যে-বিজেপি জাতভিত্তিক জনগণনা বা জাতিগণনার বিরুদ্ধে ছিল, হঠাৎ তারা পক্ষে গেল কেন? বিহার নির্বাচনে ভালো ফল করতেই কি কেন্দ্রীয় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিল? অল্প সময়ে নির্বাচনী সুবিধালাভের জন্য আপস? উন্নয়নের প্রচার, না কি বিভেদের কানাগলি– নির্বাচনী রাজনীতিতে জাতগণনা কোন পথে? লিখছেন শুভময় মৈত্র।
চারদিকে যুদ্ধের দামামা। ফলে সংবাদ এবং সমাজমাধ্যমে সেই খবরই বেশি থাকবে। বড় অংশের মানুষ এই সময় তুমুল জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হবে। আবার, একটি অংশের মানুষ চাইবে যে, এই যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে দুই দেশ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসুক। আপাতত ভারত সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যেভাবে পুরো বিষয়টিকে সামরিক এবং কূটনৈতিক পর্যায়ে সামলাচ্ছে– আশা করা যায় যে, পাকিস্তান খুব তাড়াতাড়ি সুষ্ঠু মীমাংসায় আসতে বাধ্য হবে। সার্বভৌম দেশ হিসাবে ভারতের কাছে তা অবশ্যই সার্বিক জয়।
তবে এ-ও পরিষ্কার যে, সন্ত্রাসবাদ শুধুমাত্র যুদ্ধ দিয়ে নির্মূল করা যায় না– তার একাধিক উদাহরণ বিশ্বেতিহাসে আছে। সাধারণভাবে হিংসার বিরুদ্ধে যে কোনও সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সবথেকে বড় অস্ত্র– মানুষের সার্বিক উন্নয়ন। তবে এ-ও অস্বীকার করা যায় না যে, সমাজে দ্বন্দ্ব থাকবেই। মানুষের মনোজগতের যে-গঠন, তাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া কোনও অগ্রগতির ইতিহাস লিখতে পারা শক্ত। তাই শান্তির আলোচনা হলেও ঘুরে-ফিরে হিংসাও কতকটা আসবে। সমাজে অবিচার থাকবেই কোনও-না-কোনও চেহারায়। তাই বাস্তবসম্মত পরিকল্পনায় আদতে হিংসা কিংবা অবিচারের মাত্রাটা কমাতে হবে, এটা জেনেই যে, তাকে শূন্য করা অসম্ভব।
গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের দায় সেটাই, যেখানে জনগণের মঙ্গলই মূল লক্ষ্য। মানুষের মঙ্গল করতে গেলে তো মানুষ কেমন আছে জানতে হবে। তার অনেক পথ আছে, যার মধ্যে অন্যতম হল, আদমশুমারি অথবা জনগণনা। ‘জনগণনা’ মানে এক-দুই করে মানুষ গোনা নয়, সঙ্গে প্রতিটি মানুষ সম্পর্কে আরও কিছু খবর নেওয়া। এমন খবর, যা থেকে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা আগামী দিনে কোন পথে মানুষের উপকার করবে, তা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে। মুশকিল হল, আমাদের দেশে ২০১১ সালের পর থেকে জনগণনা আর হয়নি। এর নেপথ্যে কোভিড একটা বড় কারণ। কিন্তু তাছাড়াও রাজনৈতিক কারণ আছে একাধিক। যাই হোক, এবার যখন আবার গোনা শুরু হতে চলেছে, সেই সময় ৩০ এপ্রিল ঘোষণা করা হল যে, জাতভিত্তিক জনগণনা– জাতিগণনা বা বর্ণশুমারি রূপায়িত হবে। কোন শব্দবন্ধটা বাংলায় ভাল শোনাচ্ছে, তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, বিজেপি তো আগে এর বিরুদ্ধে ছিল, হঠাৎ পক্ষে গেল কেন?
রাজনীতি পরিবর্তনশীল, মতবদল হতেই পারে। কিন্তু শুধু বিহার নির্বাচনে ভাল করতে হবে বলে বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিল– এমনটা ভাবলে অতি সরলীকরণ হতে পারে। মাথায় রাখতে হবে যে, ২০২৩ সালে নীতীশ যোগ দিয়েছিলেন লালুর দলে, তখন বিহারের সরকারে বিজেপি ছিল না, এবং সেই সময় বিহারে বর্ণশুমারি-সংক্রান্ত কিছু সমীক্ষা সম্পন্ন হয়। এখন আবার নীতিশের সঙ্গে মিলেই ভোটে লড়বে বিজেপি। ফলে অল্প সময়ে নির্বাচনী সুবিধার জন্য বিজেপি আপস করল এমনটাও হতে পারে।
এবার দীর্ঘমেয়াদি ভাবনার কথায় আসা যাক। এইখানে মূল প্রশ্ন হল, জাতগণনা কি জাতিগত বিদ্বেষ এবং অসাম্য কমাতে পারবে? একেবারে সহজ কথা হল, আমাদের দেশে সংরক্ষণ আছে। তফসিলি জাতি (এসসি), জনজাতি (এসটি) এবং অন্যান্য পিছিয়ে থাকা বর্গের জন্য বিভিন্ন জায়গায় সংরক্ষণ মোট সাড়ে ৪৯ শতাংশ। কোনও-কোনও রাজ্যে এর থেকে বেশিও হয়, তবে দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয়ের কিছু রায়ের ব্যাখ্যা বলে যে, অর্ধেকের বেশি সংরক্ষণ আইনানুগ নয়। এদিকে, এ-কথা তো সত্যি যে, ভারতে নিম্নবর্গের মানুষের সংখ্যা ৫০ শতাংশর বেশি। তাহলে প্রশ্ন হল, তারা কি সেই শতাংশর হিসাবে সরকারি ব্যবস্থায় সুবিধা পাবে? সঙ্গে-সঙ্গে এই প্রশ্ন আসবে যে, আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের কী হবে? তার মধ্যে তো উচ্চবর্ণের মানুষও থাকতে পারে! মাথায় রাখতে হবে যে, আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের জন্যও আছে ‘ইকোনমিকালি উইকার সেকশন’ (ইডব্লিউএস) সংক্রান্ত সংরক্ষণ। অর্থাৎ আমাদের দেশের সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের সংরক্ষণের কথা ভাবে।
যেমন, গত কয়েক বছর আইআইটি বা এনআইটি-তে প্রযুক্তি সংক্রান্ত স্নাতক স্তরের পড়াশোনার জন্য মহিলা বিভাগে অতিরিক্ত সংরক্ষণ চালু হয়েছে। এই প্রত্যেকটি বিষয়ের ভাল-মন্দ নিয়ে চুলচেরা বিচার অসম্ভব। তবে কোনও সন্দেহই নেই যে, কোনও ক্ষেত্রে সংরক্ষণ যেমন কিছু পিছিয়ে থাকা মানুষের সুবিধা করে দেয়, তেমনই ফঁাকতালে সেই সুযোগ পেয়ে যায়– নামে পিছিয়ে থাকা কিন্তু আদতে সুবিধাভোগী মানুষ। অবশ্যই সেই ঝামেলায় অনেক যোগ্য প্রার্থীকে নেতিবাচক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সোজা কথায়, এর ভাল-মন্দ দুই-ই আছে। অসাম্য কমানোর এটা একটা উপায় বলে ধরা যেতে পারে, কিন্তু একমাত্র এই উপায়ে যে অসাম্য ঘুচবে না, সেটাও পরিষ্কার। জাত-সংক্রান্ত আলোচনা বাদে আরও অনেক বিষয় আছে, যা দেশের উন্নয়নের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। আপাতত সেই রুটি-কাপড়া-মকান কিংবা বিজলি-সড়ক-পানির অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় ঢুকে শব্দ খরচ না করাই ভাল।
এবার প্রশ্ন হল যে, জাতিগণনার ক্ষেত্রে ঠিক কী-কী অতিরিক্ত তথ্য মানুষের কাছ থেকে চাওয়া হবে? বলা হয় যে, আমাদের দেশে ১৯৫১ সালের আদমশুমারির পর থেকে খুব খুঁটিয়ে মানুষের জাত বা বর্ণাশ্রম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়নি। এবারের যে বিলম্বিত ২০২১ জনগণনা, তাতে নিশ্চয়ই অতিরিক্ত বেশ কিছু তথ্য নেওয়া হবে, যা পরিষ্কার হয়ে যাবে সঠিক প্রশ্নগুলো যখন প্রকাশিত হবে। বিহার, কর্নাটক এবং তেলেঙ্গানা এই সংক্রান্ত সমীক্ষা আগে করেছে, এবার পুরো দেশে তার সার্বিক বিবরণ পাওয়া যাবে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে হয়তো বাউড়ি, বাগদি, রাজবংশী, কুর্মি কিংবা সদ্গোপ, মাহিষ্য, আগুরি এই সমস্ত নির্দিষ্ট তথ্য থাকবে। সার্বিকভাবে দেশের বিভিন্ন অংশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বোঝা যাবে বিভিন্ন অংশে–আসবে সামাজিক ন্যায়বিচার, সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের বিভিন্ন প্রশ্ন। আলোচিত হবে পিছিয়ে থাকা অংশের আশু উন্নয়নের পথ।
দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, অতিরিক্ত তথ্যের প্রশ্ন আসছে এই কারণে যে, মীনা গোষ্ঠীর মানুষ রাজস্থানে তফসিলি জাতির (এসসি) মধ্যে পড়েন, আর মধ্যপ্রদেশে অন্যান্য পিছিয়ে থাকা অংশে (ওবিসি)। তঁাদের কি দেশ জুড়ে একই জায়গায় আনা সম্ভব? উচ্চারণে খুব কাছাকাছি, কিন্তু ‘উপাধি’ সামান্য আলাদা হলে তঁাদের কীভাবে আলাদা করবেন, না কি রাখবেন একসঙ্গে? কত ছোট-ছোট ভাগে ভাগ করা যেতে পারে বিভিন্ন অংশকে? তার ফলে সরকারি পড়াশোনা বা চাকরির সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভাগ করতে গিয়ে আরও গুলিয়ে যাবে না তো? তথ্যের সঠিক ব্যাখ্যা (কে কোন অংশের, তার প্রমাণ লাগবে তো!) এবং তারপরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণতা থাকলে গোলমাল বাড়বে, না কমবে– তা পরিষ্কার নয়।
ছোট-ছোট ভাগের উন্নয়ন ঠিক কীভাবে সার্বিক উন্নয়নের পথ দেখাতে পারে, তা অবশ্যই পুরো প্রক্রিয়ায় বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি চাকরি এমনিতেই কম। এবার ২০০ আসনকে ঠিক কীভাবে ভাগ করে কাকে কোন অংশ দেওয়া হবে এবং সেখানে ভগ্নাংশ কী-কী বিপদ ডেকে আনে– সেই কথা সরকারি অফিসে যঁারা এই পাটিগণিত কষেন, তঁারা হাড়ে-হাড়ে জানেন।
জাতপাতের রাজনীতি যেমন বিভেদের সৃষ্টি করে, তেমন মানুষের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তার একাধিক উদাহরণ আছে। নয়ের দশকে লালুপ্রসাদ যাদবের রাজত্বে বিহারে নিম্নবর্গের মানুষের হাতে ক্ষমতা যায় অনেকটাই। যদিও এ-কথা উঠে আসবে যে, সেই সরকারের বিরুদ্ধে বারবার উঠেছে দুর্নীতির প্রশ্ন। অর্থাৎ ভারতের কেন্দ্রীয় স্তরে এবং বিভিন্ন রাজ্যে যখনই কোনও সরকার নিম্নবিত্তর জন্য বা নিম্নবর্গের জন্য সুবিধা দিতে চেষ্টা করেছে, তার সঙ্গেই কোরিলেটেড বা পঙ্ক্তিভুক্ত হয়েছে দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়ন। আর, দুর্নীতির কথা বাদ দিলেও, যে কোন সৎ ভাগাভাগিতেও একজনের সুবিধা করতে গেলে অন্য একজনের অসুবিধা হতেই পারে। সকলেই বোঝে যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সুযোগ বুঝে জাতধর্মকে ব্যবহার করে,
কিন্তু আদতে চায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তর অল্প কয়েকজনকে উচ্চবিত্তর দলে টেনে নিয়ে তাদের বাকিটুকুকে নিম্নবিত্ত অংশে পাঠিয়ে দিতে। সেক্ষেত্রে পুরো দেশের উচ্চবর্ণ
এবং আমাদের রাজ্যেও মধ্যবিত্ত কায়স্থ, বৈদ্য কিংবা ব্রাহ্মণরা সুযোগ-সুবিধার অভাবে ভুগবেন।
সবসময় সকলেই জিতল– এমন ঘটনা ঘটে না। ফলে ধর্মের ক্ষেত্রে বিভাজন যেমন আমাদের দেশে দিন-দিন প্রকট হচ্ছে, তেমনই বর্ণশুমারিতে সেই একইরকমের গোলমাল বাধিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। হয়তো তা প্রতিফলিত হবে মূলত এ দেশের সংখ্যাগুরুর ক্ষেত্রেই। আপাতত যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এসব প্রশ্ন ততটা সামনে আসবে না। তবে আগামী দিনের নির্বাচনী রাজনীতিতে জাতগণনা উন্নয়নের পথে প্রচারের অংশ হয়, না কি ঢুকে পড়ে বিভেদের কানাগলিতে– সেই বিষয়টি এখন একেবারেই পরিষ্কার নয়।
(মতামত নিজস্ব)