ভারতে জাতীয় ফলের নাম রেজাল্ট

ভারতে জাতীয় ফলের নাম রেজাল্ট

শিক্ষা
Spread the love


ভারত—কোটি কোটি মানুষের দেশ, লক্ষ লক্ষ হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ডের দেশ, আমাদের দেশে ভাষা, সংস্কৃতি এবং আইপিএল টিমের প্রতি আনুগত্যে ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু একটি জিনিসে আমরা সবাই এক- আমরা ফলাফলের উপর অন্ধ বিশ্বাস রাখি। ধর্মের চেয়েও বেশি। এই দেশে কর্মবিশ্বাসী হও বলে কেউ জন্মায় না, জন্মেই বলে ফল কই।

এদেশে ভোটের ফলাফল নিয়ে প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে সাত মাস কথা বন্ধ হয়ে যায়। পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে বাড়িতে স্বামী–স্ত্রীর কলহ লেগে যায়। চিকিৎসক অসুখ বোঝার আগেই রক্ত, মূত্র কিংবা ধাতুর ফলাফল জেনে নিতে চান। প্রেমের প্রস্তাবের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে আঠারোর ভবিষ্যৎ। ফুলসজ্জার রাতের ফলাফল থেকে বিবাহবিচ্ছেদের ফলাফল, কর্পোরেশনের পানীয় জল পানযোগ্য কি না সেই ফলাফল। বিরিয়ানির মাংসের টুকরো কতটা খাওয়ার উপযুক্ত সেই নমুনার ফলাফলের অপেক্ষায় থাকতে হয়। সব কিছুতেই ফলের অপেক্ষায় জেগে থাকা শুধু। নতুন ভারতে জাতীয় ফলের নাম রেজাল্ট। আমরা সবাই যেন একটা বিশাল থিয়েটারে বসে আছি, ঠিক যেমন স্যামুয়েল বেকেট-এর ওয়েটিং ফর গডো— অপেক্ষা করছি, আশা করছি, আর সান্ত্বনা দিচ্ছি নিজেকে ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ বলে।

জন্মের আগেই আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট-এর খেলা শুরু হয়ে যায়। নেহাত আইন আছে।  তাই খেলাটা অত্যাচারে বদলে যায়নি। ভূমিষ্ঠ না হওয়া শিশুর জন্য ইতিমধ্যেই কোচিং সেন্টারের লিফলেট জমাতে শুরু করেছেন পিতা-মাতা। এই তো আর কিছুদিন পরেই নচিকেতার গান বেজে উঠবে, ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার’। এখনও যে শিশু পেন্সিলই ধরতে শিখল না। তার এক এক করে আঁকার ক্লাস বন্ধ, নাচের ক্লাস বন্ধ, গানের কণ্ঠ রোধ করে কোন অলীক এক ফলাফলের অপেক্ষায় সার্কাসের রিং মাস্টার হয়ে ওঠে মা-বাবারা তবুও বলছে ‘এত কিছু করছি তোর জন্য, আর এই হচ্ছে রেজাল্ট।’

দুই বছর বয়সেই শিশুকে পাঠানো হচ্ছে স্কুলে, যেখানে ‘ইন্টারন্যাশনাল’ শব্দটা স্কুলের নামেই থাকে, কিন্তু টিচারদের উচ্চারণে লেবু লজেন্সের গন্ধ। দেখতে দেখতে জীবনের সবচেয়ে বড় ফলাফলের বাজারে এসে পড়ে সেই লাখো লাখো দুধের শিশু। সদ্য গোঁফ আর লালপাড় শাড়ি কিংবা শর্ট স্কার্টের হাঁটু ছুঁয়ে উঁকি দিতে থাকে বোর্ড পরীক্ষা- সরি, জাতীয় কুস্তি প্রতিযোগিতা। এখানে স্টুডেন্ট নয়, রোবট তৈরি হয়। কোচিং সেন্টারগুলো হয়ে ওঠে তাদের ‘আশ্রম’। এছাড়া সেরা ফলাফলের বাজারে প্রকাশনীগুলোই তখন প্রকাণ্ড এক ছায়া। বাড়িতে তখন সংকটকালীন অবস্থা : টিভি বন্ধ। মোবাইল সাইলেন্ট। গা ছমছম, কী হয় কী হয়… ‘ভগবান বাবুর রেজাল্ট ভালো করিয়ে দাও। পল্টুর ছেলের থেকে যেন কম নম্বর না পায়।’ ছেলে ওদিকে ঝিনটির সঙ্গে প্রথম চুমুর ফল ভাগ করে খাচ্ছে টিউশনের আড়ালে। তবে পরীক্ষার থেকেও ভয়ংকর দিন হল রেজাল্ট প্রকাশের দিন। জেলায় জেলায় একসঙ্গে গুগল সার্চ চলছে : এরপর সেই বহু প্রতীক্ষিত ফলাফল : ৯৫% পেলেও শুনতে হবে ‘দেখ পল্টুর ছেলে তো ৯৭% পেয়েছে, আর তুই মোবাইল মোবাইল করে শেষ হয়ে গেলি।’

আর যারা কোনও রকমে পাশ করে বা ফেল, তাদের ভবিষ্যতের ফলাফল তো হাতে রেজাল্ট পেয়েই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। আর হ্যাঁ, নিউজ চ্যানেলে টপারদের ইন্টারভিউ তো থাকবেই। “আমি ৪টায় উঠি, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করি না, দিনে ১০ ঘণ্টা পড়ি।” তারপর? মা-বাবারা ওয়াইফাই কেটে দেন, নেটফ্লিক্স অ্যাকাউন্ট ডিলিট করেন।

কিন্তু ফলের যে শেষ নেই প্রভু। প্রবেশিকা পরীক্ষার আড়ালে জাতীয় স্তরের কুমিররা লুকিয়ে থাকে জলে। মুখ হা। স্থির। জেইই–নিট–ক্যাট ইঁদুর দৌড়ে অংশ নিতে হবে। কে হবে সেরার সেরা ইঁদুর। জীবনানন্দ কি এদের জন্যেই লিখে গেছিলেন ধরা যাক কয়েকটা ইঁদুর এবার… এখান পর্যন্ত এসে ছাত্র আর ছাত্র থাকে না। সব আত্মত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে ওঠে। বইয়ের সঙ্গে প্রেম, সোশ্যাল লাইফের সঙ্গে বিচ্ছেদ, আর কোচিং ইনস্টিটিউটের বাইরের চা-ওয়ালাই তখন একমাত্র আত্মীয়। কাকা। সঙ্গে মোটা চশমায় ঝাপসা জীবন।

রেজাল্ট ব্যবস্থাই নতুন ভারতে নতুন জাতব্যবস্থা। আগের মতো ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় নয়, এখন : আইআইটি/আইআইএম হল আধুনিক ব্রাহ্মণ। সিএ বা আইএএস– রাজ পরিবার। চিকিৎসক উচ্চশ্রেণির মানুষ। কমার্স বণিক শ্রেণি। আর্টসের ছেলেমেয়েদের ঠিক শূদ্রের মতো ভাবা হয়। কবিও বলা যেতে পারে যদি বাংলা নিয়ে পড়ে। তাই রেজাল্ট মানেই সমাজে মর্যাদা, আত্মীয়দের দৃষ্টিতে সম্মান, আর বাবা-মায়ের হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাসে জ্বলজ্বল করে ওঠা নাম। আমার বাবু।

কিন্তু খেলা এখানেই শেষ নয় মশাই। সামনেই কর্মজীবনের রেজাল্ট- শেষ নাই এই দৌড়ের। কলেজ শেষ? ভেবেছিলে রেহাই পেলে? না ভাই। এইবার শুরু হল চাকরি থেকে স্যালারি প্যাকেজ প্রতিযোগিতা। বছরে ১২ লাখ? ভালো, কিন্তু পল্টুর ছেলে তো গুগলে ঢুকেছে।

এরপর আসে জীবনের আসল মহাপরীক্ষা। যে পরীক্ষায় বেশির ভাগ মানুষ ডাহা ফেল করে। শুভপরিণয়। কিন্তু পরিণয় শুভ হল নাকি তার ফলাফল পেতে একটা জীবন চলে যায়। তবুও বিয়ের আগে শুনতে হবেই কনে কত নম্বর পেয়ে পাশ করেছে? এই বাজারে বৌ পেতে হলে পুরুষদেরও মিনিমাম স্কোর দরকার— আইআইটি + ইউএস + ৬’, নিজের ফ্ল্যাট। নেতা-মন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীর ডান হাত হলে যদিও রেহাই পাওয়া যায়। কিন্তু দই-পান্তা পছন্দ হলে ফলাফল শূন্য।

কিন্তু এত কিছুর পরেও গডো আসবে না-  তবু অপেক্ষা থাকবে। সামুয়েল বেকেট-এর নাটক ওয়েটিং ফর গডো-তে যেমন গডো কোনওদিন আসে না, তেমনই আমাদের জীবনের সেই ‘আসল রেজাল্ট বা ফলাফলও অনেক সময় আসে না। আমরা সবসময় ভাবি— এবার যদি রেজাল্টটা কিংবা ফল ভালো হয়, তাহলে আমি সুখী হব।’  কিন্তু তারপরেই আরেকটা রেজাল্টের অপেক্ষা শুরু হয়। আরও আরও পল্টু এসে ঢুকে পড়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষার মাথায়।

এভাবেই আমরা সারাজীবন একটা প্রমোশনের জন্য, একটা ভালো সম্পর্কের জন্য, একটা সন্তুষ্ট জীবনের ফলের অপেক্ষা করি। ফকিরের তাবিজ তবু কাজ করে না। শুধু পরীক্ষার আগে কুল খেয়েছে বলে বাংলায় আজও এত ছেলেমেয়ে বেকার। সিপিএম, তৃণমূল একাই দায়ী নয়। এই যেমন এসএসসি’র ফলেও জল মিশে গেছে এখন। বিকাশবাবু বিকাশ ভবনের বাইরে কোর্টের রায়ের ফলের ঝুড়ি নিয়ে ঘুরছেন হয়তো। কিংবা মসজিদের নীচে শিব শুয়ে আছে কিনা তার ফলাফল জানার জন্য বসে আছে একটি বিশেষ দল, শুধু ফলের আশা আর ফল। একটা রেজাল্টই সব ঠিক করে দিতে পারে কি? আসল রেজাল্ট হচ্ছে : নিজেকে মেনে নেওয়া, নিজের পথ খুঁজে নেওয়া, আর আত্মীয়দের বলার সাহস থাকা : কর্ম করে যেতে চাই ফলের আশা করি না।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *