ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট-যুদ্ধ নিয়ে ঝকঝকে সিরিজ, তবু ভরল না পাত্র! পড়ুন রিভিউ

ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট-যুদ্ধ নিয়ে ঝকঝকে সিরিজ, তবু ভরল না পাত্র! পড়ুন রিভিউ

সিনেমা/বিনোদন/থিয়েটার
Spread the love


বিশ্বদীপ দে: ‘শীতের দুপুরে দুই প্রতিবেশী’। সম্ভবত শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এই চমৎকার বইটি অনেকেই শৈশবে পড়েছেন। ভারত ও দেশভাগের পরে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া টেস্ট সিরিজগুলির (তখন ওডিআই জমানা শুরু হতে ঢের দেরি) কী অপরূপ বর্ণনা ছিল সেই বইয়ে! যেন সনাতনী টেস্ট ক্রিকেট, রোদমাখা সুন্দর দি‌ন, হাড়কাঁপানো হাওয়ায় ভেসে আসা লাল বলের জৌলুস টের পাওয়া যেত বইয়ের পাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে। নেটফ্লিক্সের নতুন ডকু-সিরিজ ‘দ্য গ্রেটেস্ট রাইভ্যালরি: ইন্ডিয়া ভার্সেস পাকিস্তান’ দেখতে দেখতে সেই বইটাকেই মনে পড়ছিল। শান্তিপ্রিয় খেলার রোমাঞ্চের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন পারিপার্শ্বিকতাকে। কিন্তু নতুন এই সিরিজে সেটাই যেন ঠিকমতো মিশল না। অথচ অনেক কিছুই উঠে এসেছে ইতিহাসের দাবি মেনে। তবু… একটা তবু রয়েই গেল।

প্রথমে যে কথা বলতেই হয় সেটা এর ‘বিভ্রান্তিকর’ নামকরণ। নাম শুনলে সকলেরই মনে হবে সেই ১৯৫২ সালের অক্টোবরে ভারত-পাকিস্তান প্রথম টেস্ট থেকে শুরু করে হাল আমল পর্যন্ত এশিয়ার ‘অ্যাসেজ’ বলে পরিচিত এই চির প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে নিক্তিতে মেপে দেখানো হবে। কিন্তু কোথায় কী! মূলত ২০০৪ সালের ‘ফ্রেন্ডশিপ’ সিরিজই এই ডকু-সিরিজের প্রাণভোমরা। তাকে ‘জ্যান্ত’ করতে কখনও ১৯৮৬ সালের অস্ট্রেলেশিয়া কাপের ফাইনালে জাভেদ মিঁয়াদাদের শেষ বলে ছক্কা কিংবা ১৯৯৯ সালের ইডেনে শোয়েব আখতারের আগুনে পেসে পরপর দুই বলে রাহুল দ্রাবিড় ও শচীন তেণ্ডুলকরের স্টাম্প হাওয়ায় উড়ে যাওয়া দেখানো হল বটে। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এক অতি বিখ্যাত রম্যরচনার শিরোনাম ধার করে বলাই যায় ‘অতি অল্প হইল’।

Iceland Cricket's dig at ICC over India vs Pakistan clash in T20 World Cup
রক্তের গতি বাড়িয়ে দেয় ভারত-পাক ম্যাচ। ফাইল চিত্র

ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেট-লড়াই বহুমাত্রিক। লড়াইয়ের ব্যাটনও সেভাবে একপক্ষের হাতেই থেকে যায়নি। বিশ্বকাপে বারবার পাকিস্তান হারলেও হেড-টু-হেডে পাকিস্তান এগিয়ে থেকেছে। বলা হয় মিঁয়াদাদের সেই ছক্কার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ম্যাচে সব সময়ই পাকিস্তান আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে চলতে থাকে। এর মাঝেই বিশ্বকাপে খেলাগুলি বাদ দিলে অন্য ম্যাচে পাকিস্তান অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠত। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সেই ব্যাটনটাই ধীরে ধীরে ভারতের হাতে চলে যায়। যা আজও রয়েছে। এই বিষয়টাকে ডকু-সিরিজে পরিষ্কার বোঝানো হয়নি। আসলে এই সিরিজটি মূলত যে প্রশ্নটি তুলতে চেয়েছে তা হল ক্রিকেট খেলে কি দুই দেশের মধ্যেকার টেনশনটা কমানো সম্ভব? যে চেষ্টা ২০০৪ সালের ওই সিরিজে হয়েছি‌ল। শিগগির শুরু হতে চলা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তানের ভারতের না খেলা নিয়ে যে প্রশ্ন ফের উঠতে শুরু করেছি‌ল। সেদিক দিয়ে দেখলে একেবারে যথাযথ সময়েই এই ডকু-সিরিজটি মুক্তি পেল।

মাত্র তিনটি পর্বে ‘দ্য গ্রেটেস্ট রাইভ্যালরি: ইন্ডিয়া ভার্সেস পাকিস্তান’কে সাজানো হয়েছে। ২০০৪ সালের সিরিজটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন নির্মাতারা। সিরিজ প্রসঙ্গে শোয়েব আখতার, বীরেন্দ্র শেহওয়াগের টিপ্পনী নিঃসন্দেহে উপভোগ্য। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও অনেক কথা বলেছেন। গাভাসকার, মিঁয়াদাদ, ইনজামামরাও। কিন্তু নতুন কোনও ‘গল্প’ কি পাওয়া গেল? অন্তত ৮০-৯০-এর জাতকদের কাছে তা মনে হবে না। সবই কমবেশি আগে থেকেই জানা। সে বাইশ গজই হোক বা তার বাইরের আখ্যান। আর নতুন প্রজন্ম যখন এই সিরিজ দেখবে, তাদের কাছে সেই সময়ের বিপুল আবেগের ঘনত্ব কতটা প্রস্ফূটিত হবে সন্দেহ থেকে যায়। দুই প্রতিবেশীর রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনাময় আবহকে ক্রিকেট দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে সিরিজের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ফ্রেন্ডশিপ সিরিজ’। টেস্ট ও ওয়ানডে (তখন টি২০ কোথায়?) দুই সিরিজই ভারত পকেটে পুরেছিল। কিন্তু ‘হৃদয়’ জিতেছিল পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। ভারতীয় খেলোয়াড়রাই কেবল নয়, এই সিরিজ উপলক্ষে যে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সেদেশে গিয়েছিলেন তাঁরাও পেয়েছিলেন অপরিমেয় আতিথেয়তা। তবু এই বিষয় নিয়েই প্রশ্ন তোলেন গাভাসকার, আদৌ কি দু’দেশের টেনশন ক্রিকেট দিয়ে কমানো সম্ভব? ২০০৪ যে প্রশ্ন তুলেছিল, দীর্ঘ কুড়ি বছর পেরিয়ে এসে উত্তরটা ‘না’ বলেই যেন মনে হয়। কেননা দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রিকেট যতই শক্তিশালী হোক, ভারত-পাকিস্তান বৈরিতাকে প্রশমিত সেও করতে পারেনি। ২০০৮ সালের মুম্বই হামলায় কাসভরা যে বিষ ঢেলে দিয়েছিল তা সব আশায় জল ঢেলে দেয়। এই দিকটি সিরিজে ভালোভাবেই উত্থাপিত হয়েছে। কিন্তু নতুন কোনও দিক তুলে ধরতে সক্ষম হয়নি। কোনও ডকু-সিরিজ যখন কেবলই চেনা ঘটনা অথবা বহু আলোচিত প্রসঙ্গের বাইরে যেতে পারে না, তখন দর্শকের মনের তৃষ্ণা পুরোপুরি মেটে না।

তাছাড়া ক্রিকেটীয় দিক দিয়ে দেখলেও অনেক কিছুই খাপছাড়া থেকে যায়। কোনও কোনও মুহূর্ত দেখতে দেখতে আপনি টাইম মেশিনে চড়ে বসবেন ঠিকই। আবেগ আর ক্রিকেটের ম্যাজিক সেখানে একেবারে খাপে খাপে এঁটে যায়। তবু সেই আবেগের যাত্রা খাপছাড়া থেকে যায়। সেটা বজায় রাখতে আরেকটু পরিকল্পনা দরকার ছিল চিত্রনাট্য়ে। বিরাট কোহলির পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইনিংসটি নিয়ে আলোচনা থাকতে পারত। অবশ্যই থাকা উচিত ছিল শোয়েবের ইয়র্কারে বোল্ড হওয়ার বদলা শচীন কীভাবে সেঞ্চুরিয়নে নিয়েছিলেন সেই প্রসঙ্গও। মিঁয়াদাদের ছক্কা এল, কিন্তু জীবনের শেষ টেস্টে ব্যাঙ্গালোর টেস্টে গাভাসকারের অসামান্য ম্যাচ বাঁচানো ইনিংসের কথা এল না! কিংবা ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়াকারের বলে অজয় জাদেজার সেই ব্যাটিং! তাছাড়া ভারত-পাকিস্তানের খেলার ইতিহাসটা অল্প সময়ে একবার বলে নেওয়া যেতে পারত। তবেই প্রেক্ষাপটটা আরও জমজমাট হত। তাছাড়া ২০০৪ সিরিজ সম্পর্কেও বলা যায়, প্রথম ওয়ানডেতে শেহওয়াগের ৭৯-কে দারুণ ভাবে দেখানো হল। অথচ সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে শচীনের অনবদ্য ১৪১ রানে ইনিংসটির কথা বলাই হল না! শচীন সিরিজের জন্য ‘বাইট’ দেননি, শেহওয়াগ দিয়েছেন বলে কি…? নতুন সহস্রাব্দের শুরুর সেই সময়ে সৌরভের নেতৃত্বে যেভাবে ভারতীয় ক্রিকেট দল ‘টিম ইন্ডিয়া’ হয়ে উঠেছিল তা বুঝতে গেলে শচীনের মহীরুহসম উপস্থিতিকে আরও সুচারুভাবে উপস্থাপিত করা দরকার ছিল। আর এই সমস্ত কারণেই সেই সময় যাঁরা নিতান্তই কিশোর বা তরুণ, তাঁরা আজ এই সিরিজ দেখতে বসে বুঝতে পারবেন, সবই আছে তবু কী যেন নেই! মালা গাঁথতে যত ফুল লাগে, তার থেকে কম নিলে সুতোর শীর্ণতা দেখা যায় যে! আর জেন জেডের কথা তো ছেড়েই দিলাম। টি২০ নিয়ে এই প্রবল হইহইয়ের যুগে দু’দশক আগের সময়টার ‘পালস’ কি তারা আদৌ ধরতে পারবে? প্রশ্ন থেকে যায়। তাই চমৎকার সম্পাদনা, তরতরে গতি সত্ত্বেও ‘দ্য গ্রেটেস্ট রাইভ্যালরি…’ ক্রিকেট রোম্যান্টিকের হাতে ধরা পাত্রকে পূর্ণ করতে পারে না। ‘চিয়ার্স’ বলে উঠতে গিয়েও থমকে যায় ঠোঁট।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ






Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *