পয়সার স্কুল। সাঁওতালি, বাংলা মাধ্যমের স্কুলের একমাত্র শিক্ষক আদিবাসী বধূ মালতি মুর্মু। আর তাঁর হাত ধরেই শিক্ষার আলো জ্বলছে পাহাড়চূড়ার ওই পিছিয়ে পড়া গ্রামে। মালতিবালা বিদ্যালয়ের হাত ধরেই স্কুলমুখী হচ্ছে শিশুরা। কমছে স্কুলছুটের সংখ্যাও।
যে গ্রামে রাজ্যে পালাবদলের পরেও ছিল না রাস্তা। বিচ্ছিন্ন গ্রাম ছিল মাওবাদীদের ডেরা। সন্ধ্যাতে রাত নেমে এলেই মশাল জ্বালিয়ে সমাজ বদলানোর পাঠ দিত মাওবাদীরা। সেইসব হাড় হিম করা দিন আজ অতীত হলেও হাতি-মানুষে অসম সংঘাত এখনও চলছে এই গ্রামে। বুনো হাতির সঙ্গে লড়াই করেই দিন কাটে তাদের। জঙ্গল-পাহাড়-টিলার এই গ্রাম থেকে ঝালদার দূরত্ব ১৮ কিমি। বাঘমুন্ডি ২৫। বাসপথে কোনও যোগাযোগ নেই। সকলের মোটরবাইক, এমনকী সাইকেল পর্যন্ত নেই। হাঁটা পথই যোগাযোগের মাধ্যম। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন স্থায়ী শিক্ষক ও দু’জন পার্শ্ব শিক্ষক থাকলেও তাঁরা নিয়মিত আসেন না বলেন অভিযোগ।
সাড়ে ১১ টা থেকে শুরু হওয়া স্কুল দেড়টাতেই শেষ হয়ে যায়। তবে অবৈতনিক মালতির বিদ্যালয়ের হাত ধরে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে শিক্ষার হাল। সকাল হলেই মাথায় কাঠের বোঝা ছেড়ে বই-র পাতায় মুখ রাখছে। আটের ঘরের নামতা মুখস্থ বলছে ক্লাস টু’র পড়ুয়ারা-ই। তাই জিলিংসেরেঙ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮ থেকে পড়ুয়ার সংখ্যা এখন বেড়ে হয়েছে ৩০। আর কোনও ছাত্রছাত্রী স্কুল ছাড়ে না। মাটির দেওয়ালে সাদা-কালো বোর্ডে ছবি এঁকে মগজস্থ করে দিচ্ছেন যে তিনি। তাই সকাল হলেই প্রাক প্রাথমিক থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ৪৫ জন পড়ুয়া ব্যাগ নিয়ে ছুটছে মালতির স্কুলে। মালতি দিদিমণি যে ভীষণ কড়া। সকাল ৬ টার একটু দেরি হলেই হল! সাড়ে আটটা থেকে ৯ টার মধ্যে যে এই অবৈতনিক স্কুলের দরজা বন্ধ করতে হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাবার জন্য ছাত্রছাত্রীদের তৈরিতে তো সময় দিতে হবে। পাহাড়চূড়ার এই গ্রামে একাধিক টোলা মিলিয়ে প্রায় ৯০ টি আদিবাসী পরিবার রয়েছে। যার মধ্যে পাহাড়িয়া পরিবার ৩৫ টি।
‘দিদিমণির পাশে দিদিমণির বর।’
হ্যাঁ, কবির মালতিবালা বালিকা বিদ্যালয়ের মতোই মালতির স্কুলেও তার স্বামী বাঙ্কা মুরমু হাজির থাকেন। পড়ুয়াদের দেখভালের পাশাপাশি স্কুল চালিয়ে নিয়ে যেতে স্ত্রী মালতিকে সবসময় সাহায্য করেন। দিদিমণি মালতির কথায়, “উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। ২০১৯ সালের এপ্রিলে বউ হয়ে এই গ্রামে পা রাখি। কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পারি এখানকার ছেলে- মেয়েদের লেখাপড়ায় সেভাবে আগ্রহ নেই। স্কুলমুখি হলেও
পরে স্কুল ছুট হয়ে যাচ্ছে । কারণটা কী বোঝার চেষ্টা করি? একদিকে অভাব। সেই সঙ্গে গাইড করার কোনও লোকজন নেই। তাই ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে নিজের ঘরেই পাঠদান শুরু করি। সেই সময় থেকে এখনও পর্যন্ত আমার স্বামী এই স্কুলের জন্য সবরকম সাহায্য করছেন।” তাই এখন আর ওই ঘরে স্কুল চলে না। সেই ঘর থেকে ঝুপড়ি। তারপর গ্রামবাসীদের সহায়তায় মাটির দেওয়ালে টিনের চালা দিয়ে মালতির স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে।
২৪ বছরের মালতির স্বামী বাঙ্কা মুর্মু বলেন, “স্ত্রীর এই কাজে আমি সবসময় ওর পাশে রয়েছি। প্রশাসন সাহায্য করুক বা না করুক। গ্রামবাসীরা এগিয়ে এসেছেন । এই অবৈতনিক স্কুলের পরিকাঠামো গড়ে দিয়েছেন। আমাদের ইচ্ছে আগামী দিনে পঞ্চম থেকে অষ্টম পর্যন্ত পাঠ দেব। যেমন আমাদের সংসার তেমনি মালতির স্কুল। তাই লেখাপড়ার পাশাপাশি গানও শেখানো হয়।” বাঘমুন্ডির বিডিও আর্য তা বলেন, “ওই আদিবাসী বধূ সত্যি-ই ভালো কাজ করছেন। বই-খাতা সহ সবকিছু জিনিস দিয়ে আমরা ওই স্কুলকে সাহায্য করব।”
ওই বধূ তার স্কুলের আলাদা করে নামও দিয়েছেন। ‘মারাংবুরু জাহেরআয়ো ইতুন আষাড়া’। তবে এই বিদ্যালয় মালতিবালা বিদ্যালয় নামেই বেশি পরিচিত। স্কুলে প্রাথমিক পাঠ নেওয়া চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র সূর্যমনি মুর্মু, তৃতীয় শ্রেণীর কৃষ্ণ মান্ডি বলে, “মালতি দিদিমনির স্কুলে আমাদেরকে ছবির মত করে, গল্প শুনিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়। খুব ভালো লাগে আমাদের। ” ওই গ্রামের বাসিন্দা তথা অভিভাবক কার্তিক মুর্মু, দুখু মুর্মু বলেন, “মালতির ওই স্কুল হওয়ার পর গ্রামের পরিবেশটাই যেন কেমন বদলে গিয়েছে। আগে তো পেটের টানে ছেলে-মেয়েদেরকেও জঙ্গলে যেতে হত। কাঠ কুড়িয়ে সেই বোঝা নিয়ে আসত। এমনকি ওই বোঝা হাটেও নিয়ে যেতে হত।”
এখন সন্ধ্যাতেই আর রাত নামে না ওই পাহাড়ি গ্রামে। বিদ্যুতের আলোয় কাঁধ দুলিয়ে দুলিয়ে আটের ঘরের নামতা বলে হেমন্ত, বাসন্তীরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন