প্রকাশ্যে মদ্যপানের বিরোধিতা করে খুন হলেন স্থানীয় শিক্ষক। ‘স্বাধীন’ যাপনের নামে এই জাতীয় অনিয়ন্ত্রণই মদ্যপানকে করে তুলেছে ‘ট্যাবু’।
ট্রেনে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গেই ‘নায়ক’ অরিন্দমকে অ্যাটেনডেন্ট বলে দিলেন যে, তাঁর ‘ফেলো প্যাসেঞ্জার’ অঘোর চট্টোপাধ্যায়– যিনি সিনেমা বিষয়টাকেই পারলে ‘উচ্ছেদ করে দেন’। অঘোরবাবু তৎকালের বিশিষ্ট ইংরেজি পত্রিকায় লেখেন। কাজেই অরিন্দমের সাধ জাগে, তঁার সঙ্গে একবার সৌজন্য আলাপ সেরে যেতে। কথা বলে গেলেন অঘোরবাবুই প্রধানত। জানালেন, ‘বায়োস্কোপ’ তিনি পছন্দ করেন না। কেননা, তা জীবনের অনুশাসনের পরিপন্থী। এবং জানতে চাইলেন, অরিন্দমের কাছে, ‘আপনি কি মদ্যপান করেন? ট্রেনেও মদ্যপান করবেন?’
অরিন্দম বিনয় প্রদর্শন করে আমতা-আমতা করে বলে, ‘আজ্ঞে, সেকেন্ড নেচার কিনা।’ তখন অঘোরবাবু জানান, তঁার বয়স প্রায় আশি। অ্যালকোহলের গন্ধে বমিভাব জাগে। সহযাত্রীর থেকে ‘কনসিডারেশন’ আশা করেন– অর্থাৎ ট্রেনযাত্রাকালে যেন অরিন্দম মদ্যপান না-করে। তখন অরিন্দম জানায়, সে অন্য কুপে থাকছে। নেহাত নাম শুনে দেখা করতে এসেছিল।
এত বিখ্যাত এই দৃশ্য যে, বাঙালিকে মনে করিয়ে দিতে কুণ্ঠা জাগে– এটি সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ সিনেমার অন্তর্গত। ‘নায়ক’ অরিন্দম ‘ম্যাটিনি আইডল’। জনপ্রিয়তার শিখরে বসবাস। তায়, অবিবাহিত। কাজেই তার অনুরাগীর যেমন শেষ নেই– তেমনই তাকে ঘিরে গজিয়ে ওঠা গসিপ-ও অসংখ্য। চরিত্রনাশী অনেক বৈশিষ্ট্যই তার রয়েছে– এমন দাবি পাবলিক ডোমেনে বিরাজ করা সত্ত্বেও মেয়েরা ফুলের পানে ছুটে আসা পতঙ্গের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় অরিন্দমকে দেখলেই, এমনকী, নাম শুনলেও।
অরিন্দম মদ্যপান করে, লুকোছাপাহীন। মদ্যপান করার মধ্যে সে অনৈতিক অপরাধ খুঁজে পায় না। কিন্তু সমাজের একটি শিষ্ট অংশের কাছে– অঘোর চট্টোপাধ্যায় যার প্রতিনিধি– অরিন্দম মদ্যপান করার কারণেই পরিত্যাজ্য। যেন-বা কীটদষ্ট ফল। সিনে-জীবনের গ্ল্যামার-মাখা রোশনাইয়ের মুখ যদি হয় অরিন্দম, তবে তার বিপরীতে এমন একটি ঘোরতর নীতিবাগীশ মুখের দরকার ছিল বইকি– যারা সুভদ্র সমাজের অলিখিত আইনকানুনের প্রতিরক্ষায় মোতায়েন রয়েছেন। তবে কে সম্পূর্ণ ঠিক, কে অংশত ভুল– এই বিচার খণ্ড সময়ের কাজ নয়।
১৯৬৬ সালের মে মাসে ‘নায়ক’ মুক্তি পায়। আবার, সেই বছরের অক্টোবরে মুক্তি পাচ্ছে তপন সিন্হার ‘গল্প হলেও সত্যি’। সেখানে পরিবারের দশ-অনূর্ধ্ব শিশুটির উপস্থিতিতে বড়দা মদ্যপান করলে, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেজভাই, সে শিক্ষকও, দু’-কথা শোনাতে ছাড়ে না। মদ্যপান নিয়ে বাঙালির আমূল সংস্কার তৈরি হয়েছে মদ্যপানজনিত বাড়াবাড়ি কারণেই হয়তো-বা।
সালিশি সভা বসিয়ে মদ্যপকে ভ্রষ্ট বলে দেগে দেওয়াও এই নিয়ন্ত্রণহীনতার জন্য। সম্প্রতি, বেলঘরিয়ায় প্রকাশ্যে মদ্যপান করার প্রতিবাদ করে একজন স্থানীয় শিক্ষক খুন হয়েছেন। এ ঘটনা আবার প্রমাণ করল– কেন অরিন্দমের মতো ‘সুপারস্টার’ মদ্যপান করে ধিক্কৃত হয়, কেনই-বা অঘোর চট্টোপাধ্যায়কে হয়ে উঠতে হয় মদ্যপানের বিরুদ্ধে স্বঘোষিত শাসক!