বিপর্যয়ে বসতে লক্ষ্মী

বিপর্যয়ে বসতে লক্ষ্মী

ভিডিও/VIDEO
Spread the love


  • দীপালোক ভট্টাচার্য

মাঝে মাঝে ‘এই বেশ ভালো আছি’ বলা আমিটা বেশ ফ্যাসাদে পড়ে। পকেট যথেষ্ট ভারী। আশপাশে বা অনলাইনে সুখ কেনার প্রয়োজনীয় ও প্রলুব্ধকর  উপকরণও হাজির। তবুও এই ‘আমি’র মাঝে মাঝে বড্ড ভয় হয়। অনলাইনে আনানো পছন্দের খাবার বিস্বাদ ঠেকে। প্রতিটা বিপর্যয়ের প্রতি মুহূর্তের আপডেট না দেখেও নিস্তার নেই, আবার দেখলেও সেটা ‘আমিও তো থাকতে পারতাম ওখানে’ গোছের ভয়ংকর পেসিমিস্টিক ভাবনা একটা তীব্র, দীর্ঘ, গভীর মন কেমনের জন্য যথেষ্ট।

 যতই ‘আজ আছি কাল নেই’ গোছের ভাবনা আমাদেরকে গ্রাস করুক, ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে। শুরুর দিন থেকে বারে বারেই সভ্যতাকে আঘাত হেনেছে বিপর্যয়। ৭৯ খ্রিস্টাব্দের কথাই ধরা যাক। তখন রোমান সাম্রাজ্যের সময়কাল। রোম শহরের অনতিদূরেই অবস্থিত পম্পেয়ী শহর। মাউন্ট ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল গোটা শহরটা। কোনও নাগরিকই বেঁচে রইল না। আরও এগিয়ে যাই প্রায় ১০০০ বছর। ১৭৮০ সাল। ক্যারিবিয়ান দ্বীপের একেকটি গোটা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেল হ্যারিকেন ঝড়ে। কয়েক মিনিটে শেষ প্রায় ২২ হাজার মানুষের জীবন।

এবারে চলুন, ঘুরে আসি তুরস্ক, সার্বিয়া এবং ম্যাসোডোনিয়া থেকে। ব্ল্যাক সি এবং আড্রিআটিক সাগরের মাঝে অবস্থিত এই অঞ্চল যেমন প্রাকৃতিক শোভার জন্য সুন্দর, তেমনি কুখ্যাত অন্য একটি কারণে। শুধু ১৯৭০ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে শুধু সার্বিয়াতেই ঘটে গিয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। আচ্ছা, আর একটু এগিয়ে আসি। ২০০৭ থেকে ২০১৬। এই ন’টি বছরে সার্বিয়াতে হয়ে গিয়েছে ২১টি ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সরকারি মতে,  ক্ষতিগ্রস্ত ২০৬৭৫৪ জন। ক্ষতির পরিমাণ ২ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার। এবারে তুরস্ক। বিশ দশকের গোড়া থেকে এযাবৎকাল পর্যন্ত বন্যা, ভূমিকম্প, ধসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে নিহত হয়েছেন ১০০৫৩৭ জন, আহত ৬১৫৯৭ জন। অন্যদিকে, ম্যাসোডোনিয়ায় বিপর্যয়ের সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতি বাকি দুটি দেশের তুলনায় তুলনামূলক কম। তবুও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়িয়ে যায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার।

তো, এই তিনটা দেশের উল্লেখ করা হল এই কারণে যে, একটি প্রখ্যাত মনস্তত্ত্ব নিয়ে চর্চা চালানো সংস্থা এই দেশগুলির ৫৩৭ জন তরুণ–তরুণীর মধ্যে একটি সমীক্ষা চালায়। উদ্দেশ্য- বিপর্যয় নিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের মনের মধ্যে দানা বাঁধা তীব্র ভয়, অসহায়তা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে টলিয়ে দিচ্ছে কি না, সেটা দেখা এবং এই ভয়ের কারণ অনুসন্ধান করা। সমীক্ষক  দলের প্রশ্নের যেসব উত্তর তারা দিয়েছে, সেখান থেকে পরিষ্কার- খারাপ আবহাওয়া, গণমাধ্যমে সম্প্রচারিত বিপর্যয় সংক্রান্ত নানান খবরাখবর, এবং আগে ঘটে যাওয়া কোনও না কোনও বিপর্যয়ের ভয়াবহ স্মৃতি, সেখান থেকে জন্ম নেওয়া একটি তীব্র ভয় – এক কথায় এক প্রকট ‘মন ভালো নেই’-এ আক্রান্ত তারা।

তবে অবস্থা ভেদে হয়তো আমরা ভয় পেতে ভালোবাসি কমবেশি সবাই। ধরুন, আপনি প্রেক্ষাগৃহে বসে আছেন, অথবা অন্ধকার ঘরে প্লে স্টেশন নিয়ে বসেছেন ভিডিও গেম খেলতে, এমন অবস্থায় আমরা অনেকেই কমবেশি চাইব একটু অ্যাড্রিনালিনের ক্ষরণ, অনুকূল পরিবেশে মস্তিষ্ক থেকে ক্ষরণ হওয়া ডোপামিনের কেরামতিতে তৈরি একটা ‘ফিল গুড’ অনুভূতি মনটাকে করে তুলুক ফুরফুরে। আমাদের মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স মাঝে মাঝে জানান দেয়, আরে ভায়া, এটা সত্যিকারের বিপর্যয় নয়, তুমি শুধু একটা খেলা খেলছ। বিপর্যয়ের মাঝে বেঁচে থাকা কিংবা মরে যাওয়ার খেলা।

এসব খেলাধুলো করতে গেলে কিঞ্চিৎ গাঁটের কড়ি খসাতে হবে বৈকি। রেসিডেন্ট ইভিল ভিডিও গেমটির কথাই ধরা যাক। ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী সারা পৃথিবীজুড়ে ১৩৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে এই প্লে স্টেশনভিত্তিক গেমটি। আর মোবাইল ফোনে খেলা যায় এমন গেমের হিসাব যদি কষা যায়, দেখা যাচ্ছে, আইডেন্টিটি ফাইভ বা একই ব্র্যান্ডের অন্যান্য গেম ২০২৪ সালের হিসেব অনুযায়ী ৭০০ কোটি মিলিয়ন ডলার মুনাফা কামিয়েছে।

ভিডিও গেমের তুলনায় সিনেমার দর্শকের সংখ্যা বরাবর বেশি। তো, প্রেক্ষাগৃহে কিংবা বাড়ির টেলিভিশন কিংবা ওটিটির নিরাপদ ঘেরাটোপে বসে আমাদের প্রথম পছন্দ কিন্তু মন ভালো করা ছবি নয়। অতীতে ঘটে যাওয়া কোনও বিপর্যয়কে নিয়ে নির্মিত ছবি, তথ্যচিত্র কিংবা ওয়েব সিরিজের বাজারদর চিরকালই বেশি। ১৯৯৭ সালে নির্মিত ‘টাইটানিক’ ছবির কথাই ধরা যাক। শুধু প্রেমের ছবি দেখতে মানুষ প্রেক্ষাগৃহ ভরায়নি। শেষ দৃশ্যের ভয়ংকর জাহাজডুবি, চরিত্রদের বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মাঝের সময়টুকু আমাদের অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ কতটা বাড়িয়েছে, সেটা দর্শকমাত্রই জানে। তবে বাণিজ্যের কথা যদি ধরা যায়, এই ছবির মোট ব্যবসার পরিমাণ ২.২৬ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ২০১২ সালে ভয়াবহ সুনামির প্রেক্ষাপটে  নির্মিত ‘দ্যা ইমপসিবল’ ১৯৮ মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করেছিল। ভয়ংকর আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতকে আধার করে ১৯৯৭ সালে নির্মিত ‘দান্তে’স পিক’ এর ব্যবসা ছাড়িয়ে গিয়েছে ১৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আসুন, এবারে সিনেমা কিংবা বাস্তবের নির্মিত জগৎ থেকে আবার নেমে আসি কাঠখোট্টা বর্তমানে। বেশিরভাগ সময় প্রতারণা করা স্মৃতিও মাঝে মাঝে জানান দেয় অতিমারির দিনগুলোর কথা। স্যানিটাইজারে বারবার হাত ধুয়ে টিভির পর্দায় চোখ রেখে ‘আক্রান্ত কত ছাড়াল?’র মতো প্রশ্ন খুব বেশিদিন আর নিরীহ থাকেনি। আক্রান্ত সংখ্যায় নিজে অথবা পরিবার পরিজনও জুড়ে গিয়েছিলাম অজান্তে। আর সেটা না হলেও শরীর স্বােস্থ্যর একটু এদিক-ওদিক হলেই ‘আমার হয়নি তো?’ গোছের এক অবশ্যম্ভাবী আতঙ্ক  গ্রাস করেছিল সবাইকে।

 ছোট-বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে হরেক পেশার মানুষের আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে যেতে দেখলেও আমাদের মনে চেপে বসা সেই আতঙ্ককে পুঁজি করেই মুনাফার পাহাড় গড়েছে কিছু বহুজাতিক সংস্থা। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কোভিড ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সংস্থা ফাইজার ২০২২ সালে  লাভ করেছিল ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রশ নামক পিসিআর টেস্ট কিট নির্মাতারও আয় বাড়ে কয়েক হাজার গুণ।

 তবে আশার কথা, মানুষ এই চেপে বসা ভয়কে ধীরে ধীরে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। নিজের ঘরেই খুঁজে নেয় কাজে ডুবে থাকার কিংবা আনন্দে থাকার উপকরণ। তবে আজকের বাজারে বিনে বাসায় আনন্দ পাওয়া দুর্মূল্য। ঘরে বসে বাজার করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা। অতিমারি ও তার পরবর্তী পর্যায়ে ই-কমার্স সংস্থা অ্যামাজনের আয় বাড়ে ৩৮ শতাংশ। মুনাফা দাঁড়ায় ৩৮৬ বিলিয়ন ডলারে। অনলাইন মিটিং সারার ব্যবস্থা করা কোম্পানি জুমের মুনাফা বৃদ্ধি হয় তিরিশ গুণ। বাড়িতে বসেই সিনেমা কিংবা সিরিজ দেখায় অভ্যস্ত হয়ে ২০২০ সালে ৩৭ মিলিয়ন নতুন মানুষ নেটফ্লিক্সের সদস্যপদ কেনে। মানুষের ইন্টারনেট আসক্তিকে কাজে লাগিয়ে রিলায়েন্স জিও শেয়ার বাজারের আমানতকারীদের থেকে তুলে নেয় ২০ বিলিয়ন ডলার।

আবার সেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে দুর্ঘটনা, যুদ্ধ কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের খবরের প্রতি মুহূর্তের আপডেট দেখা আমাদের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়। উপায়? একখানা বড় অঙ্কের টার্ম পলিসি কেনা যেতে পারে। সন্তান, পরিজন অন্তত দুধে ভাতে থাক। অথবা বড় অসুস্থতা জন্য বড় অঙ্কের স্বাস্থ্যবিমা। ফুটনোটে জানিয়ে রাখি, ফরচুন বিজনেস ইনসাইটস সংস্থার হিসেব অনুযায়ী ২০২৪ সালে স্বাস্থ্যবিমার মোট বাজারের আয়তন ২.১৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এসব দেখে মনে মনে স্কুলবেলার ব্যাকরণ বইয়ের পাতা খুলি। জীবনবিমা – জীবননাশের আশঙ্কায় বিমা – মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *