ভাগ্যের ফের! ‘অপমান’ আসলে কী এবার বুঝলেন ধনকড়?

ভাগ্যের ফের! ‘অপমান’ আসলে কী এবার বুঝলেন ধনকড়?

জীবনযাপন/LIFE STYLE
Spread the love


ভাগ্যের এমন ফের যে, ‘অপমান’ আসলে ঠিক কী কঠিন আঘাত দিল্লিতে বসে ঠারেঠোরে বুঝে গেলেন ধনকড়। অনুভব করলেন রাজরোষ। কার্যত ধাক্কা দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল উপ-রাষ্ট্রপতির পদ থেকে। তাঁর মতো প্রবীণ প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ, প্রতিনিয়ত সার্ভিস দেওয়া ব্যক্তির প্রতি ন্যূনতম সৌজন্য দেখানো হল না। কেন বিজেপি তাঁর প্রতি এত কঠোর হল তা নিয়ে চর্চা চলছে। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক

রেড রোডে দুর্গাপুজোর কার্নিভালে তাঁকে মিডিয়ার সামনে আসন দেওয়া হয়নি বলে ‘অপমানিত’ বোধ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন রাজ‌্যপাল জগদীপ ধনকড়। সে-কথা প্রেস কনফারেন্স করে বলেওছিলেন। মিডিয়ায় ‘ফোকাস্‌ড’ হওয়ার জন্য একজন রাজ্যপালের এহেন আচরণ অতীতে কখনও দেখেনি বাংলা। সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিল বড়লাটের ফেলে যাওয়া প্রাসাদের দিকে। অনেকেই তো সেখানে এলেন-গেলেন, ধরমবীর থেকে গোপালকৃষ্ণ গান্ধী, বিতর্কও কম হয়নি। কিন্তু এ কী কাণ্ড! রাজ্যপাল বলছেন, তাঁকে না-দেখিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে দেখিয়ে গিয়েছে মিডিয়া! কেন সেটা হবে! তিনি অপমানিত। অপমান না অভিনয়? অচিরেই সব স্পষ্ট হয়।

ভাগ্যের এমন ফের যে, ‘অপমান’ আসলে ঠিক কী কঠিন আঘাত দিল্লিতে বসে ঠারেঠোরে বুঝে গেলেন ধনকড়। অনুভব করলেন রাজরোষ। কার্যত ধাক্কা দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল উপ-রাষ্ট্রপতির পদ থেকে। তাঁর মতো প্রবীণ প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ, প্রতিনিয়ত সার্ভিস দেওয়া ব্যক্তির প্রতি ন্যূনতম সৌজন্য দেখানো হল না। কেন বিজেপি তাঁর প্রতি এত কঠোর হল তা নিয়ে চর্চা চলছে।

ধনকড় এবার নিশ্চয়ই বুঝছেন কলকাতা এবং দিল্লির পরিবেশ এক নয়। সেদিন রাজভবন থেকে সব প্রোটোকল ভেঙে মুখ্যমন্ত্রী অথবা রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি রাজনৈতিক ভাষণ দিতেন। কারণে-অকারণে নির্বাচিত সরকারকে বিব্রত করতেন। প্রশাসনের সঙ্গে পদে-পদে অসহযোগিতা করা-ই ছিল তঁার একমাত্র কাজ। অথচ চরম অপমানিত হয়েও নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে একটি কথা বলার ক্ষমতা তাঁর এখন নেই। উপর থেকে নির্দেশ এল, এক মুহূর্ত দেরি না করে বাধ্য ছেলের মতো পদত্যাগ করে চলে যেতে হল।

একে-তাকে ফোনের পর ফোন করেও রোষ কমানো গেল না। কেউ কেউ ফোন ধরলেনই না। সারাদিন যিনি কাজে ডুবে, পর পর মিটিং করলেন, রাত ৯টায় তাঁকে পদত্যাগপত্রে লিখতে হল ‘অসুস্থতা’-র কথা। যে কায়দায় তাঁকে বিদায় করা হল, তার পর আর কোনও পুনবার্সনের সুযোগ রইল না।

এবার কী হবে? এখনও শাসক শিবিরে থাকবেন, না কি বিরোধীদের পক্ষ নিয়ে মুখ খুলবেন, সেটা সময় বলবে। তবে অতি ধুরন্ধর ধনকড় চুপ করে অবসর জীবনে চলে যাবেন,
এমন মনে করা যাচ্ছে না। এই পরিণতি অবশ‌্য প্রাপ্যই ছিল। নিজেকে সবার ঊর্ধ্বে ভাবার প্রবণতা থেকেই তিনি হয়তো ভেবেছিলেন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান পদে নিজের মতো চলবেন। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব আর মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় এক নয়। মতের অমিল হওয়ায় তঁাকে ছেড়ে
দিতে বলা হল। তিনি বাধ্য হলেন ইস্তফা দিতে।

সংসদীয় গণতন্ত্রে পদের গরিমা-মর্যাদা যাই থাক, রাজ্যপালদের সম্মান রাজনীতির কারণে ভূলুণ্ঠিত। সংবিধান রচনার সময় রাজ্যপাল কারা হবেন তা নিয়ে বলা হয়েছিল– সমাজের সুশিক্ষিত, সজ্জন অভিজ্ঞ জ্ঞানী ব্যক্তিদেরই এই পদে বসানো হবে। কিন্তু রাজ্যপালদের কাজ যখন হয়ে দাঁড়ায় রাজভবনে বসে দিল্লির সরকারের দালালি, তখন পদটি ‘রাজনৈতিক’ রূপ পায়। রাজভবনে বসে কোটি-কোটি টাকা ধ্বংস করে রাজ্য সরকার কী করছে সে ব্যাপারে নজরদারি এবং দিল্লির প্রভুদের কাছে খবর সরবারহ করা রাজ্যপালদের কাজ হয়ে দাঁড়ায়।

এমন নয় এই অধঃপতন বিজেপি আমলে শুরু হয়েছে। এমনও নয়, রাজ্য এবং রাজ্যপাল সংঘাত নরেন্দ্র মোদির আমলেই দেখা গেল। কংগ্রেসই প্রথম রাজভবনকে রাজনৈতিক উদ্দেশে্য ব্যবহার শুরু করে। রাজে্য-রাজে্য রাজভবনকে দলের লোকদের অবসরকালীন পুনর্বাসন কেন্দ্র করে তোলা হয়েছিল। রাজীব গান্ধীর সময় রাজ্যপালের সুপারিশে একের-পর-এক বিরোধী রাজে্য নির্বাচিত সরকার ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন ‘জারি’ করা হত।

বিজেপি এক ধাপ এগিয়ে রাজভবনকে গেরুয়া পার্টির রাজ্য দপ্তরের রূপ দেয়। বিরোধী দল শাসিত রাজে্য রাজ্যপাল পদে নিজেদের লোক পাঠিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া শুরু হয়। বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী, তথাগত রায়, অসীম ঘোষ। তিনজন ভদ্রলোকই বাংলায় রাজ্য বিজেপির সভাপতি ছিলেন। অবসরের পর এঁদের যথাক্রমে উত্তরপ্রদেশ, ত্রিপুরা ও হরিয়ানার রাজভবনে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই তিন, গুজরাত-সহ গোবলয়ের রাজ্যগুলি কত দলীয় রাজ্যপাল পেয়েছে কে জানে! সেই স্রোতেই একসময় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হন জগদীপ ধনকড়। তাঁর অবশ্য আরএসএসের ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। জনতা পার্টি, কংগ্রেস-সহ নানা দল করে শেষে বিজেপিতে। নেতৃত্বের দ্রুত আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। পেয়ে যান রাজ্যপাল পদ। পশ্চিমবঙ্গ দখলে উদ্‌গ্রীব মোদি-শাহরা অনেক প্ল্যান করেই ধনকড়কে বাংলায় পাঠান। সেই সার্ভিস তিনি দিয়েছেন। একটু বেশিই দিয়েছেন। ফলে তঁাকে উপ-রাষ্ট্রপতি করা হয়।

মনে রাখতে হবে, এই পদটি শুধুই সাংবিধানিক নয়, পদাধিকার বলে উপ-রাষ্ট্রপতি রাজ্যসভার চেয়ারম্যান। সংসদ উচ্চকক্ষে সর্বদা একজন জঁাদরেল আইন বিশেষজ্ঞ মানুষকে বসিয়ে এসেছে কেন্দ্রের শাসক দল। সেই বিচারে জগদীপ ধনকড়ের নির্বাচন ছিল যথার্থ।
বাংলার রাজ্যপালের দায়িত্ব নিয়েই তিনি বিজেপিকে সন্তুষ্ট করার কাজ শুরু করেন। রাজনৈতিক নেতার মতো কট্টর তৃণমূল-বিরোধী অবস্থান নেন। সংসদীয় রীতিনীতি নস্যাৎ করে মুখ্যমন্ত্রীর সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। মনোনীত ব্যক্তি হয়েও এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে জনপ্রতিনিধির ক্ষমতা ও অধিকার খর্ব করতে শুরু করেন। মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠক এক অনবদ্য কাজ। সরাসরি মানুষের সঙ্গে সংযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী। ফেলে রাখা কাজ দ্রুত শেষ হয়। সবাইকে অবাক করে ধনকড় জেলায় গিয়ে প্রশাসনিক বৈঠক ডাকতে শুরু করেন। তাতে অবশ্য প্রশাসনিক কর্তারা শামিল হননি। চেয়ার ফঁাকা ছিল। তবু ছবি হয়, খবর হয়। কখনও আবার রাজভবনে সাংবাদিকদের ডেকে রাজনৈতিক কথা বলতেন। ছিল সরকারকে-বিরোধী হুমকি। আবার কখনও দুর্গাপুজোর কার্নিভালে মিডিয়ার ফোকাস না পেয়ে ‘অামি অপমানিত’ বলে সহানুভূতি নেওয়ার চেষ্টা।

সব সীমা ছাড়িয়ে একবার রাজ্যপাল রাজে্য ‘পরিবর্তন’-এরও ডাক দিয়েছিলেন। স্বভাবতই সেই সময় ‘বড় খবর’ হয়ে ওঠেন ধনকড়। মিডিয়া তাঁর পিছনে দৌড়তে শুরু করে। রাজভবনে বসে টিভি ইন্টারভিউও দিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমে রাজ্যপাল বা রাজভবন বলে ‘বিট’ কোনওকালে ছিল না। প্রয়োজন হয়নি। কারণ, রাজভবন একটা সাংবিধানিক ঘেরাটোপের রাজবাড়ি। তার গরিমা অাছে, কিন্তু ক্ষমতা নেই। রাজভবনের খবর নিয়ে কারও কোনও অাগ্রহ ছিল না। খুব বড় কোনও ঘটনা ছাড়া রাজ্যপালরাও সাংবাদিকদের সামনে অাসতেন না। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া রাজ্যপালরা কখনও ধনখড়ের মতো প্রোটোকল ভাঙেননি। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজ্যপাল যে ঠুঁটো জগন্নাথ তা জানা সত্ত্বেও তিনি মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়ের প্রশাসনকে প্রতিদিন উত্ত‌্যক্ত করতেন একটাই কারণে, যাতে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। ভাল কোনও ‘প্রোমোশন’ মেলে। নিজের মিশনে ধনকড় সফল হন। মোদি তাঁকে উপ-রাষ্ট্রপতি করে দেন।

সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু যেমন খুশি চলতে গিয়েই কি বিপদ ডেকে আনলেন? তিনি যখন বিচার ব্যবস্থাকে আক্রমণ করছিলেন, তখন মনে করা হয়েছিল, পিছনে সরকারের সায় আছে। এখন বোঝা যাচ্ছে মোদি-শাহরা আদতে খুব বিরক্ত। পর পর অনেক ইসু্য। ফলে অার সময় দিতে চাননি। রাতারাতি সরে যেতে বলা হল। একজন উপ-রাষ্ট্রপতির এভাবে সরে যাওয়াও বিরাট অপমান, অসম্মানের। ভাগে্যর এমন ফের, সময় বদলে দিল ছবিটা। এবার মিথ্যেটা সহসা সতি্য হয়ে গেল!



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *