বিজ্ঞানমনস্কতায় বাধা

বিজ্ঞানমনস্কতায় বাধা

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সাড়া জাগানো বিস্ময় হল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রতিদিনই কিছু না কিছু নতুন হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে। সাহিত্য থেকে সিনেমা, রাজনীতি থেকে খেলা, পড়াশোনা থেকে পেশাদারি কাজকর্ম- সবকিছুতেই এআই-এর ব্যবহার বাড়ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভারতও কখনও পিছিয়ে থাকেনি। কিন্তু সমস্যা এখন অন্য। বিজ্ঞানসাধনার জন্য যে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রয়োজন হয়, সেখানেই বারবার কৌশলে আঘাত করা হচ্ছে।

মানুষের ধর্মবিশ্বাস, ভক্তিভাব, পুরাণকথার সঙ্গে দিব্যি মিশিয়ে ফেলা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সত্যকে। এভাবে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার প্রতি একপ্রকার অবিশ্বাস তৈরির চেষ্টা চলছে ভারতে। দুর্ভাগ্যজনক হল, রাজনীতিকদের একাংশ এই তৎপরতায় মদত দিয়ে চলেছেন। বিজেপি সাংসদ অনুরাগ ঠাকুর, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানদের সাম্প্রতিক মন্তব্য বিজ্ঞানমনস্কতায় ধাক্কা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

অনুরাগ প্রচার করছেন, সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার ইউরি গ্যাগারিন নন, বিশ্বের প্রথম নভশ্চর ছিলেন পবনপুত্র হনুমান। অপরদিকে শিবরাজ বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করছেন যে, আমেরিকার রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের আবিষ্কার নয়, বিশ্বের প্রথম বিমান ছিল রামায়ণে কথিত পুষ্পক রথ। ইউরি গ্যাগারিন বা রাইট ভাইদের বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলি এদেশের ছেলেমেয়েদের স্কুলপাঠ্যে ছিল। রামায়ণ, মহাভারতের গল্প ভারতের প্রায় সকলেই জানেন। হনুমানের তত্ত্ব আমদানি করে ইউরি গ্যাগারিনের কৃতিত্বকে ম্লান করে দেওয়া তাই সত্যের অপলাপ মাত্র।

মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে ইউরি গ্যাগারিন, নীল আর্মস্ট্রং প্রমুখ অতিপরিচিত নাম। রাকেশ শর্মা থেকে শুভাংশু শুক্লাও ভারতের মহাকাশ গবেষণায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। চন্দ্রযান, মঙ্গলযান, আদিত্য এল-১, গগনযান ইত্যাদিতে ভারতের মহাকাশ সাধনার বিজয়রথের গতি ক্রমে ঊর্ধ্বমুখী। এই পরিস্থিতিতে মহাকাশ গবেষণা সম্পর্কে স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের মধ্যে আগ্রহ জাগিয়ে তোলা আরও বেশি করে জরুরি।

সেজন্য বিজ্ঞানসাধনার প্রতি ভারতীয়দের ভালোবাসা এবং আস্থা বাড়িয়ে তোলা প্রয়োজন। কিন্তু হনুমানকে বিশ্বের প্রথম নভশ্চর বলে প্রচার করা হলে শুধু বৈজ্ঞানিক তথ্যকে অস্বীকার করা হয় না, বিজ্ঞানমনস্কতায় ধাক্কা দেওয়া হয়। প্রযুক্তিসর্বস্ব দুনিয়ায় এসব প্রচারের ফল কিন্তু মারাত্মক। বিজেপি নেতারা বিকশিত ভারত গড়ার প্রচারে সবসময় বিজ্ঞান গবেষণার উন্নয়নে জোর দেন।

বাস্তবে পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনীর সঙ্গে বিজ্ঞানকে গুলিয়ে ফেললে সত্যের বিকৃতি অবশ্যম্ভাবী। সরকার মহাকাশ গবেষণা প্রসারের কথা বলছে। বিজ্ঞানসাধনার জয়গান গাইছে। প্রযুক্তির দুনিয়ায় সেরা হওয়ার দৌড়ে এগোনোর প্রয়োজনীয়তার পক্ষে সওয়াল করছে। অথচ শাসকদলের নেতারাই হনুমান, পুষ্পক রথের উদাহরণ টেনে অদ্ভুতভাবে সত্যের বিপরীত ছবি তুলে ধরতে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

একটি ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার মরিয়া চালানো হচ্ছে যে, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সহ সর্বক্ষেত্রে অতীতে ভারত শীর্ষস্থানে ছিল। অতীতের শাসকদের অদূরদর্শিতায়, সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির কারণে সেই স্থান ধরে রাখা যায়নি। ভারত অতীতে অবশ্যই একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ ছিল। সেই সমৃদ্ধির কারণে এদেশে বারবার বহিরাগতরা আক্রমণ করেছিলও বটে। এদেশের ধনসম্পদ তারা লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। এই সত্য নিয়ে কোনও দ্বিমত না থাকলেও এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে বিজ্ঞানসাধনায় ভারতও এগোনোর চেষ্টা করেছে।

নানা সমস্যা, প্রতিকূলতা থাকলেও নতুন নতুন ক্ষেত্রে অনুসন্ধিৎসু মনোভাব নিয়ে ভারতে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা এগিয়েছে। শূন্য আবিষ্কার করা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রে পা রাখা ইত্যাদি বিজ্ঞানচর্চায় ভারতের অগ্রগতির হাতেগরম প্রমাণ। অনুরাগ ঠাকুর, শিবরাজ সিং চৌহানদের মন্তব্য এই সাফল্যগাথায় এক গামলা দুধে এক ফোঁটা চোনা ফেলে দেওয়ার মতো। যাতে বিজ্ঞানমনস্কতাই ধাক্কা খায়। দায়িত্বশীল পদাধিকারীদের, বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিরা এরকম অসচেতনতার পরিচয় দিলে বিজ্ঞানমনস্কতা ছড়িয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে ওঠে নিঃসন্দেহে। এতে জনসাধারণ বিভ্রান্ত হয়। যা যথার্থ বিজ্ঞানচর্চায় প্রতিরোধের দেওয়াল গড়ে তোলে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *