ভোটমুখী ভাতার প্রতিযোগিতা এখন আঞ্চলিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বভারতীয় হয়ে উঠেছে। শুরু হয়েছিল দক্ষিণের অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাডু থেকে। এখন দেশের প্রায় সব প্রান্তে সব দল নানা ভাতা বা ছাড়কে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি করে তুলেছে। মহারাষ্ট্র ও দিল্লি বিধানসভা অথবা গত বছরের লোকসভা নির্বাচন- প্রতিটি ক্ষেত্রে এই ভোটমুখী ভাতা ভোটের প্রচারে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে।
এটা রাজনৈতিক দলগুলিকে তাৎক্ষণিক সুবিধে দিলেও দীর্ঘমেয়াদে ভারতীয় অর্থনীতির বিপুল ক্ষতি করছে। সব রাজনৈতিক দলই এখন ভাতা দিতে দরাজহস্ত। নানারকম ভাতা। বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরাসরি অর্থ জমা করা থেকে শুরু করে নিঃখরচায় বিদ্যুতের জোগান, ঋণ মকুবের মতো ভূরিভূরি প্রতিশ্রুতি।
যথাযথ আর্থিক উন্নয়নের আশ্বাসের বদলে আঞ্চলিক দলগুলির পাশাপাশি জাতীয় দলগুলি ভোটারদের চটজলদি কিছু সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার মনোরঞ্জন প্রকল্পে মনোনিবেশ করেছে। বছর তিনেক আগে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমন পাইয়ে দেওয়ার তীব্র বিরোধী ছিলেন। তাঁর ভাষায় এটা ছিল ‘রেউরি সংস্কৃতি।’ কিন্তু ওই ঘোষণার এক বছরের মধ্যে তাঁর দল বিজেপি সরাসরি অর্থসাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০২২-এর উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনেই তা স্পষ্ট হয়।
এমন পাইয়ে দেওয়া ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে সুখকর নয়, তা রাজনৈতিক দলগুলি বোঝে। কিন্তু শুধু ভোটের তাগিদে এই চমকের রাজনীতিতে সব দল গা ভাসাচ্ছে। অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাডু, পঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি রাজ্যগুলিতে রাজস্ব ঘাটতি এখন ভয়াবহ। নীতি আয়োগের ফিসকাল হেলথ ইনডেস্ক অনুযায়ী, গত এক দশকে ওই চার রাজ্যে দরাজ ভোটমুখী ভাতা দেওয়ার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় অর্থনীতিতে।
দলগুলি যুক্তি দেয়, এটা মানুষের চাহিদা। সরাসরি অর্থসাহায্য করলে গরিবের উপকার হয়। বাস্তবে এই বক্তব্য অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও মূল্যায়নহীন ভাতা বহুক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মানুষের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসে না। এখানে বাজার অর্থনীতির বিশেষ ভূমিকা আছে। বিনা খরচে পরিষেবা দেওয়া হলে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে চাহিদা ও জোগানে। ফলে বেসরকারি সংস্থাগুলি বিনিয়োগে আগ্রহ হারায়।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি বিনিয়োগ এজন্য কমতে পারে। অন্যদিকে, ভাতা পেয়ে মানুষের মধ্যে কাজ না করার প্রবণতা তৈরি হয়। সুযোগসুবিধা পাইয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বৈষম্য তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। কিছু ক্ষেত্রে সুবিধা পৌঁছে দিতে প্রশাসনিক গাফিলতি হয়। তাতে সমাজে বৈষম্য বাড়ে। ক্ষণিকের সুবিধায় সুদূরপ্রসারী উন্নয়নকে অবহেলা করার মানসিকতা তৈরি হয়।
তাছাড়া ভাতার রাজনীতি দলগুলির নীতি নির্ধারণে শুধু নির্বাচনি লাভক্ষতির অঙ্ককেই বড় করে তোলে। আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রশ্ন সেখানে ঊহ্য হয়ে যায়। কিছুদিন আগে সেন্টার ফর ইকনমিক্স অ্যান্ড সোশ্যাল স্টাডিজের এক অনুষ্ঠানে আরবিআই-এর প্রাক্তন গভর্নর ডি সুব্বারাও বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলি যাতে ভোটমুখী ভাতা ঘোষণায় সাবধানি হয়, সেজন্য কোড অফ কনডাক্ট দরকার।’
সত্যিই তাই। পাইয়ে দেওয়ার বিষয়টিতে অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষায় আইন থাকা জরুরি। সুনির্দিষ্ট আইন ছাড়া কোড অফ কনডাক্ট করে আখেরে লাভ হবে না। চিনা দার্শনিক লাউত জু বলতেন, ‘কাউকে একদিন মাছ দিলে তাঁর সেদিনটা কেটে যাবে। কিন্তু মাছ ধরা শেখালে গোটা জীবনটা ভালোভাবে কাটবে।’ কথাটা এক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী।
ভারতীয় নেতাদের বোঝা উচিত, তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক লাভের বদলে নীতিগত উন্নয়ন অনেক বেশি জরুরি। শুধু ভোটের কথা ভেবে এমন মনেরঞ্জনের ঘোষণা ভারতীয় অর্থনীতিতে কুপ্রভাব ফেলতে বাধ্য। নীতি নির্ধারকদের এর চেয়ে বরং কর্মসংস্থানের সুনির্দিষ্ট পরিকাঠামো তৈরির মাধ্যমে দেশবাসীকে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা দিতে অগ্রণী হওয়া উচিত। দেশের সুরক্ষিত আর্থিক ভবিষ্যৎকে সবসময় রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখা প্রয়োজন। এজন্য সব দলেরই ভোটমুখী ভাতা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এখন।