কিশোর ঘোষ: সেই কবে ‘অপার’ বাংলার কবি শামসুর রহমান বলেছিলেন—“বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে ঝরে/ রৌদ্র, বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন। বাংলা ভাষা/ উচ্চারিত হলে অন্ধ বাউলের একতারা বাজে/ উদার গৈরিক মাঠে, খোলা পথে, উত্তাল নদীর/ বাঁকে বাঁকে; নদীও নর্তকী হয়…।” সেই বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য হেনস্তা করা হচ্ছে বাঙালিকে! যে সোনার বাংলায় রচিত দেশের জাতীয় সঙ্গীত, হায়, আজ সেই বাংলাকে অপমান! ‘একুশে’ বাঙালির এক গর্বের উচ্চারণ। ১৯৫২ সালের একুশ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতিতেই তো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জন্ম। আরেক ‘একুশে’ নব ভাষা আন্দোলনের ডাক দিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক তখন, যখন ভিনরাজ্যে বাংলা বললেই নির্যাতন করা হচ্ছে বাঙালিকে। দেশের একাধিক রাজ্যে বাঙালির উপর এই অত্যাচার নিয়ে সরব হলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুবোধ সরকার, প্রচেত গুপ্তর মতো বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরাও।
এই বিষয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য ভিনরাজ্যে বাংলাভাষীদের উপর অত্যাচার কখনই মেনে নেওয়া যায় না। তিনি বলেন “বাংলাভাষীদের উপর এই অত্যাচার মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের রাজ্যের খেটে খাওয়া মানুষ দু’টো অতিরিক্ত পয়সার জন্য যদি ভিনরাজ্যে যান, এবং তাঁদের যদি পুশব্যাক করা হয়, বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করা হয়, তবে সেটা ভীষণ দুঃখের। বিশেষ করে মুসলমান এবং বাংলাভাষী হলেই পুশব্যাক করার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটা খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। অন্য়ায় করা হচ্ছে। এর একটা প্রতিবিধান অবশ্যই হওয়া উচিত।” ঘুনপোকার স্রষ্টা আরও বলেন, “ওঁদের যদি বাংলাদেশে পাঠানো হয়, তাহলে বাংলাদেশ তো আবার ফেরত পাঠাবে। গরিব মানুষগুলো যাবেন কোথায়! এর একটা সমাধান দরকার। এই নিয়ে তো আন্দোলনও শুরু হয়েছে। আশা করছি তাতে করে গরিব মানুষগুলোর মঙ্গল হবে।”
সাম্প্রতিক সময়ে গোটা ভারতে জাতীয় শিক্ষা নীতির নামে যেভাবে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হলেন কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু। তিনি বলেন, “হিন্দির আগ্রাসন আমরা সহ্য করব না। আগেও বাংলা ভাষাকে প্রাথমিক শিক্ষায় বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। হিন্দি চাপালেও আমরা মানব কেন? দক্ষিণ ভারত লড়াই করছে, মারাঠা অষ্মিতার লড়াই করছে মহারাষ্ট্র। যোগাযোগের ভাষা হিসাবে ইংরেজিকে গ্রহণ করা যেতে পারে।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে নব ভাষা আন্দোলন অত্যন্ত জরুরি, মনে করছেন কবি সুবোধ সরকার। তিনি বলেন, “আজ একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাকে অপমান করার সর্বব্যাপী পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার এবং তাদের রাজনৈতিক দল। বাংলা বললে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা ইত্যাদি বলা হচ্ছে। হাস্যকর একটা ব্যাপার। এমনটা চলতে পারে না। আসলে এটা একটা ছলনা। আসলে এভাবে বাংলা ও বাঙালিকে অপমান করে তার অষ্মিতার উপরে আঘাত হানতে চাইছে ষড়যন্ত্রকারীরা। কারণ তাঁর জানেন বাংলা একটি অতি উন্নত ভাষা। এই ভাষা থেকেই নোবেল প্রাপ্তি, দেশের স্বাধীনতা এসেছে, নবজাগরণ হয়েছে। এমন বিরাট বাঙালি অষ্মিতাকেই ওরা সহ্য করতে পারছে না। তাই আক্রমণ করা হছে। এই অবস্থায় মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যে ভাষা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তা অত্যন্ত জরুরি।”
বাংলাভাষী মানুষকে অপমান মানতে পারছেন না সমকালের অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্তও। তিনি বলেন, “আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমাদের কাজের ভাষা। অন্নভাষা। সমস্ত ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে কোনও ভাষাকেই অসম্মান করা যায় বলে মনে করি না আমি। বাংলাভাষী মানুষকেও অসম্মান করা কোনওভাবেই মানতে পারছি না। সমস্ত ভাষাকে সম্মান করা উচিত আমাদের। ব্যক্তিগত ভাবে এটাই আমার মত।”
প্রসঙ্গত, সোমবার একুশের মঞ্চ থেকে বাঙালি হেনস্তা নিয়ে বিজেপিকে একহাত নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর যুক্তি, বাংলা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। নবজাগরণ হয়েছে এই বাংলা থেকেই। বাংলার মাটি দুর্বৃত্তদের হবে না কখনই। হুঙ্কার ছেড়ে মমতা বলেন, “বাংলার মানুষকে যদি বাংলা বলার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়, এই লড়াই কিন্তু দিল্লিতে হবে। আমি ছাড়ার লোক নেই।” সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কথা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। প্রতিবাদে সর্বস্তরে আন্দোলনে ডাক দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। জেলায় জেলায় মিটিং-মিছিলের পাশাপাশি নাগরিক সমাজকে কলকাতায় গান্ধী মূর্তির পাদদেশে ধরনায়ও আহ্বান জানান।