শুভাংশু শুক্লা মহাকাশ কেন্দ্র থেকে দেখছেন যে পৃথিবীকে, তার সঙ্গে ‘সীমান্ত’ ধারণার সম্পর্ক নেই। এর চেয়ে প্রাজ্ঞ মনোভাব আর হয় না!
‘সারা জীবনে সবচেয়ে বুদ্ধিমান বলে যে-লোকটিকে চিনেছি ও জেনেছি, সে কিন্তু লিখতে-পড়তে পারত না। ভোর চারটেয় সময়, যখন নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে তখনও সূর্যের আলো ফরাসি ভূখণ্ডে ঝঁাপিয়ে পড়েনি, সেই লোকটি ঘুম থেকে উঠে পড়ত, আর একপাল শুয়োর নিয়ে বেরিয়ে পড়ত চরাতে। এই শুয়োর প্রতিপালন করেই দিন চলত সস্ত্রীক লোকটির। খুব শীতের রাতে, তাপমান হিমাঙ্কের নিচের নামার উপক্রম ঘটলে, এই লোকটি ও তার স্ত্রী মিলে খেঁায়াড়ের ভিতর থেকে ছানা শুয়োরদের বের করে আনত ও আপন বিছানায় ঠঁাই দিত তাদের। কম্বলের আরাম এবং মানুষের শরীরের উত্তাপ পেয়ে ছানাগুলি সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যেত।
নেহাত দয়াপরবশ হয়ে তারা এমন করত না, যদিও তারা ছিল যথেষ্ট সহৃদয়। অমন করে না-বঁাচালে যে ছানাগুলি মরে যাবে সত্যি, আর সংসার চালানো দায় হবে।’ এইভাবে শুরু হয়েছে ১৯৯৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া পর্তুগিজ লেখক হোসে সারামাগোর নোবেল অভিভাষণ। ‘সবচেয়ে বুদ্ধিমান’ বলে যঁাকে সেখানে চিহ্নিত করেছেন, তিনি আসলে হোসে সারামাগোর মাতামহ। গরমের দিনে দাদুর সঙ্গে গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন গাছের তলায় শুতে যেতেন, আর দাদু তঁাকে নানারকম গল্প বলতেন– পূর্বপুরুষদের কথা, মৃত্যুর কথা, কিংবদন্তির কথা। গল্প করতে-করতে, গল্প শুনতে-শুনতে একসময় ছোট্ট হোসে ঘুমিয়ে পড়তেন। নির্মেঘ আকাশে তখন ছায়াপথ দৃশ্যমান, মনে হচ্ছে একটি সতেজ নদী আকাশরেখা ধরে ছুটে চলেছে।
জীবনের নিত্য-নৈমিত্তিক গেঁথে যে-ভুবনের ইশারা এখানে হোসে সারামাগো রেখেছেন, সেই পৃথিবীরই সন্তান আমরা, উত্তরপুরুষ। দিনে একবার সূর্যকে উঠতে দেখি, একবার দেখি অস্ত যেতে। পৃথিবীর দিন-রাত, মাস-বছর সব চলে সূর্যকে ঘিরে। কিন্তু শুভাংশু শুক্লা, স্পেস স্টেশনে থেকে জানিয়েছেন, দিনে ১৬ বার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখেছেন, আমাদের দেশ ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে। আর দূর থেকে যে-পৃথিবীকে দেখছেন তিনি, সেখানে ‘সীমান্ত’ বলে কোনও শব্দের ঠঁাই নেই। এই পৃথিবী যেন সকলের অবাধ ঘর।
দর্শনগতভাবে এর চেয়ে বহুমাত্রিক, এর মতো প্রাজ্ঞ মনোভাব আর হয় না। বিরোধ ও আগ্রাসন, যুদ্ধ ও হিংসায় যে-পৃথিবী আচ্ছন্ন এখন সবসময়, তা তো ‘সীমান্ত’ ধারণার জন্যই। সীমান্তের সঙ্গে নিরাপত্তা ও নিরাপত্তাহীনতা, স্বাধীনতা ও অধীনতা, দেশভক্তি ও দেশদ্রোহীর মতো বিপরীত অর্থবাচক শব্দ জুড়ে থাকে সর্বদা। দিন-দিন বিভেদের কারণ হয়ে উঠছে মানুষের সঙ্গে মানুষের তফাত প্রতিপন্ন করার প্রবণতাটি। প্রায় ভরশূন্য মহাকাশ কেন্দ্রে পেশির ক্ষয় নিয়ে গবেষণায় রত শুভাংশু যে এই ‘বাইনারি’ থেকে বেরিয়ে পৃথিবীকে ‘সীমান্তহীন’ ভাবতে পেরেছেন, তা সাধুবাদযোগ্য। হোসে সারামাগো লিখেছেন, ‘ইচ ডে আ লিটল বিট অফ হিস্ট্রি’। অর্থাৎ, অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের বৌদ্ধিক শুদ্ধতা যেমন সেই ইতিহাসের অংশ, তেমনই তাতে মিশে রয়েছে– দ্বন্দ্ব সম্পর্কের দূরত্ব অতিক্রম করার কথাও। আবিষ্কার করার মনটি চাই শুধু।