- মৌমিতা আলম
১
সকাল থেকে হাঁফ ধরেছে আলম পাগলির। একবার হাঁটু থুতনির কাছে নিয়ে এসে শোয় তো একবার পা সোজা করে। শান্তি মেলে না কিছুতেই। সুতির শাড়ি ঘামে ভিজে জবজবে। হাঁফ উঠলে গায়ে ব্লাউজটাও রাখতে পারে না। উদোম গায়ে ঝুলে পড়া স্তনদুটো হাঁফ ছাড়ার টানে দুলছে। কামারের হাপরের মতো ফুলছে, আবার চুপসে যাচ্ছে। কোঁচকানো চামড়ার ভাঁজ বেয়ে ঘাম নামছে। কালচে তামাটে প্রতিটা ভাঁজ কালোদিঘির শিঙি মাছের মতো লাগছে। খলুই ঝাড়লে যেমন শিঙি মাছ হাঁড়িতে পড়ে অল্প জলে একটা অন্যটার গা ঘেঁষে থাকে, তেমনই ভাঁজ।
উদোম গায়ে দিব্যি বসে আলম। খেদহীন, নিরুত্তাপ সেই বসে থাকা। বয়স হলে বোধহয় ঢেকেঢুকে রাখার সচেতনতাও লোপ পায়। সময়ের বোঝায় নিজের প্রতি উদাসীনতা বাড়ে। দারিদ্র্যও সয়ে যায় বয়সের সঙ্গে সঙ্গে। এক ‘ম্যানডেজ’ মাটির কাজের জন্য যুবতী বয়সে নেতাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরেছে আলম। কোলের বাচ্চা রেখে কোদাল নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টার থেকে ছাতু এনে খেয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবন, বহতা জীবন। যে জীবনের মূল্য রাষ্ট্রের কাছেও নেই, সমাজের কাছেও নেই। আগে পেটের টানে মায়ের প্রয়োজন হয়তো বা ছিল সন্তানদের, এখন আর তা নেই। আলম পাগলি এখন পরিবারের কুঁজ, অযাচিতভাবে থাকা এক মাংসপিণ্ড।
বাঁশের চাঙড়ার এক কোণে মরচে ধরা একটা ট্রাংক। ট্রাংকের উপর ছোপ ছোপ মরচের প্রলেপ, থেকে যাওয়া গুটিবসন্তের দাগের মতো। শুরুতে অবাঞ্ছিত মনে হলেও এখন যেন সেই দাগগুলো ট্রাংকেরই হিস্যা হয়ে গিয়েছে। এই ট্রাংকটাই বুড়ির জীবন। বুড়ি কাউকে ট্রাংক খুলতে দেয় না। যার বাড়ি থেকে যা পায়, সব ট্রাংকে। বিস্কুট থেকে সানলাইট পাউডার, সব ট্রাংকে ভরে।
ঘরের অন্যদিকে আর একটা চৌকি। সেই চৌকিতে শুয়ে কানে হেডফোন গুঁজে গল্প করছে বুড়ির মেজ নাতনি, জোছনা। তার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। বুড়ো মানুষের অসুখ গরিব পরিবারে একটা ব্যথাহীন টিউমারের মতো। আছে, কিন্তু তার উপস্থিতি ঘিরে কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। ধরেই নেওয়া যে, ধুঁকতে ধুঁকতে চলে যাবে একদিন। আলমের মাথার উপরের পাখাটা শতবর্ষ টিকে থাকা অনিচ্ছুক বুড়ো মানুষের মতোই উদাসীন। অল্প গরম বা বেশি গরম, কোনওটাতেই তার হেলদোল নেই। সে নিজের তাল, লয়ে ঘুরছে, আর বাতাসে ছেড়ে যাচ্ছে কেমন এক উদাসীনতার গন্ধ।
টলতে টলতে উঠল আলম। বাঁশের চাঙড়া বরাবর হাঁটতে গিয়ে মাথাটা ঘুরে গেল। প্রথম ঝটকা সামলে নিলেও, দ্বিতীয় ঝটকাটা আর সামলাতে পারল না আলম। পড়বি তো পড়, টাল সামলাতে না পেরে চৌকির কোণায় মাথা ঠুকে নীচে পড়ল বুড়ি। নড়বড়ে চৌকিতে না লাগলে, আর তাতে চৌকি নড়ে না উঠলে প্রেমে মশগুল জোছনা জানতেই পারত না যে, আলম পড়ে আছে মেঝেতে। বিরক্তি নিয়ে উঠল জোছনা। বুড়িকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে যারপরনাই বিরক্ত হল আর তারপর তার মোটা গলায় ডাক ছুড়ল, ‘হাগে মা, কোঠে গেছিত গে, আসি দেখেক বুড়ি নীচত পড়ি আছে। হাগি মুতি ঢলঢলাইছে।’
বুড়ির বড় বৌমা, হালিমার এখন খুব কাজ। অকালের বৃষ্টিতে ভুট্টাখেতে এক হাঁটু পানি। সেই পানিতে দাঁড়িয়ে ভুট্টা কেটেছে সাতদিন ধরে। তারপর ভুট্টা ছড়ানো আর শুকানো নিয়ে নাজেহাল অবস্থা হালিমার। সূর্য ডুবতে ডুবতে যে কমলা-লাল ছড়িয়ে যায়, তেমন রঙের ডাগর ডাগর ভুট্টা দানা চকচক করে ত্রিপলে।
‘উপরা মাগি তো কুনো কাজ করিয়ার পারে না। আর কাজ বাড়ায়। এলাকায় হাসপাতাল নিগাবে।’
গাল দিতে দিতে ঘরের দিকে ছোটে হালিমা। কোনওমতে বিছানায় উঠিয়ে চিৎকার জুড়ল আর এক প্রস্থ, ‘নাগে হাগে নাই মুতিছে। তোর বাপক ডাকা।’
জোছনা ছুটে যায় তার বাপকে ডাকতে। ততক্ষণে বুড়ির চিৎকার আর হালিমার গালাগালি শুনে দু-চারজন জমতে শুরু করেছে বাড়িতে।
বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল হানিফুল, আলম পাগলির ছোট ছেলে। সে চিৎকার আর বুড়ির গোঙানি শুনে বাড়ির উঠোনে এসে এদিক-ওদিক একটু তাকিয়ে নিয়ে ঘরে ঢোকে।
হানিফুল পাগলিকে দেখেই বলে, ‘তুমরা যদি ট্রিটমেন্ট করিবার না পান, মোক দাও। মুই করিম… বুড়িটার ভাতার টাকা খাবার ঠিক খাচ্ছেন…’
কথাটা নুনের ছিটার মতো গিয়ে লাগল হালিমার গায়ে। দেবর-ভাবির সম্পর্কটা এমনই যে পাশাপাশি দু’দণ্ড থাকলে ঝগড়া অবধারিত। হালিমা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘যদি তোর এত দরদ তোর মাইয়াক পেঠে দে। বুড়ির গু-মুথ ধৌক।’ হানিফুলের মুখটা চুপসে গেল একটু। তারপরেই, আর দশটা পুরুষ মানুষের মতোই, আহত হলে সেটা ঢাকবার জন্যই আরও বিপুল আগ্রাসন নিয়ে চিৎকার করে, নয়তো মারপিট। উলটোদিকে মহিলা বলেই হয়তো হাতাহাতিতে না গিয়ে মুখেই যতটা সম্ভব চিৎকার করল হানিফুল, ‘তুই আর তোর নাং মিলি বুড়ির বিধবা ভাতার পাইসালা খাছেন আর মুই করিম চিকিৎসা!’
এই শুনে হালিমা আর জোছনা দুজনেই তারস্বরে চিৎকার করে উঠল।
‘হামরা আর কোঠে খামো পাইসা? হামার বাড়িত বুড়ি থাকে আর তোর গান গায়। তুইতো ফুদুরগুদুর করি বুড়ির থেকি পাইসা নিস।’
এই কথা আর হানিফুলের সহ্য হল না। সে ঘরের বারান্দার বাঁশের খুঁটিতে দিল এক লাথি। পুরো ঘর নড়েচড়ে উঠল। ‘হামার ঘর ভাঙি দিল গে’ বলে ককিয়ে কেঁদে উঠল হালিমা।
বাড়ি থেকে দুই মাঠ দূরে ভুট্টাখেতে নজরুল ভুট্টা কাটছিল। জোছনার চিৎকার দু’মাঠ দূর থেকেও আবছা যেন শুনতে পেল। হাতের কাঁচিদাটা থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকাল। আবছা দেখতে পেল বাড়ির চারপাশে দু-চারটে লোক জমেছে। সে আর কিছু না ভেবে, হাতের কাঁচিদা নিয়েই বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।
হালিমা আর হানিফুলের ঝগড়া ততক্ষণে ব্যক্তিগত থেকে আরও ব্যক্তিগত স্তরে পৌঁছাচ্ছে।
‘শালির বেটি শালি, তোর মুখত পোকা নাগিবে।’
হানিফুলের বানের মতো শব্দে আরও ক্ষেপে উঠে হালিমা মোক্ষম জবাব দিচ্ছে। লড়াই তখন একদম সামনাসামনি।
‘তুর মতন আলগা মরদের মুখত মুতি দাও।’
মুখ দিয়ে আগুন ঝরানোর সঙ্গে সঙ্গে, রাগে কাউকে থেঁতলে দেওয়ার মতো করে বা পা দিয়ে মাটি থেঁতলে দিচ্ছে হালিমা।
ঝগড়া তখন তাল-লয়ে বেশ জমে উঠেছে। আশপাশের লোক জমা হয়ে তাই দেখছে। ঘরের ভিতরে ক্রমশ কমে আসা বুড়ির গোঙানিতে কারও ভ্রূক্ষেপ নেই।
২
নজরুল দু’মাঠ পেরিয়ে দাওয়ায় ঢুকেছে কেবল, তার পা ভর্তি মাটি। কাঁচিদাটা হাতেই তখনও। বাইরে প্রখর রোদ। তার সাদা গেঞ্জি ঘামে ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপটে। সে গেঞ্জিটা খুলে উঠোনের কাপড় শুকানোর তারে রাখল। হাত দুটো মাটিতে ঘষে নিয়ে কলের পাড়ে হাত ধুয়ে, বারান্দায় ঝোলানো গামছায় হাতটা মুছল।
হালিমা বিবি নজরুলকে দেখে আরও জোরে সুর চড়িয়ে তার ভাইয়ের, আর তার মায়ের বাপ-বাপান্ত করতে লাগল।
আলম পাগলির বিধবা ভাতার টাকা নিয়ে হালিমাদের ক্ষোভ বহুদিনের। বুড়ি এর বাড়ি ওর বাড়ি চেয়ে খায়, টাকা তো খরচ হয় না, তাহলে টাকা কী হয়? সন্দেহের তির সবসময় ছোট ছেলে হানিফুলের দিকে। হানিফুল ফুসলিয়ে টাকা নেয়– এই ধারণার বশে নজরুলের ছেলে, মেয়ে আর হালিমা বিবির সঙ্গে আলমের ঝগড়া লেগেই আছে।
পাশের বাড়ির ছামিনা বেওয়াও ঝগড়া শুনে আসে। কিন্তু সে উঠোনে না থেমে হনহন করে হেঁটে ঘরের ভিতর ঢুকে যায়। আলম আরার চাঙড়ার শেষে তার পায়ের কাছে দাঁড়ায়। একটা আঁশটে গন্ধ ঘরে। কেমন যেন মৃত্যুর আগের গন্ধ। অনেকক্ষণ আগে করা পেচ্ছাপের গন্ধ বাতাসে থিতু হয়ে যেন জমে গিয়েছে। আর ঘরের পেছনের দিঘিতে থাকা পচা পাটের গন্ধ সেই জমে থাকা গন্ধের উপর আরেকটা স্তর ছড়িয়ে পুরো বাতাসের দখল নিয়েছে।
ছামিনা আর আলম প্রায় এক বয়সি। একটা বিড়ির ল্যাজ দুজন মিলে ভাগ করে খেয়েছে কত। কত আকাল, বন্যা, মৃত্যু, খরা পার করেছে। আলমের মতো সেও স্বামী হারিয়ে ছেলেদের মাঝে। সে ঘরে ঢুকে আলমের পায়ের কাছে খানিক দাঁড়িয়ে, পায়ে হাত দিতেই কেমন ঠান্ডা হয়ে আসার আগাম শীতলতা টের পেল।
আলমের নিশ্বাস দুপুরে বাঁশঝাড়ের ভিতর বয়ে চলা বাতাসের মতো একটা শিস দেওয়া হালকা আওয়াজ তুলছে। একটি শ্বাসের আওয়াজ পরের শ্বাসের ব্যাপারে অনিশ্চয়তায় রাখছে যেন। চোখ দুটো ঘরের টুহিতে স্থির। টিনের নীচে সিলিং দেওয়া নেই। তাই টিনের চালের ফুটো দিয়ে ঝাঁঝরি পার করে যেমন আলো আসে, তেমন আলো ভিতরে ঢুকছে। আলোর সামান্য ফুটো হলেই চলে। গলে যায়। ছামিনা চিৎকার জুড়ল, ‘তুমরা ঝগড়া করি মরো! আর আলম এদি যায়!’
ছামিনার আর্তনাদ শুনে ঝগড়ার তালে ছেদ পড়ে। ঝগড়া ফেলে রেখে সবাই দৌড়ায় ঘরে।
আলম পাগলি একবার শরীরটা মোচড় দিয়ে, হাতের মুঠো শক্ত করল। যেন সব শক্তি দিয়ে শরীরটাকে আর একবার চাগিয়ে দিতে চাইল। তারপর মুখটা বাঁদিকে হেলে গেল। মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল লালারস। সকালে খাওয়া লাল চায়ের সঙ্গে পেটের পিত্তরস মিশে এক ধরনের লালচে হলুদ সান্দ্র তরল। মুখটা বেঁকে যাওয়ার পর মিনিট পাঁচেক কেউ কিছুই বলল না। হানিফুল বুড়ির মাথার কাছে দাঁড়িয়ে। নজরুল এসে ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। মায়ের ঘরে সে ঢোকেনি অনেকদিন। শেষ মা বলে কবে ডেকেছে, সেটাও মনে করতে পারে না।
ছামিনা হাতের নাড়িটা দেখল। তারপর আলগোছে আস্তে নিজেকেই যেন বলল, ‘না, নাই।’
কথাটি আস্তে বললেও সেই শব্দের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভার আচ্ছন্ন করল চারিদিক।
এই দুটো শব্দের রেশ হানিফুল আর তার ভাবি হালিমা দুজনকেই সমানভাবে গ্রাস করল। দুজনেই একসঙ্গে গোঙিয়ে কেঁদে উঠল। কিন্তু সেই কান্নার ভারের মধ্যে আকস্মিকতা থাকলেও আন্তরিকতা ছিল না। একটু কান্নার রোল উঠেই চুপ হয়ে গেল।
নজরুল একবার আর একটু ভিতরে এসে দেখেই বাইরে বেরিয়ে গেল। বড় ছেলে হিসেবে এবার তার দায়িত্ব পালন করার পালা।
৩
ইমাম সাহেব এলেন। পাটকাঠি দিয়ে মাপ নেওয়া হল বডির। সবাই নিজের হাত দিয়ে মেপে সাড়ে তিন হাতের হলেও, মৃত্যুর পর এই মাপ হয় বডির দৈর্ঘ্য অনুযায়ী। ইমাম সাহেবের পাশেই দাঁড়িয়ে দুজন, তারা কবর খুঁড়তে যাবে। ইমাম সাহেবের হাত থেকে পাটকাঠি নিয়ে নজরুলের দিকে তাকাল একজন। সেই তাকানোর অর্থ বুঝল নজরুল। সে ডান হাত তুলে দেখিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘ইজমালি গোরস্থানের পুব দিকত আব্বার কবর। আব্বার গোরের পায়ের পাখে অংশ খালি আছে। সেইঠে খুড়েন।’
নজরুলের পায়ের পাশে বসে ছিল হালিমা। আর তার পাশে বাঁশের খুঁটি ধরে গোবরজান পাগলি। নজরুলের কথা শুনে ঘোমটা কপালের দিকে টেনে নিয়ে নিজের মনেই বলল, ‘বুড়ি বিধবা হইছে মেলা বছর। এইবার বুড়ি স্বামীর পায়ের তলে থান পাবে। জান্নাত নসিব হবে।’
মৃত্যু আর জন্মের মধ্যে মিল একটাই। দুটো খবরই মানুষকে নিজের অন্তরের অন্দরে নিয়ে যায় খানিকক্ষণের জন্য। মানুষ একটু থমকে গিয়ে ভাবে। কিন্তু হালিমার শাশুড়ির এই মৃত্যুর দিনেও হালিমার ভ্রূক্ষেপ নেই। গোবরজানের কথা শুনে এতক্ষণ চুপ করে থাকা হালিমার বুকে জমে থাকা শুকনো বিচুলিতে যেন আগুন লাগল। সে ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘ঐ চোগলখোর বুড়ি যাবে জান্নাত! শালি সারাজীবন ছোট ব্যাটাক ভাতা খোয়া আসিল। হামার ছাওয়ালাক এক টাকাও দিল না।’
ভাতার কথা কানে যেতেই একটু যেন নড়েচড়ে বসল নজরুল। কাফন কিনতে হবে, সঙ্গে গোলাপ জল, আতর আর ধুপকাঠি।
অনেকক্ষণ কিছু না বলার জন্য মুখ কেমন শুকনো হয়ে গিয়েছিল। জমা থুতু ডান দিকে মুখ বাড়িয়ে ফেলল। সেই থুতু মাটির ধারির দিকে ছুটে গিয়ে পড়ল। থুতু ফেলে একটু গলা খেঁকরে নিয়ে ঘরের মৃতদেহের পায়ের কাছে বসা হানিফুলের উদ্দেশ্যে নাম না করে জোরে বলল, ‘মাটি দিবার কাপড় কিনিবার নাগিবে। কাপড় কেমন করি কিনা যায়, সবায় মিলি ভাবিবার নাগিবে।’
‘হারে বাউ তোমার মার ট্রাংকটা ভাঙি দ্যাখো। বিধবা ভাতার টাকা যদি থাকে কিছু।’
ছামিনার কথা শুনে হালিমা ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল, ট্রাংক খোলার উদ্দেশ্যে।
‘শালির বুড়ি হামাক এত অবিশ্বাস! ট্রাংকের চাবি গোছা নুকি থুবে!’
ট্রাংকে বড় তালা দেখে আর এক প্রস্থ গাল দিল হালিমা। আলম বুড়ির ট্রাংকের চাবি কোথায় থাকতে পারে, তা যেন আন্দাজ করতে পারল ছামিনা। তারপর আলমের পায়ের কাছে গিয়ে কোমরে হাত দিল। পাতলা পায়খানার এক আঁশটে গন্ধ মুখে লাগল ছামিনার। সে বুঝতে পারল, মরার আগে বুড়ি শেষবারের মতো মল ছেড়ে গিয়েছে। কোমরে-বাঁধা মাদুলির দড়ির মতো একটা দড়ি দেখল। একটু বাঁ দিকে কাত করতেই দেখতে পেল সেই কালো সুতোর সঙ্গে ঝুলে আছে একটি চাবি। জীবিত মানুষের শরীরের সুতো কাটতে হয় না, ছামিনা জানে। কিন্তু আলমের ঠান্ডা গুয়ে মাখা শরীর থেকে এক ঝটকায় সুতোটা ছিঁড়ে চাবিটা বের করল ছামিনা।
তারপর ট্রাংকের তালায় চাবি গলাতেই খুলে গেল ট্রাংক। হালিমা বিবি ট্রাংকে রাখা জিনিস সব ওলটপালট করতে শুরু করতেই ছামিনা পুরো ট্রাংক তুলে নিয়ে এসে উঠোনের মাঝে ঢেলে দিল। অমনি একটা কুঁচকুচে তেলাপোকা হঠাৎ কেউ ঘুম ভাঙালে যেমন দিগ্বিদিকশূন্য লাগে, তেমনই হঠাৎ ধাক্কায় কোনদিক যাবে বুঝতে না পেরে বার কয়েক ফেলে রাখা জিনিসের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের পা গলে বেরিয়ে যাবে বলে ভাবছিল। হতভম্ব তেলাপোকাটাকে দেখে ছামিনার ছয় বছর বয়সের নাতি তার হাওয়াই চপ্পল পরা পা দিয়ে সেটাকে পিষে দিল। পোকাটার নাড়িভুঁড়ি সব তার জুতোর তলায় আটকে গেল, মাটিতে এক বিন্দু পোকা ছাপের দাগ ছাড়া আর কিছুই রইল না।
ওলটানো ট্রাংক সরাতেই পাওয়া গেল খান দুয়েক হলদেটে শাড়ি, দলা পাকিয়ে তার মধ্যেই দুটো ব্লাউজ, অর্ধেক খাওয়া বিস্কুটের প্যাকেট, একটা দশ টাকা দামের ছোট লাক্স সাবান। কিন্তু টাকার দেখা নেই। একটি শাড়ি তুলে ঝাড়তেই থপ করে উঠোনে পড়ল সানলাইটের প্যাকেট মোড়া কিছু একটা। হালিমার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। এটাই বুঝি আলম বিবির জমানো বিধবা ভাতার টাকা! পাওয়া গেল অবশেষে!
প্যাকেট ঝাড়তেই ঝুরঝুর করে পড়ল ইঁদুরে কাটা ব্যাংকের পাশবইয়ের অর্ধেক আর তার সঙ্গে তিনটে সদ্য জন্মানো গোলাপি রঙের ইঁদুরের বাচ্চা। মাটিতে পড়ে একটু ক্যাঁত করে উঠে ওখানেই পড়ে রইল। ট্রাংকে কিছুই না পেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হালিমা থম মেরে গেল।
৪
তখনই বাড়িতে ঢুকল সগেন প্রধান। কোনও বাড়িতে মৃত্যু হলে সগেন প্রধান মাইয়ত দাফন হওয়ার আগে যায় একবার। প্রধান এলে দাওয়ায় বসতে দিল কেউ একজন।
উঠোনে পড়ে থাকা ব্যাংকের অর্ধেক বই দেখে সগেন আপন মনেই বলল, ‘বুড়িটা আজি দুই বছর থাকি নাম ঠিক করিবার তানে ঘুরেছে। কিন্তু নাম মিলে তো ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলে না। থালি বাসন মাঞ্জিতে মাঞ্জিতে আঙুল ক্ষয়া গেইছে। আধার মেশিনত আঙুলের ছাপ মিলে না। ভাতাটা বন্ধ হওয়া আছে ম্যালা দিন!’
সগেনের কথা শুনে কেউ আর কোনও কথা বলল না।
ইঁদুরের বাচ্চাগুলো আরও একবার নড়ে উঠল যেন। কিন্তু পালাতে পারল না। কেউ একজন ঝাঁটা এনে ঝেঁটিয়ে দিল। ঝাঁটার বাড়ি খেয়ে শেষবারের মতো ক্যাঁত করে উঠল আর একটিবার।