- অগ্রদীপ দত্ত
কাশফুল ছাড়া যেমন দুর্গাপুজো কল্পনা করা যায় না, তেমনই নতুন জামাকাপড় ছাড়া বাঙালির পুজো অসম্পূর্ণ। পুজোর আমেজ তৈরি হতে শুরু করে মাসখানেক আগে থেকে। যদিও বর্তমান সময় আর আমাদের ছেলেবেলার আমেজের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য চোখে পড়ে। পার্থক্য হওয়াটা স্বাভাবিকও বটে। পুজোর চারটে দিনকে ঘিরে যে আবেগ ও উন্মাদনা তৈরি হয়, তার একটা বড় অংশজুড়ে থাকে নিজেদের আবিষ্কার করার নেশা। তার মধ্যে জড়িয়ে থাকে নতুন জামাকাপড় কেনাকাটার বিষয়টা। নতুন জামা না থাকলে পুজোর স্বাদটাই ফিকে লাগে।
পুজোর জামা নিয়ে লিখতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা, যখন বাড়ির সকলে একসঙ্গে বের হতাম কেনাকাটা করতে। তখন শপিং মল কালচার জলপাইগুড়ি শহরে সেভাবে শুরু হয়নি। মার্চেন্ট রোড, ডিবিসি রোড, দিনবাজার- মূলত এই তিনটে জায়গায় কেনাকাটা করতে যেতাম আমরা। হাঁটতে হাঁটতে কারও পা ব্যথা হয়ে যেত, কারও তেষ্টা পেত, কেউ আবার দোকানদারের সঙ্গে দরাদরিতে মেতে উঠত। আজকাল সেই একসঙ্গে কেনাকাটার আনন্দ প্রায় হারিয়ে গিয়েছে। এখন এক ক্লিকে অনলাইনে জামা কেনা যায়, দরজায় এসে হাজির হয় ফ্যাশনেবল পোশাক। কিন্তু বাজারের ভিড় ঠেলে নতুন জামা কেনার যে সম্মিলিত আনন্দ, তার বিকল্প আর কী-ই বা হতে পারে?
পুরোনো দিনের আরেকটা বিশেষ স্মৃতি হল, তখন ট্রায়াল রুম বলে কিছু ছিল না। দোকানদার জামা মেলে ধরতেন আর আমরা আন্দাজে সিদ্ধান্ত নিতাম। বাড়ি নিয়ে এসে দেখা যেত হাতা হয়তো লম্বা কিংবা জামাটা ঢিলে। তখন মা বলতেন, ‘কিছু হবে না, কেটে ছোট করে নেব’ বা ‘আগামী বছরে ঠিক মানাবে।’ সেই অপূর্ণতাই হয়ে উঠত স্মৃতির অংশ। আজকের দিনে নিখুঁত ফিট না হলে জামা সঙ্গে সঙ্গে ফেরত পাঠানো হয় রিপ্লেসমেন্টের জন্য। ফ্যাশনের জগৎ নিখুঁত। সেই অদ্ভুত অসম্পূর্ণতার আনন্দ হারিয়ে গিয়েছে।
ট্রায়াল রুম ছিল না বলে সবচেয়ে বেশি ঝক্কি পোয়াতে হত প্যান্ট বাছতে। ভিড়ে ঠাসা দোকানে জামা তাও গায়ে গলিয়ে দেখে নিতাম কিন্তু প্যান্টের ক্ষেত্রে পড়তাম সমস্যায়। কখনও দোকানের কোণে দাঁড়িয়ে, কখনও বা দোকানদারের আবদ্ধ বেষ্টনীর পেছনে বিপৎসংকুলভাবে গামছা বেঁধে প্যান্ট পরে দেখে নিতে হয়েছে মাপে হচ্ছে কি না। সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। পান থেকে চুন খসলেই মানসম্মান ধুলোয়।
যেহেতু মফসসল এলাকায় থাকতাম, সেখানকার কেনাকাটার চিত্র ছিল কিছুটা আলাদা। কাপড়ের দোকান ছিল হাতেগোনা। কেউ কেউ সাপ্তাহিক হাট থেকেও পুজোর কেনাকাটা করতেন। হাটখোলার কাপড়হাটিতে ভিড় জমত।
আরও একটা জিনিস মনে পড়ে। আমাদের পাড়ায় প্রতিবার পুজোর আগে এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা আসতেন। মেয়েদের জন্য রংবেরঙের শাড়ি, বাচ্চাদের জন্য ফেরিওয়ালাকে বছরের অন্য সময় দেখা যেত না। মহালয়ার ঠিক আগে আগে তিনি আমাদের পাড়ায় আসতেন, মাথায় সবুজ টিনের ট্রাংক। পাড়ায় ঢুকেই হাঁক দিতেন, ‘লতুন জামা লিবা? হেই লতুন জামা…।’
তাঁর বাচনভঙ্গি, আন্তরিকতার জন্যই হয়তো আমরা তাঁর প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করতাম। পুজোর কেনাকাটা আগে হয়ে গেলেও তাঁর কাছ থেকে কিছু না কিছু নিতামই। তিনি যখন টিনের ট্রাংক খুলে শাড়ি দেখাতে শুরু করতেন, আশ্চর্য এক গন্ধে ভরে উঠত চারদিক। সেই গন্ধে অদ্ভুত এক মাদকতা ছিল, মায়া ছিল। শরতের শিশিরভেজা সকালের শিউলির ঘ্রাণ নাকে এলে যেমন লাগে, ঠিক সেরকম মনে হত। বহু বছর সেই ফেরিওয়ালা আমাদের পাড়ায় এসে নতুন জামা বিক্রি করতেন। তারপর হঠাৎ একদিন তিনি এলেন না। কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। কেউ বললেন, দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন, আবার কেউ বললেন, বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন, সেখানেই ফিরে গিয়েছেন। তাঁর নামটাই অজানা থেকে গেল।
ছেলেবেলায় জামার প্রতি আমাদের এত উৎসাহের কারণ বোধহয় অর্থনৈতিক অবস্থা। মধ্যবিত্ত বাঙালির বড় অংশ তখন এত বেশি দেখনদারির ট্রেন্ডে বিশ্বাস করত না। বেশিরভাগ মানুষ নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কেনাকাটা করতেন। পুজো ছাড়া অন্য সময় জামাকাপড় খুব একটা কেনা হত না। আজকের দিনে বাচ্চাদের জন্য কেনা হয় থিমভিত্তিক পোশাক, একদিন ওয়েস্টার্ন, একদিন ট্র্যাডিশনাল, একদিন ফিউশন, আরও কত কী!
মহালয়ার ভোরে রেডিওতে ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ শুনতে শুনতে কিনে আনা নতুন জামার প্যাকেটটা হাতে নিয়ে এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়াতাম। কতবার যে আয়নার সামনে নিজেকে সেই জামার ভেতর দেখতাম! দোকানদার বলতেন, ‘পুজোয় এবার এটাই হিট। পুরো শাহরুখ খান লাগবে। এটা পরে দেখো শুধু।’ সত্যিই, কেনার সময় শাহরুখ খানই মনে হত নিজেকে। যদিও বাড়ি এসে সেই একই জামা গায়ে গলালে জৌলুস কীভাবে হারিয়ে যেত, সেই রহস্য আজও অজানা।
নতুন জামার গল্পে প্রজন্মভেদও স্পষ্ট। দাদু-ঠাকুমারা বলতেন, ‘আমাদের সময়ে দুটো জামা পেলেই হত।’ আমাদের সময়ে দাঁড়িয়েছে চারদিনে চার জামায়। আর আজকের বাচ্চারা বেছে নিচ্ছে পছন্দের ব্র্যান্ড, প্রিয় ইউটিউবার বা অভিনেতার মতো পোশাক। নতুন জামাকাপড়ের সংজ্ঞা তাই সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে।
শুধু বদলাতে পারেনি নতুন জামার সেই অদৃশ্য জাদু। উৎসবের প্রথম দিনে যখন গায়ে নতুন পোশাক চাপাই, মনে হয় জীবনের সমস্ত ধুলোবালি ঝরে গিয়েছে। নতুন জামা শুধু শরীরে নয়, মনে একটা নতুনত্ব আনে। যে কারণে পুজোয় এখনও আমরা নতুন পোশাক কিনি, যতই আলমারিতে আগের বছরের ড্রেস থাকুক না কেন।
আজ যখন ডেলিভারি বয়ের হাত থেকে ব্র্যান্ডেড জামার প্যাকেটটা নিই, তখনও কোথাও না কোথাও কানে বাজে সেই পুরোনো দিনের ডাক, ‘লতুন জামা লিবা..হেই লতুন জামা…।’ সেই ডাকেই লুকিয়ে আছে উৎসবের সমস্ত আনন্দ ও উচ্ছ্বাস।