রূপায়ণ ভট্টাচার্য
মাননীয় জাতীয় প্রেসিডেন্ট শ্রী জেপি নাড্ডাজি আমাকে ফোন করেছিলেন। বলেছেন, ট্রাম্প এবং টিম কুক সংক্রান্ত টুইটটি ডিলিট করে দিতে। আমার অত্যন্ত ব্যক্তিগত ধারণা পোস্ট করার জন্য আমি দুঃখিত। নির্দেশ মতো টুইটের পাশাপাশি ইন্সটাগ্রাম থেকেও ডিলিট করে দিলাম।
অহো, কী অদ্ভুত কৌতুক! কথাগুলো কঙ্গনা রানাওয়াতের। অবশেষে তিনি নিজের কোনও মন্তব্যে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। ‘জাতীয় প্রেসিডেন্ট’ নিশ্চয়ই মধুর কিছু বলেননি সিনেমার ‘ইন্দিরা গান্ধি’কে।
অ্যাপল কর্তা টিম কুককে ভারত থেকে পাততাড়ি গোটানোর কথা বলায় ট্রাম্পের ওপর ক্ষুব্ধ মোদি-ভক্তরা। আমেরিকার হিউস্টনে কতদিন আগে ট্রাম্পকে ‘ফ্রেন্ডলি’, ‘ওয়ার্ম’, ‘এনার্জেটিক’ বলে পরিচিতিই শেষ করছিলেন না মোদি। তখন বলেছিলেন, ‘আব কি বার, ট্রাম্প সরকার’। অবশেষে তার এই প্রতিদান? পাকিস্তানকে মোটা অর্থ, বাংলাদেশকে মোটা অর্থ।
কঙ্গনা যে বিতর্কিত টুইটটি রিপোস্ট করেছিলেন, তার প্রতিটি লাইনে মোদি ও ট্রাম্পের তুলনা। প্রতি শব্দবন্ধে ট্রাম্পকে মাটিতে ফেলে মোদিকে আকাশে তোলার প্রবণতা। শেষে গিয়ে মন্তব্য ছিল, ‘ট্রাম্প আলফা মেল হতে পারেন, কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী সব আলফা মেল কা বাপ। এটা কি ব্যক্তিগত ঈর্ষা, না ডিপ্লোমেটিক ইনসিকিউরিটি?’
কঙ্গনা বলিউড স্টার বলেই হয়তো বিজেপি তাঁকে শোকজের পথে হাঁটেনি। শুধু ফোনে ভর্ৎসনার ওপরেই ছেড়ে দিয়েছে।
দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যে কঙ্গনা কার্যত তুলনাহীন বলিউডে। সেই জনপ্রিয় সূত্রটি ধরে ফেলেছেন তিনি। যত বিতর্ক, তত প্রচার। তবে এখন কঙ্গনাই একা নন। কঙ্গনা হিসেব কষে বিতর্ক বাধাতে যান। অনেকে ভালো করে না বুঝেই।
এই যেমন সলমন খান। বেশি টুইট করা তাঁর ধাতে নেই। ভারত-পাক হামলার সময় পর্যন্ত একটা টুইট করেননি। হঠাৎ যুদ্ধবিরতি ঘোষণার দিন লিখে ফেললেন, ‘থ্যাংক গড, ফর সিজফায়ার।’ আপাতদৃষ্টিতে এই লাইনে বিতর্ক কিছু নেই। আবার একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, কতটা বিতর্কের জন্ম দিতে পারে লাইনটা। সলমন টুইটটা ডিলিট করলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই, তবে ততক্ষণে ওই লাইন ভাইরাল।
কঙ্গনার মতো সাংসদ নন সলমন। তাঁর কোনও ‘জাতীয় প্রেসিডেন্ট’ নেই। ভুল স্বীকারের দায়ও নেই। তিনি দিব্যি দ্রুত ডিলিট করে উধাও হয়ে গেলেন।
এভাবে বহু সেলেবের সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট ডিলিট করা এখন নিত্যনৈমিত্তিক। কেউ ভালো করে না ভেবেই যা খুশি লিখে দিচ্ছেন। কেউ তথ্য বা ছবি যাচাই না করেই ফেক নিউজ বা ছবি দিয়ে দিচ্ছেন। দেশ, বিদেশ, রাজ্য সব একাকার।
জাস্টিন বিবের যে জাস্টিন বিবের, তিনি ইনস্টায় গাজা স্ট্রিপের ছবি পোস্ট করে লিখলেন, ‘প্রেয়িং ফর ইজরায়েল।’ বিতর্ক শুরু। এবং বিবেরের সঙ্গে সঙ্গে তা ডিলিট। কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই। রিহানা একবার অস্ট্রেলিয়ার বনে আগুন লাগার ফেক ছবি দিয়েছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়।
শৈশবে বাংলায় ভাব সম্প্রসারণ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের সবারই। যে বাক্যটি প্রায়ই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে হানা দিত, সেটা হল, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। প্রত্যেককেই কোনও না কোনও ক্লাসে পরীক্ষায় এটার বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে।
এখনও হয়তো পড়ানো হয় সেটা। পরীক্ষাতেও আসে। কতরকম স্টাইলে কতরকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে সেই সাধারণ অথচ গভীর বাক্যের।
কী লিখতে চেয়েছি আমরা? কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শান্ত ও অবিচল থাকা উচিত। ভাবতে হবে আগাপাশতলা। ঋত্বিক ঘটকের ছবির বিখ্যাত সংলাপের মতো। ‘ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।’ অনেক যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো করে ভালো খারাপ দুটো দিক ভেবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, কী করব আসলে। কী লিখব। কী বলব।
এই ভাবনা কমে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত মন্তব্য করে লাইক কুড়োনোর লোভে। আমি তো সবার আগে খবরটা দিয়েছি! সবাই টিভির ঢংয়ে ব্রেকিং নিউজ করতে চান! বহু অসাংবাদিক মানুষও লেখেন, ব্রেকিং নিউজ। আরে ভাই, ব্রেকিং নিউজ কী করে হয়? এ তো আপনি লিখছেন, কোনও টুইট বা ফেসবুক পোস্ট বা ওয়েব বা টিভি দেখে!
ওল্ড স্কুল অফ জার্নালিজম শিখিয়েছে, একটা ছোট খবর হলেও রি-চেক করো, রি-চেক করো। তারপর ছাপাও বা বলো। সাংবাদিকরা এটা মানতেন। বিশিষ্ট মানুষরাও। এখন ওসব পাট চুকেবুকে গিয়েছে একেবারে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কৌতুকহাস্য’ প্রবন্ধে এক চরিত্রের মুখ দিয়ে যে কথাটা লিখেছিলেন, আজকের প্রেক্ষাপটে তা মিলে যায়। ‘আমি প্রমাণ করিতে যাইতেছিলাম যে, কমেডিতে পরের অল্প পীড়া দেখিয়া আমরা হাসি এবং ট্র্যাজেডিতে পরের অধিক পীড়া দেখিয়া আমরা কাঁদি।’
ভারতের বাজারে টিম কুকের অ্যাপলের দাম বাড়বে, না কমবে, সেটা পরের ব্যাপার। তবে এটা নিশ্চিত, কঙ্গনার কমেডিতে অল্প পীড়া দেখে লোকে হাসছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এরকম পোস্ট কার্যত ফেক নিউজ তৈরিরই শামিল। তারকাদের প্রত্যেকেরই সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডল করার জন্য আলাদা টিম থাকে। তা সত্ত্বেও এমন মারাত্মক অবিবেচক কাজ কেন দেখি যে?
ক্রিকেটার রোহিত শর্মার স্ত্রী রীতিকা ইনস্টায় দিনকয়েক আগে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধ নিয়ে হঠাৎ লিখেছিলেন, ‘সব চোখ রাফার দিকে’। অতঃপর ট্রোলিংয়ের ঢেউ এবং পোস্ট ডিলিট। কোনও দরকার ছিল? শাহরুখ খানের স্ত্রী গৌরী এর আগে যে পোস্ট করেছিলেন, তাতে নগ্নতার পক্ষে প্রচারের অভিযোগ ওঠে প্রবলভাবে। গৌরী টুইট মুছতে বাধ্য হন। ঠিক যেভাবে শাহরুখ-গৌরীর কন্যা সুহানা ছবি পোস্ট করে আবার মুছে দেন। কারণ সেই এক- ভাবিয়া করেননি কাজ।
অন্যদের কথা কী বলব? সুবিবেচক, যুক্তিবাদী বলে পরিচিত অমিতাভ বচ্চন কোভিডের সময় একবার লিখলেন, ‘অমাবস্যা। মাসের অন্ধকারতম দিন। ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়ার মতো অশুভ শক্তির সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা এই সময়। হাততালি আর শঙ্খনাদ ভাইরাসের শক্তি কমিয়ে দেবে, ধ্বংস করবে। চাঁদের যাত্রা হবে রেবতী নক্ষত্রর পাশ দিয়ে। সম্মিলিত আওয়াজে রক্ত চলাচল বেড়ে যাবে।’ সেই টুইট নিয়ে বিজ্ঞান সচেতন বহু মানুষ এমন হইচই করলেন, মুছে দিতে হল বচ্চনকে। অন্যবার তিনি যা লিখলেন, তার মর্মার্থ, হোমিওপ্যাথিই করোনা সারাতে পারে। সেবারও ট্রোলের বন্যা।
মনে পড়ছে, ওই সময় রজনীকান্ত লিখেছিলেন, ১০-১২ ঘণ্টা বাড়িতে থাকলে করোনা পালাবে। টুইটার পোস্টটিই তুলে দেয়। সোনু নিগমের মন্তব্যও ছিল হাসির খোরাক। জনতা কার্ফিউ হলে নাকি ১২ ঘণ্টাতেই করোনা শেষ হয়ে যাবে। দেশের মেগাস্টাররাই যদি অতিমারির সময় এমন অবৈজ্ঞানিক কথা ছড়িয়ে চলেন, তা হলে সাধারণ মানুষ হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির পড়ুয়া হবেন না কেন?
আমাদের রাজনৈতিক পার্টিগুলো তো আরও লক্ষ মাইল এগিয়ে থাকবে। বিজেপি এবং কংগ্রেসের অনেক মুখপাত্রই বহুবার দলকে ডুবিয়েছেন ভুল তথ্য দিয়ে। শব্দের অপব্যবহার করে। পরে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। টিভির কলতলার ঝগড়ায় মিথ্যে বৃষ্টির কথায় যাচ্ছি না। জাতীয় মুখপাত্ররা যা করেন, তাতে অনেকেরই মাথা কাটা যেত লজ্জায়। ওঁদের লজ্জা নেই। রি-চেক শব্দও ওঁদের অভিধানে নেই।
পদ্মের অমিত মালব্য অন্তত ১৬ বার ভুল তথ্য দিয়েছেন বলে ফেক নিউজ ফাউন্ডেশনের তথ্য। সম্বিত পাত্র কংগ্রেসকে আক্রমণ করতে গিয়ে এমন টুলকিটের কথা বলেন, যা ভুয়ো তথ্য। টুইটার ওই টুইটকে ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া ঘোষণা করে। নয়াদিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্ত সম্প্রতি ১১ বছর আগের টুইটগুলো ডিলিট করেছেন। সেখানে মুসলিম এবং বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে যা খুশি তাই লিখেছিলেন।
কংগ্রেসের মুখপাত্ররাও এক পথের পথিক। অথচ তাদের সুপ্রিয়া শ্রীনাটে এক সাংবাদিক। সম্প্রতি মোদিকে নিয়ে ‘গায়েব’ শব্দ পোস্ট করে কড়া সমালোচনার মুখে পড়েন কংগ্রেস নেতারা। বাধ্য হন সেটা মুছে দিতে। কর্ণাটক কংগ্রেস তো এ জন্য কুখ্যাত। এত বড় মিডিয়া সেল এঁদের, এত তরুণ-তরুণী চাকরি করেন সেখানে, তবু কেন রি-চেকের বালাই নেই?
এবং আমাদের বাংলায় সব পার্টিতেই এমন পরিচিত নেতা খুব কম, যাঁরা ভুল তথ্য ছড়ান না। এখানে এখনও স্থানীয় নেতাদের পছন্দ বেশি ফেসবুক। সেখানেও অনেক ভুল বা বিতর্কিত তথ্য লিখে কলকাতার নেতাদের কাছে ধমক খেয়েছেন উত্তরবঙ্গের অনেক নেতা। তুলে নিয়েছেন। আবার অন্য বিতর্কিত পোস্ট। আবার ধমক। আবার মুছে দেওয়া। তোর্ষা-তিস্তা-মহানন্দার জলধারার মতো।
মিথ্যে নিয়ে অতীতে কতরকম সতর্কবার্তা দিয়ে গিয়েছেন মনীষীরা। হৃদয়ে গেঁথে থাকে বহুদিন।
আমরা মিথ্যে বলি, যখন আমরা ভীত হয়ে পড়েছি। প্রত্যেকটা মিথ্যে হচ্ছে আসলে দুটো, একটা অন্যদের বলি, আর একটা নিজেকে বলি মিথ্যে জাস্টিফাই করতে। অর্ধসত্যই কখনো-কখনো হয়ে ওঠে বড় ধরনের মিথ্যে।
কঙ্গনা থেকে সলমন, সম্বিত থেকে সুপ্রিয়াদের কি ছোটবেলায় স্কুলে সেই পরিচিত বাক্যটির ভাব সম্প্রসারণ করতে হয়নি কোনওদিন?