বিশ্ব দাবার মানচিত্রে ভারত, এক কিংবদন্তি থেকে বাস্তবতার মহাকাব্য

বিশ্ব দাবার মানচিত্রে ভারত, এক কিংবদন্তি থেকে বাস্তবতার মহাকাব্য

স্বাস্থ্য/HEALTH
Spread the love


বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন থেকে গ্র্যান্ডমাস্টার— দক্ষিণ ভারতের মাটি থেকে উঠে এসেছেন অসংখ্য দাবাড়ু। খেলা যখন আত্মিকতার সঙ্গে মিশে যায়, তখন তা আর শুধুই ঘুঁটির চাল থাকে না। হয়ে ওঠে ধ্যান, হয়ে ওঠে শিল্প। ভারত এখন দাবার পরাশক্তি দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। বিশ্ব দাবার ইতিহাসে এই প্রথমবার লাইভ রেটিং তালিকা অনুসারে বিশ্বের শীর্ষ দশ দাবাড়ুর মধ্যে চারটি স্থানই দখল করে নিয়েছেন আমাদের দেশের তরুণ তুর্কিরা! লিখছেন বুদ্ধদেব হালদার

দক্ষিণ ভারতীয়দের, বিশেষ করে তামিলনাড়ুর মানুষেরা এক অদ্ভুত প্রত্যয়ে বিশ্বাসী। তারা মনে করেন, মহাদেবেরই এক রূপ সথুরঙ্গ বল্লভনাথর, তিনিই নাকি দাবার ঈশ্বর। তাদের বিশ্বাসের নেপথ্যে রয়েছে এক চমৎকার কিংবদন্তি। তামিলনাড়ুর তিরুভারুর জেলার থিরুপুভানুর গ্রামে রয়েছে প্রাচীন এক মন্দির। সেই মন্দিরের আরাধ্য দেবতা হলেন ভগবান শিব, যা তামিল ভাষায় ‘সথুরঙ্গম’। কিংবদন্তি অনুসারে, একদা মদাবতী নামে এক রাজকন্যা ছিলেন। তিনি দাবা খেলায় এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে তাঁকে হারানো কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু মহাদেব তো মহাদেবই! তিনি এক সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে এলেন, রাজকন্যার সাথে দাবা খেলতে বসলেন। সেই খেলায় মহাদেবই হলেন জয়ী। পুরস্কার স্বরূপ মদাবতীকে বিবাহ করার অধিকার পেলেন। দাবার চালেই প্রেমের বাঁধন মজবুত হল তাঁদের। আর এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে আজও তামিলনাড়ুর তিরুপুরুরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন সথুরঙ্গ বল্লভনাথর মন্দির। এই মন্দির কেবল একটি স্থাপত্য নয়, দাবার প্রতি দক্ষিণ ভারতীয়দের গভীর আবেগের এক মূর্ত প্রতীক। এই গভীর ভক্তিই বোধহয় তামিলনাড়ুকে ভারতীয় দাবার আঁতুড়ঘর হিসেবে গড়ে তুলেছে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন থেকে গ্র্যান্ডমাস্টার- দক্ষিণ ভারতের মাটি থেকে উঠে এসেছেন অসংখ্য দাবাড়ু। খেলা যখন আত্মিকতার সঙ্গে মিশে যায়, তখন তা আর শুধুই ঘুঁটির চাল থাকে না। হয়ে ওঠে ধ্যান, হয়ে ওঠে শিল্প। আর এই কারণেই হয়তো দক্ষিণ ভারতের দাবাড়ুরা কেবল ঘুঁটি চালনা করেন না। তাঁরা যেন ঈশ্বরকেই স্মরণ করেন প্রতিটি চালে। এই বিশ্বাস, এই ভক্তিই দাবার প্রতি তাঁদের অসাধারণ সাফল্যের গোপন সূত্র।

বর্তমানে বিশ্ব দাবার আঙিনায় এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। এ এক এমন খবর যা প্রতিটি ভারতবাসীকে গর্বিত করবে। বর্তমানে (৭ই জুন, ২০২৫ তারিখ অনুযায়ী) FIDE লাইভ রেটিং অনুসারে বিশ্ব দাবা খেলায় প্রথম দশ জনের তালিকায় ভারতীয় তরুণ তুর্কিদের অবস্থান:

১. ম্যাগনাস কার্লসেন – নরওয়ে (রেটিং: ২৮৩৯.২)
২. হিকারু নাকামুরা – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (রেটিং: ২৮০৭.০)
৩. ফাবিয়ানো কারুয়ানা – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (রেটিং: ২৭৮৪.২)
৪. এরিগাইসি অর্জুন – ভারত (রেটিং: ২৭৭৮.৬)
৫. গুকেশ ডি – ভারত (রেটিং: ২৭৭৬.৬)
৬. প্রজ্ঞা প্রকাশ আর – ভারত (রেটিং: ২৭৭৪.২)
৭. নোডিরবেক আব্দুসাত্তোরভ – উজবেকিস্তান (রেটিং: ২৭৬৭.০)
৮. আলিরেজা ফিরোজা – ফ্রান্স (রেটিং: ২৭৬৬.০)
৯. আরাবিন্দ চিত্রাম্বারাম ভি.আর. – ভারত (রেটিং: ২৭৫৭.৮)
১০. ইয়ান নেপোমনিয়াচি – ফিডে (রেটিং: ২৭৫৭.০)

বিশ্ব দাবার ইতিহাসে ভারতের বর্তমান অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত এখন দাবার পরাশক্তিগুলির মধ্যে অন্যতম। বিশ্ব দাবার ইতিহাসে এই প্রথমবার লাইভ রেটিং তালিকা অনুসারে বিশ্বের শীর্ষ দশ দাবাড়ুর মধ্যে চারটি স্থানই দখল করে নিয়েছেন আমাদের দেশের তরুণ তুর্কিরা! এই চারজনের মধ্যে এরিগাইসি অর্জুন রয়েছেন ৪ নম্বরে। অর্জুন তাঁর আক্রমণাত্মক কৌশলে অনেককেই মুগ্ধ করেন। অপরদিকে লাইভ রেটিং অনুসারে গুকেশ ডোম্মারাজুর অবস্থান ৫ নম্বরে। গুকেশ কঠিন পরিস্থিতিতেও মাথা ঠান্ডা রাখতে সিদ্ধহস্ত। মাত্র আঠারো বছর বয়েসেই তিনি ইতিমধ্যে বিশ্বের কনিষ্ঠতম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরিচিত। লাইভ রেটিং তালিকায় প্রজ্ঞা প্রকাশ আর রয়েছেন ৬ নম্বরে। প্রজ্ঞানন্দ তাঁর ঠান্ডা মাথার খেলা ও অসাধারণ কৌশলের জন্য পরিচিত। আরাবিন্দ চিত্রাম্বারাম ভি.আর. রয়েছেন ৯ নম্বরে। এই চার তরুণ দাবাড়ু কেবল তাঁদের ব্যক্তিগত সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছননি, বরং প্রমাণ করেছেন যে, কঠোর পরিশ্রম ও সঠিক পথনির্দেশনা পেলে আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম যেকোনও ক্ষেত্রেই বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। তাঁদের এই অর্জন শুধুমাত্র দাবা খেলার জয় নয়। এটি ভারতের তরুণ প্রজন্মের মেধা, সাহস ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির জয়। তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন ভারত এখন শুধু ক্রিকেট বা অন্যান্য পরিচিত খেলার দেশ নয়, দাবাতেও আমরা বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর। তাঁদের এই সাফল্য দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক বিশাল অনুপ্রেরণা, যা আরও অনেক প্রতিভাকে দাবার বোর্ডে আসার স্বপ্ন দেখাবে। ভারতবর্ষের মুখ বিশ্ব দরবারে আবারও উজ্জ্বল হল দেশের এই তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে। এ এক অনন্য মুহূর্ত। সামগ্রিকভাবে, ভারতের দাবা এখন একটি স্বর্ণালী অধ্যায় অতিক্রম করছে। তরুণ প্রতিভার নিরন্তর উত্থান, বিশ্ব মঞ্চে ধারাবাহিক সাফল্য এবং দাবার জন্মভূমি হিসেবে ভারতের ঐতিহ্য, –এই সবকিছু মিলিয়ে বিশ্ব দাবার ইতিহাসে ভারত এখন একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী অবস্থানে রয়েছে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *