বিয়ের ট্রাঙ্ক

বিয়ের ট্রাঙ্ক

শিক্ষা
Spread the love


  •  পাপিয়া মিত্র

 

জামরুল গাছের পাতাগুলো ঝকঝক করছে। প্রায় ষাট বছরের গাছ। কাণ্ড বেয়ে শেষ শ্রাবণের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। উঠোন বেয়ে সেই জল হুড়মুড় করে যাচ্ছে নর্দমার দিকে। সাবধানে পা ফেলে উঠোন পেরিয়ে শ্বশুরের ঘরের মধ্যে দিয়ে ভাঁড়ার ঘরে ঢুকল মানবী। শ্রাবণধারা এই ঘরটিকেও বাদ দেয়নি। এখন বৃষ্টির বেগ একটু হলেও কমেছে। টালির ছাদ চুইয়ে টপটপ পড়েই চলেছে। সেই অর্থে ব্যবহার করা হয় না বলে ভাঁড়ার ঘরটার মেরামতির কথাও মাথায় থাকে না। বর্ষাকাল এলেই মনে পড়ে ভাঁড়ার ঘরটা ঢালাইয়ের কথা। বাপঠাকুরদার বাড়ি হলেও এই বাড়ির কর্তার কোনও মাথাব্যথা নেই বাড়ি নিয়ে।

কয়েকদিন ধরে টানা রিমঝিম শ্রাবণের ধারা পড়েই চলেছে। গতকাল একটু আকাশের সাদা মুখ দেখা গিয়েছিল বলে মানবী মনে মনে ঠিক করেছিল ভাঁড়ার ঘরটাকে ভাদ্র মাস পড়ার আগেই পরিষ্কার করবে। আজ শনিবার অফিসের তাড়া নেই। জয়ব্রত বাড়ি নেই, অফিস ফেরত শীতলপুর গেছে দাদার বাড়ি। কথা আছে ফিরবে রবিবার বিকেলে। নয়তো সোমবার অফিস করে। ইদানীং জয়ব্রতর বৌদির শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। নিঃসন্তান বড়দা একটুতেই উতলা হয়ে পড়েন। দু’দিনের জন্য বাড়িতে যদি একজনও আসে তাতে যেন বড়দার মনে জোর বাড়ে শতগুণ।

ভাঁড়ার ঘর সেই অর্থে এখন আর চাল-ডাল, মশলাপাতি, সংসারের মুদিখানার আঁতুড় নয়। এখন সেই ঘরে আলনা, ছোট একটা সাবেকি আলমারি, শাশুড়ি মায়ের বাসনের ট্রাঙ্ক, আনাজের ঝুড়ি, বড় মুড়ির টিন, গুড়ের কৌটো, নুনের জার, চার-পাঁচ রকমের আচারের বয়েম, হ্যারিকেন, বাড়তি জুতো, ভাঙা ছাতা, পা ছোট একটা চেয়ার- এককথায় বলতে গেলে সংসারের হাবিজাবি সবকিছুর ঘর। আধুনিক সুসজ্জিত একটি কিচেন মানবীর ঘরের কোলে নতুন করে করা হয়েছে। সোমবার থেকে শুক্রবার টানা অফিস থাকায় বাড়ির পুরোনো দিকটায় আসা হয় না। তারপরে যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাতে মাথা ভিজিয়ে বারবার উঠোন পার হয়ে যাওয়া-আসা করা যায় না। আর ছাতা মাথায় কাজ করা যায় না। এই নিয়ে মাঝেমধ্যে জয়ব্রতর সঙ্গে তর্কাতর্কি বেধে যায়। ভাঁড়ার ঘরের যেখানে যেখানে জল পড়ছে সেখানে আলনা থেকে পুরোনো কাপড় নিয়ে ফেলল মানবী। কাপড়ের ওপরে জল পড়ছে। সেই জল আর ছেটাচ্ছে না। খানিক ভেবে কোমরে আঁচলটা ঘুরিয়ে টাইট করে গুঁজে নিল। বাসনের ট্রাঙ্কটা যেই সরাল অমনি থপথপ করে দুটো ব্যাং বেরিয়ে এল। দুটো আরশোলাও শ্বশুরের ঘরের দিকে সরসর করে চলে গেল। বর্ষায় রসভঙ্গ হল বোধহয়। না জানি আরও কত পোকামাকড়ের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে দিদিশাশুড়ির সাবেককালের ভাঁড়ার ঘরখানি।

বাসনের ট্রাঙ্কটা টেনে সামনের দিকে আনতেই চোখে পড়ে গেল মানবীর বিয়ের ট্রাঙ্কটাকে। শ্বশুরবাড়িতে বিশেষ করে জয়ব্রতর একেবারেই পছন্দ হয়নি বিয়ের ট্রাঙ্কটি। অনেক কথাও শুনতে হয়েছিল ওই ট্রাঙ্ক নিয়ে। শুধু মানবীকেই নয়। দ্বিরাগমনে গিয়ে জয়ব্রত কথায় কথায় বিয়ের ট্রাঙ্কের কথা তুলেছিল। দুপুরে খাওয়ার পরে একঘর লোকের মাঝে শাশুড়িমাকে ‘দু’পয়সার ট্রাঙ্কটা না দিলেই কি চলছিল না?’ বলে এমন ঠেস মেরে কথা বলেছিল যে মানবীর মা রান্নাঘরে গিয়ে খুব কান্নাকাটি করেছিলেন। সেই দিন দুপুরে আর ভাত খেতে পারেননি। অপমানিত বোধ করলেন। তবুও নিজেকে কোনওভাবে সামলে মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে সহ্য করলেন জামাইয়ের সেই অপমানকে। অনেক বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘বাবা আমাদের মেয়ের বিয়েতে এই ট্রাঙ্ক দিতে হয়। আমার মা-ও দিয়েছিলেন। আমার শাশুড়ির মা-ও দিয়েছিলেন।’ কিন্তু কে কার কথা শোনে! ওই ট্রাঙ্ক নাকি জয়ব্রতর মান ডুবিয়েছে। কেউ কেউ নাকি এ-ও বলেছিল, এসবের চল এখন উঠে গেছে। আত্মীয়রা গা টেপাটিপি করেছিল। জয়ব্রতর এসব ভালো লাগেনি। ফুলশয্যার রাতেই সেই ট্রাঙ্কের কথা তুলেছিল। অবাক হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মানবী। শ্বশুরবাড়িতে আত্মীয়স্বজনের ভিড় ফিকে হয়ে আসতেই পুরো বাড়ি ঘুরেফিরে দেখে নেয় মানবী। নিজের ঘরটুকু ছাড়া আর কোথাও কোনও জায়গা ‘নিজের’ বলতে আছে কি না। ননদ, ভাশুর, বাইরের ঘর, শ্বশুর-শাশুড়ির ঘর বাদ দিয়ে ভাঁড়ার ঘরটিকে মানবীর বড় পছন্দ হয়েছিল। বড় আপনার মনে হয়েছিল। অসময়ের ঠিকানা মনে হয়েছিল। কত নিস্তব্ধ দুপুর কাটিয়েছে সে এই ভাঁড়ার ঘরে। জয়ব্রতর কথায় অপমানিত হলে আড়ালে চোখের জল মুছেছে।

 দুঃখ, অপমান আর অভিমানের ঝড়ে বিধ্বস্ত মানবী কোনও এক দুপুরে ফাঁকা বাড়িতে একেবারে চোখের আড়াল করে ফেলেছিল ট্রাঙ্কটিকে। জয়ব্রতর বিয়ের পরে ননদ শ্বশুর-শাশুড়িকে কয়েকদিনের জন্য নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। সেই সুযোগে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস রেখে বিয়ের ট্রাঙ্কটিকে ভাঁড়ার ঘরে বড় ট্রাঙ্কের পিছনে ঠেলে দিয়েছিল। তখন জানত না বড় ট্রাঙ্কে কী আছে বা কার জিনিস আছে। পরে জেনেছিল সাবেককালে ব‍্যবহৃত শাশুড়ি দিদিশাশুড়ির কাঁসার বাসন আছে। স্যাঁতসেঁতে ঘরে ধুলো, ঝুল, টিকটিকি-ইঁদুর-আরশোলা-ব্যাঙের দৌরাত্ম্যে প্রায় চেনাই যাচ্ছিল না বিয়ের ‘যৌতুক’টিকে। মা ওই ট্রাঙ্কে পাঠিয়েছিলেন মানবীর একান্ত প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আর শ্বশুরবাড়িতে এসে স্নান করে প‍রনের জামাকাপড়। জামাইয়ের আলাদা সুটকেস, আর তত্ত্বতালাশ তো ছিলই।

ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে বিয়ের ট্রাঙ্কটাকে চোখে পড়া মাত্রই বুকটা কেঁপে ওঠে মানবীর। দু’হাত লম্বা ও দু’হাত চওড়া টিনের এই বস্তুটির গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ধুলো ঝাড়তে লাগল। ভুলেই গেল জমাট বেঁধে আছে প্রায় আঠাশ বছরের ধুলোময়লা। রাগে অপমানে একেবারে চোখের আড়াল করে দিয়ে সময়ের টানে ভেসে গিয়েছে মানবী। চাকরিতে জয়েন করা, মা হওয়া, শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যু। ঝড়ের মতো দিন চলে গেছে। বাড়ির একপ্রান্ত, একাই পড়ে থাকে ঘরখানি। শ্বশুরের ঘর, ভাঁড়ার ঘর, জামরুল গাছ, মুরগির খাঁচা, পায়রার খোপ সব পড়ে থাকে একা। বৃষ্টিতে ভেজে, গরমে শুকোয়, শীতে শিশির মাখে। এদিকটায় খুব কমই আসা হয় এখন।  রান্নার লোক রান্না করে, আসে যায়। রবিবার করে এই ভাঁড়ার ঘর থেকে কোনও জিনিস প্রয়োজন হলে তার কিছুটা বিমলা নিয়ে গিয়ে নতুন কিচেনে রাখে। চার বাড়ি রান্নার কাজে সময় লাগে বিমলার। তাই কোনও বাড়িতে বেশি কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো জো নেই। দু’বেলার রান্নার কাজ সামলে সামনের মন্দিরে যায় রামায়ণ শুনতে। আবার একাদশীতে কখনো-সখনো হরিনাম সংকীর্তন শুনতে যায়। মন ভালো থাকে। শরীরে শক্তি পায়।

  এরপর মানবী নিজের ট্রাঙ্কটাকে টানতে গিয়ে দেখল বেশ হালকা। কী কী রেখেছিল আজ আর তা মনে নেই। টেনে ঝেড়েমুছে একটা নড়বড়ে রাখা চেয়ারে বসে ট্রাঙ্কটা খোলার চেষ্টা করল মানবী। জং ধরেছে শিকলে। একটু লড়াই চালাতে হল বৈকি। ভ্যাপসা গরমে মানবী ঘেমে অস্থির। একসময় খুলে যায় শিকল। বিশেষ কিছু নেই তো? একটু ভেবে মনে করতে লাগল। সেই তো শ্বশুরবাড়িতে এসে স্নান করে যে শাড়িটা পরেছিল আর তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক… চোখে পড়ল। বিয়ের আর বৌভাতের রাতে দুটো রুমাল, এবাড়ি-ওবাড়ি মিলিয়ে খান চারেক চিঠি।  খবরের কাগজে পাত্রপক্ষের দেওয়া বিজ্ঞাপন দেখে শেওড়াফুলি ও শ্যামবাজারের মধ্যে চারটি চিঠির আদানপ্রদান ঘটেছিল। চিঠিগুলো রেখে দিয়েছিল মানবী। সেইগুলো ট্রাঙ্কের ঢাকনার ভিতরের দিকে যে পকেট থাকে তাতে রেখে দিয়েছিল। আরও এক পকেটে বিয়েতে পাওয়া গিফট খাম আর শ্বশুরবাড়ির, বাবার বাড়ির দুটো বিয়ের কার্ড মুড়ে গোঁজা। নীচে সাইডের পকেটে বিয়ের আগে চাকরির পরীক্ষায় বসার কয়েকটি অ্যাকনলেজমেন্ট কার্ড, গানের ক্লাসের ফিজ দেওয়ার কয়েকটি বিল। বাবার বাড়িতে থাকাকালীন চাকরির পরীক্ষায় বসে সুখবরের শিকে ছেঁড়েনি। শ্বশুরবাড়ির লাঞ্ছনা সহ্য করেও মুখ বুজে চাকরির পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করে গিয়েছে। চাকরি পেয়ে বাবা-মাকে আশ্বস্ত করা ও শ্বশুরবাড়িকে নিজের জেদ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করা।

ট্রাঙ্কের ওপরের রংটা অবহেলায়-অযত্নে ধুলোময়লায় নষ্ট হয়ে গেলেও ভেতরের রংটা একই থেকে গিয়েছে। জামাকাপড়গুলো সরাতে চোখে পড়ল ফুলশয্যায় পরা শাড়িটা। মা একটা টুকটুকে লাল টাঙ্গাইল শাড়ি দিয়েছিল ফুলশয্যায় পরার জন্য। আচমকাই শাড়িটা তুলে নিল মানবী, একবারে নাকের সামনে ধরল। সেই রাতের গন্ধ পাওয়ার জন্য। মনে মনে হেসে ফেলল। আবার রাগে চোখে জল ভরে এল। আরও একটু নীচু হতেই হাতে ঠেকল শক্ত মতো কিছু। তাড়াতাড়ি কাপড়, ব্লাউজগুলো একটু সরাতেই চোখে পড়ল ‘পথের দাবী’ আর ‘গোরা’ বই দুটি। পাতা খুলে যাওয়া গীতবিতান। নতুন শ্বশুরবাড়িতে ওইগুলো অবান্তর মনে হয়েছিল।

বৌভাতের পরের দিন সব উপহার খুলে দেখেছিল আত্মীয়পরিজন। সবাই যে যার পছন্দের জিনিস তুলে নিয়েছিল। এতে জয়ব্রত খুব খুশি হয়েছিল। পড়ে ছিল তিনটে শাড়ি, একটা টেবিল ল্যাম্প আর গল্পের বই দুটো। ‘পথের দাবী’ বইটাকে জড়িয়ে ধরল বুকের কাছে মানবী। যেন চাটুজ্জেবাড়ির মেজোবৌ সুবর্ণলতার বুকের ওঠানামার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে মানবীর শ্বাসপ্রশ্বাস। কিশোরীতে লুকিয়ে পড়া ‘পথের দাবী’ মনে অনেক সাহস আর একলা পথের পথিক হওয়ার সাহস জুগিয়েছিল। আর সতেরো বছর বয়সে যখন নিয়মিত গঙ্গার ধারে একা গিয়ে বসত মানবী, তখন ‘গোরা’ শেষ করেছিল শেওড়াফুলি গঙ্গাকে সাক্ষী রেখে। একমনে মাথা নীচু করে পড়ছিল মানবী।  কী বই পড়ছিস? সচকিত মানবী উত্তর দিয়েছিল ‘গোরা’।  খুব পেকে গেছিস। বলে উঠেছিল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট পাড়াতুতো দাদা। ভয়ে শিউরে উঠেছিল মানবী। কিন্তু কেন শিউরে উঠেছিল তা মনে নেই।

ট্রাঙ্ক থেকে সব নামিয়ে ভালো করে ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করতে লাগল। হঠাৎ বিয়ে ঠিক হওয়ায় এই পঁয়ষট্টি টাকার বিয়ের ট্রাঙ্ক কিনতে বাবাকে না জানি কতঝক্কি পোহাতে হয়েছে। যাকে বলে গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়া। যৌথ পরিবারের আত্মীয়স্বজন প্রথমের দিকে হইহই করে উৎসাহ  দিয়েছিল। ‘পাত্র  ভালো, সরকারি চাকুরে। নিজের বাড়ি, হাতছাড়া কোরো না দাদা’। মানবীর বাবা সব ভাইদের ডেকে বলেছিল, ‘বিয়ের দায়িত্ব সকলে ভাগ করে নিলে চিন্তামুক্ত হওয়া যায়। জানিস তো তোরা আমার ইনকামের কথা’। কিন্তু না, সেই ‘ডাকা’কে কেউ পাত্তা দেয়নি। মানবীর ছোট বোন সবে উচ্চমাধ্যমিকের চৌকাঠ ডিঙিয়েছে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। দুটো ক্লাস টেনের টিউশনি করছে তখন। কলেজের গণ্ডি পার করে আর এগোতে পারেনি মানবী। ঈশ্বরদত্ত গানের গলার জন‍্য পাড়ায় বেশ নাম ছিল। খান চারেক গানের টিউশনি করত বিয়ের আগে। সেই সব টাকা তুলে দিত মায়ের হাতে।

বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। কিছু কেনাকাটা এগোচ্ছে না। প্রথম মাসের টিউশনির টাকা এনে বাবার হাতে দিয়ে মানবীর ছোট বোন বলেছিল, বিয়ের ট্রাঙ্ক দিয়ে শুরু হোক কেনাকাটা। শাড়ি, জামা নানা জিনিস কিনে এখানে রাখলে ভালো থাকবে। যা ইঁদুরের উৎপাত। বাবার সঙ্গে শেওড়াফুলির ঘাটের গেটের পাশের  ট্রাঙ্কের দোকান থেকে এক দুপুরে মানবীর বোন আর বাবা গিয়ে কিনে আনলেন ট্রাঙ্ক। অনেক দরদাম করে পঁয়ষট্টি টাকায় কেনা। বিয়ের জিনিস বলতে সেই ট্রাঙ্ক প্রথম ঘরে এল। সন্ধের দিকে একটু ফাঁক পেয়ে মায়ের খাটের তলা থেকে ট্রাঙ্কটা বের করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিল মানবী। ঢাকনার ভেতরের গায়ে দুটো পকেট। নীচে ডানদিক বামদিকে দুটো করে পকেট। ছাব্বিশটা চ্যাপ্টা স্ক্রু আর চারটে কব্জা দিয়ে তৈরি হয়েছিল ট্রাঙ্কটা। মা দেখে বলেছিল বেশ শক্তপোক্ত হয়েছে। বাইরের দিকের দুটো হ্যান্ডেল, একটু ঢেউ খেলানো। হলুদের ওপর হালকা বাদামি রঙের কলকা আঁকা ট্রাঙ্কের সারা গায়ে। ভেতরের দিকে গাঢ় বাদামি রঙের প্রলেপ। ভেতরের রং ঠিক থাকলেও বাইরেটায় অবহেলা আর অবক্ষয়ের চিহ্ন স্পষ্ট।

বাইরে আকাশ একটু পরিষ্কার হয়েছে। জামরুল গাছের ডালে দুটো কাক একে অন্যের পিঠ খুঁটে দিচ্ছে। এই ভাঁড়ার ঘরের উত্তর-দক্ষিণ দেওয়ালে দুটো জানলা আছে ঠিকই। কিন্তু মাটি থেকে এক মানুষ সমান উঁচুতে। তাই জানলার সোজাসুজি ডালে বসা কাক দুটোকে দেখে হেসে ফেলল মানবী। আজ নিজের মনে কাজ করে চলেছে। বিয়ের ট্রাঙ্কের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে। ফেলে আসা কিশোরীবেলার ছোঁয়া লাগল মনে। মায়ের আদর, বিত্তহীন বাবার অপদস্থ মুখ, সন্ধেতে একবাটিতে বোনের সঙ্গে মুড়ি খাওয়ার আনন্দ, পথের দাবী, গোরা, গীতবিতান… সব স্মৃতিগুলো যেন ভেসে উঠল বিয়ের ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে।

ছেলে এখন অন‍্য রাজ‍্যে পড়াশোনায় ব‍্যস্ত। শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরখানাকে একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে গানটা আবার শুরু করলে হয়। অফিস থেকে ফিরে তো তেমন কিছু কাজ থাকে না। আর যেদিন জয়ব্রত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফেরে সেই দিনই এক কথা দু’কথা থেকে ঝগড়া শুরু হয়। তার থেকে গানকে সঙ্গী করাই ভালো। গঙ্গায় বান এসেছে। উত্তাল জোয়ারের জল।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *