- মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
মহালয়ার ভোরের একটা নিজস্ব ঘ্রাণ আছে। বছরের বাকি তিনশো চৌষট্টিটি ভোরের সঙ্গে মহালয়ার প্রত্যুষের অলৌকিক গন্ধের কোনও তুলনা হয় না। যে জানে সে জানে। মহালয়ার ভোরের একটা নিজস্ব রংও আছে। শারদ প্রভাতে সদ্য জন্ম নেওয়া দিনশিশুকে যখন সূর্যদেব আশ্চর্য লালিমায় রাঙিয়ে দেন, তখন পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে এক পবিত্রতম অনুভূতি হয় আমাদের অন্তরে। মন ভরে ওঠে উদ্বেল আনন্দে। মনে হয়, এক বছরের প্রতীক্ষা শেষ হল। আবার দশভুজা আসছেন। প্রকৃতি সেজে উঠছে তাঁর আবাহনে।
যখন বয়স কম ছিল, কাকভোরে উঠে বন্ধুরা বেরিয়ে পড়তাম সদলবলে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র চণ্ডীপাঠ শুরু করার আগে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম জুবিলি পার্কে। সারা জলপাইগুড়ি শহর যেন জড়ো হত সেখানে। তখন মোবাইল বাজারে আসেনি। ক্যামেরাই বা ক’জনের ছিল! মন-ক্যামেরাতেই আমরা ফ্রেমবন্দি করতাম ভালোলাগার মুহূর্তগুচ্ছ।
জুবিলি পার্কের কাছ দিয়ে বয়ে যেত তিস্তা। নদীর পাড়ে অকাতরে ফুটে থাকত শ্বেতশুভ্র কাশফুল। সেই কাশফুল কুড়িয়ে আনত ছটফটে তরুণীরা। আমাদের চোখে পলক পড়ত না। একসময় সেই উচ্ছল ভিড় ছাপিয়ে চোখ চলে যেত তিস্তার পাড়ে। দেখতাম, অনভ্যস্ত ধুতিতে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে সার সার মানুষ। পুরোহিত উচ্চারণ করে চলেছেন মন্ত্র। তাঁরা মন্ত্র পড়ছেন পুরোহিতের সঙ্গে। অবাক হয়ে ভাবতাম, ভোরবেলা নদীর তীরে আসার পেছনে এই মানুষগুলোর হয়তো কোনও সামাজিক দায় আছে।
‘পুরোহিত দর্পণ’ নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ তখনও হয়নি। যখন সেই বই হাতে এল, তখন আমাদের শাস্ত্রকারদের পাণ্ডিত্য, জ্ঞানের গভীরতা আর কল্পনাশক্তি বিস্মিত করেছিল। ক্রিশ্চানদের ‘অল সোলস ডে’ কিংবা হিন্দুদের সূক্ষ্ম শরীরের তত্ত্ব জেনেছিলাম আরও কিছুকাল পরে। ‘পুরোহিত দর্পণ’ সেকথাই যেন বলে।
মহালয়ার গুরুত্ব এটাই যে, ভগবান ব্রহ্মার নির্দেশে পিতৃলোক থেকে পিতৃপুরুষরা নেমে আসেন সূক্ষ্মদেহে, পুত্র বা পৌত্রের হাত থেকে শান্তির বারিটুকু গ্রহণ করবেন বলে। ঘোর অমাবস্যা তিথিতে প্রকৃতির এ এক মহালীলা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা রীতি। বছরের পর বছর এই পরম্পরাকে উদযাপন করা হয় এই বিশেষ তিথিতে। সে কারণেই মহালয়ার ভোর স্বতন্ত্র।
প্রয়াত পিতা-মাতার বিশাল সমাবেশ অন্তরীক্ষে তৈরি হয় বলে এই দিনটার নাম মহালয়া। বিশাল অর্থ মহান। সমাবেশ অর্থ আলয় বা আবাস। মহালয়ার সার্বিক বৈশিষ্ট্য হল তর্পণ। পিতৃপক্ষের অন্তিম তর্পণ। মহালয়ার প্রত্যুষে যমলোক থেকে নেমে আসেন পিতা-মাতারা। তর্পণ করা জলের শ্রাদ্ধীয় দ্রব্যের সূক্ষ্মতম অংশ তাঁরা পরমাণুরূপে গ্রহণ করেন। তুষ্ট হলে ভূতচতুর্দশীতে আশীর্বাদ করতে করতে ফিরে যান স্বলোকে। পঞ্চেন্দ্রিয়কে সজাগ করতে পারলে নাকি অনুভব করা যায়, তাঁদের ছায়াময় অস্তিত্ব। মহালয়া তাই এক অর্থে বিরহতিথি।
অন্য তিথির সঙ্গে মহালয়ার মস্ত ফারাক আছে। পিতা-মাতা বা যাঁরাই প্রয়াত হয়েছেন, তাঁদের শ্রাদ্ধ সপিণ্ডকরণের পরের বছর থেকে নির্দিষ্ট প্রয়াণতিথিতে তর্পণ করা শাস্ত্রমতে বিধেয়। যে বাড়িতে প্রয়াত মানুষের সংখ্যা বেশি, সেখানে অধস্তন বংশধরের পক্ষে অনেকগুলি তিথিতে স্নান-তর্পণ করাটা সহজ কাজ নয়। একারণে মহালয়া হল শাস্ত্রীয় কৃপা করুণার নিঃশর্ত ছাড়পত্র। এই তিথিতে সমস্তরকম শ্রাদ্ধ তর্পণ করা যায়। যিনি কোনও নির্দিষ্ট তিথিতে তর্পণ করার সুযোগ পান না, তিনি এই তিথিতে তর্পণ করে দোষমুক্ত হতে পারেন। মহালয়ায় শ্রাদ্ধ করা এতই পুণ্যের যে, এতে নাকি গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধ করার ফল মেলে। এটাই মহালয়ার বিশেষত্ব।
পিতৃপক্ষের শেষ দিন মহালয়া। এই তিথিকে দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত কোনও মহোৎসব ধরলে ভুল হবে। মহালয়া আসলে পিতৃপুরুষের উদযাপন। দুর্গাপুজোর সঙ্গে তার বাস্তব সম্পর্ক এটুকুই যে, এদিন প্রতিমাশিল্পীরা দুর্গামূর্তিতে চক্ষুদান করে থাকেন। কোথাও একবার শুনেছিলাম যে, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর অননুকরণীয় কণ্ঠে পাঠ করা মহিষাসুরমর্দিনী বেতারে সম্প্রচারের দিনটি নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছিল। কখনও পুজোর আগে ষষ্ঠীর দিন, কখনও পঞ্চমীতে মহিষাসুরমর্দিনী তরঙ্গায়িত হয়েছে আকাশবাণী থেকে। অবশেষে বেছে নেওয়া হয়েছিল মহালয়ার দিনটিকে। সেটাই ছিল মাস্টারস্ট্রোক। তা এতটাই সময়োচিত এবং জনপ্রিয় হয়েছিল যে, তারপর আর অন্যথা হয়নি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণর ব্যারিটোন স্বর মহালয়ার ভোরবেলা কী এক জাদুমন্ত্রে একটি বিরহতিথির মধ্যে সঞ্চারিত করে দেয় বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের আবহ।
মহাভারতে আমরা পড়েছি, দানের সময় কাউকে ফেরাতেন না বলে কর্ণ ‘দানবীর কর্ণ’ নামে খ্যাত। সেই কর্ণ যুদ্ধকালে অর্জুনের হাতে মৃত্যুবরণ করার পর বীরের সদগতি লাভ করে স্বর্গে গেলেন। স্বর্গে তাঁকে বরণ করে নিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, ইন্দ্র নন, তিনি আসলে যম। আবাহনের পর্ব চলল প্রথমে। সেই পর্ব শেষ হলে কর্ণকে খেতে দেওয়া হল থালা সাজিয়ে। কিন্তু কর্ণ সবিস্ময়ে দেখলেন তাঁকে খাদ্য নয়, সোনার তৈরি নানারকম অলংকার পরিবেশন করা হয়েছে। খাদ্যের থালায় খাদ্যদ্রব্যের বদলে হিরে-মোতি-চুনি-পান্না দেখে কর্ণ অবাক চোখে তাকালেন দেবরাজের দিকে।
ইন্দ্র বললেন, দ্যাখো, তুমি এতদিন ব্রাহ্মণদের যত জিনিস দান করেছ, সেখানে খাওয়ার জিনিস কাউকে দাওনি। বিশেষ করে পিতৃ বা মাতৃকুলের কারও উদ্দেশে তুমি একটা পিণ্ড পর্যন্ত দাওনি। ফলে তোমার খাবার থালায় শুধু দানের জিনিস। অন্ন নেই কোথাও। কর্ণ বললেন, আমি সারাজীবন জানতামই না যে, আমার পিতা-মাতা কে, আমার পিতৃপুরুষের তালিকায় কে আছেন। আমি পিণ্ড দান করব কার উদ্দেশে?
ইন্দ্র বললেন, এখন তো সব জানতে পেরেছ। তুমি এত বড় দানবীর বলেই তোমাকে পনেরো দিনের জন্য মর্ত্যলোকে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি। এই প্রতিপদ থেকে মহালয়া অমাবস্যা পর্যন্ত সময় ধরে তুমি তোমার পিতৃপুরুষকে উদ্দেশ্য করে পিণ্ড দেবে। মহালয়ার পর ফিরে আসবে তুমি। তখন এখানে তোমার সুব্যবস্থা হবে। কর্ণ ফিরলেন পৃথিবীতে। পনেরো দিন ধরে পিতা-মাতার উদ্দেশে শ্রাদ্ধ তর্পণ করলেন। তারপর ফিরলেন স্বর্গলোকে। দেবরাজ ইন্দ্র সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, তোমার এই পিতৃমাতৃকর্মের পনেরো দিন এখন থেকে পিতৃপক্ষ বলে পরিচিত হবে। এখন তোমার আবাসস্থল এই পিতৃলোক।
অবিশ্বাস্য লাগে ভাবতে। আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষগুলো কি সত্যিই প্রেতলোক থেকে নেমে আসেন এই বিশেষ তিথিতে? তাঁরা কি সত্যিই সূক্ষ্মদেহে আমাদের সামনে এসে হাত পেতে বলেন, আমাদের একটু জল দাও, একটু তিল দাও, তৃপ্ত করো আমাদের? তাঁরা কি বলেন যে, আমরা তৃপ্ত হলে তোমরাও তৃপ্ত হবে, তোমরা তৃপ্ত হলে উত্তর প্রজন্মও সামনে পথ চলার একটা দিশা খুঁজে পাবে?
আজ পরিণত বয়সে এসে উপলব্ধি করি, আসলে এ একটা ক্রমবিকাশ। সবাইকে সমাজের একটা শৃঙ্খলার অনুশাসন পার করে তবেই আপন স্বাধীনতার ভূখণ্ডে দাঁড়াতে হয়। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, তাকে আবেগ বা সংবেদ যা-ই বলা যাক না কেন, কোনও অনুভূতি পুরোপুরি হারিয়ে যায় না। এক-একটা মানুষ বোধহয় আরও প্রকট হয়ে ওঠেন এই পৃথিবী থেকে অপ্রকট হয়ে যাওয়ার পর।