- পূর্বা সেনগুপ্ত
দারুমূর্তির প্রসঙ্গে যে সব বিখ্যাত দেবালয় ও তার আরাধ্য মূর্তির কথা নিয়ে সাধারণত আলোচনা করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম বাঁশবেড়িয়ার দেবী হংসেশ্বরী। যদি আমরা এমন কোনও গৃহদেবতা বা দেবালয়ের কথা জানতে চাই, যে দেবালয়কে কেন্দ্র করে সাহিত্যিক তাঁর উপন্যাস রচনা করেছেন, কিংবা বিখ্যাত শিল্পী সেই মন্দির খুঁজে পেয়েছেন তার শিল্পকর্মের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ তবে আমাদের কাছে দেবী হংসেশ্বরী মন্দিরই একমাত্র উদাহরণ।
সত্যিই এই দেবালয় গঠনের কাহিনী এক উপন্যাসের মতোই ঘটনাবহুল। তার ওপর একই মন্দির চত্বরে দুটি ভিন্ন আকৃতির, ভিন্ন ধরনের, ভিন্ন যুগের মন্দির বিরাজিত। ভাব কর্মকে প্রভাবিত করে, নাকি কর্ম গঠন করে একটি ভাবের– এ নিয়ে পণ্ডিতদের তর্ক প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। আমরা দেবালয়ের দেবাঙ্গনে আলোচনায় আশ্চর্যভাবে লক্ষ করি একটি ভাবনা অনুযায়ী গড়ে উঠছে একটি দেবালয়, কিন্তু সেই দেবালয় গঠনের আঙ্গিকে রয়ে যাচ্ছে সেই যুগের প্রবণতা। জগতের দুঃখকষ্ট অলৌকিক উত্তরণ খোঁজে আর তার থেকে যে জিজ্ঞাসা তৈরি হয় তাই আমাদের দেবালয় গঠনের মূল ভিত্তি।
আজ আমরা প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে ডুব দেব। এক দেবদত্ত পরিবারের সদস্য দ্বারিকানাথ তাঁদের দত্তবাটী থেকে বর্ধমান জেলার পাটুলিতে বসতি স্থাপন করেছিলেন। শোনা যায় রাজা আদিসুরের সময় কান্যকুব্জ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণের সঙ্গে কায়স্থ দত্তদের আগমন হয়েছিল এই বঙ্গে। কেন তাঁরা ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এসেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
আমরা এমন একটি পরিবারের ইতিহাস আলোচনা করব যাঁরা বাংলায় অদ্ভুত এক মন্দির গঠন করেছিলেন যে মন্দিরের গঠন ও দেবীরূপ আজও বাঙালির মননে গুরুত্বপূর্ণ স্থান গ্রহণ করে আছে। দ্বারিকানাথের বেশ কয়েক উত্তরপুরুষের পর আসেন জয়ানন্দ। তিনি সম্রাট আকবরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সম্রাট আকবর জয়ানন্দকে ‘রায়’ উপাধি প্রদান করেন। তখন থেকে এই পরিবার দত্ত ছেড়ে ‘রায়’ পদবিতে পরিচিত হতে থাকেন। জয়ানন্দ রায়ের পাঁচ পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন রাঘব রায়। তিনি কোনওমতে জাহাঙ্গিরের আমলে, ভিন্ন মতে শাজাহানের আমলে মোগলদের কাছ থেকে ‘চৌধুরী’ উপাধি লাভ করেন।
এই সময় একুশ পরগনা থেকে মোগলরা সঠিক কর লাভ করতে পারতেন না। এই তথ্য সম্রাট শাজাহানের কাছে গেলে তিনি রাঘব রায়কে জমিদার নিযুক্ত করে একুশ পরগনার শাসনক্ষমতা দান করেন। এর সঙ্গে রাঘব রায় পান ‘মজুমদার’ উপাধি। এই পরিবার– দত্ত, রায়, চৌধুরী ও মজুমদার এই উপাধি লাভ করেন। যদিও রায় উপাধি লাভের পর এই পরিবার কখনোই দত্ত পদবি ব্যবহার করতেন না। কাহিনী শুরু রাঘব রায়ের পরবর্তী প্রজন্ম থেকে।
রাঘব রায়চৌধুরী মজুমদারের দুই পুত্র। রামেশ্বর রায়চৌধুরী ও বাসুদেব রায়চৌধুরী। এর মধ্যে বাসুদেব প্রথম সম্পত্তির বিভাগ চাইলেন বা নিজের অধিকারে কতটুকু সম্পদ আছে তা বুঝে নিতে চাইলেন। রামেশ্বর যেহেতু বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন সেহেতু তিনি সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পেলেন আর বাসুদেব পেলেন এক-তৃতীয়াংশ। রামেশ্বর শুধু সম্পত্তির অধিকার সহোদরকে দিলেন না, তিনি বর্ধমানের পাটুলি ত্যাগ করে গঙ্গার তীরে একটি স্থানকে বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট করলেন। চলে এলেন বর্তমানের হুগলি জেলায়।
আমরা আগেই দেখেছি, রামেশ্বরের পূর্বপুরুষরা মোগল সম্রাটদের খুবই অনুগত ও বিশ্বাসভাজন ছিলেন। এই কারণে এই পরিবার তিন-তিনটি উপাধি লাভ করে, তার সঙ্গে জমিদারি। কিন্তু রামেশ্বরের জমিদারি পরিচালনার ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন সমস্যা দেখা দিল। রামেশ্বর দেখলেন, একুশটি পরগনার লোকেরা মোগল সম্রাটকে এখনও কর দান করায় আগ্রহী নয়। তাঁরা জমিদারকে এত কম কর দান করেন, যার ফলে জমিদার মোগল সম্রাটদের সঠিক কর প্রদান করতে অক্ষম হয়। তিনি এই কথা সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে জানালেন। এই সমস্যার সমাধান করার জন্য ঔরঙ্গজেব তখন রামেশ্বরকে রাজামশাই উপাধি প্রদান করেন। রামেশ্বর রায়চৌধুরী মজুমদারের আগে তখন থেকে রাজা লেখা হতে শুরু করে।
এই পরিবার একুশটি পরগনার শাসনভার লাভ তো আগেই করেছিলেন ঔরঙ্গজেবের ফরমান অনুসারে তখন থেকে আরও বারোটি পরগনা শাসনের অধিকার লাভ করেন। তার সঙ্গে চারশত এক বিঘা বা ১৬০ একর জমি নিঃশুল্ক বাস্তুজমি লাভ করেন। রাজা উপাধি লাভের পরই রামেশ্বর জমিদারবাটী নির্মাণের সূচনা করেন। আজ যার মূল ফটক থেকে বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে আছে। রাজা রামেশ্বর রায় বংশবাটী বা আজকের বাঁশবেড়িয়ায় বসতি স্থাপন করেছিলেন।
কেন এই স্থানের নাম বংশবাটী হল সে প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তখন ছিল মারাঠা বর্গীদের দস্যু রূপে লুঠতরাজের সময়। বাংলার জমিদার ও রাজারা বর্গী আক্রমণ নিয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। রামেশ্বর রায়ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি পাটুলি ছেড়ে রাজা রূপে নতুন রাজত্ব পত্তন করতে বাস্তু নির্মাণের জন্য যে চারশত এক বিঘা জমি পেয়েছিলেন সেই জমির চারধারে পরিখা তৈরি করেছিলেন। আর পরিখা আবৃত্ত ছিল বাঁশের কাঠামো দিয়ে, ঠিক যেন বাঁশে আচ্ছাদিত একটি বাটী বা বাড়ি। আত্মরক্ষার জন্য বাঁশের এরকম ব্যবহার করা হয়েছিল বলে স্থানটিকে বংশবাটী বলা হত। কালক্রমে তা বাঁশবেড়িয়া রূপ লাভ করে। আবার ভিন্ন মতে, এই স্থানটির প্রাচীন নাম ছিল বংশবতী। অনেক বাঁশের ঝাড় এখানে দেখা যেত। রামেশ্বর এই বাঁশঝাড় কেটে বসতি স্থাপন করেছিলেন বলে নাম হয় বাঁশবেড়িয়া।
যাই হোক রামেশ্বর অত্যন্ত সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ ছিলেন। তিনি সেই গঙ্গার পাড়ে বেনারস থেকে পণ্ডিত নিয়ে এসে বেশ কিছু নতুন সংস্কৃত টোল খুললেন। এই পরিবারের সঙ্গে কোনও উপলক্ষ্যে কাশী বা বেনারসের সু-সংযোগ তৈরি হয়েছিল। এখনও বাঁশবেড়িয়ার গঙ্গার পাড় দেখলে কাশীর কথা মনে আসবেই। আমরা পরবর্তীকালে মন্দির প্রসঙ্গে প্রবেশ করে এই সংযোগের প্রমাণ দেখতে পাব।
যদিও বিধর্মী মোগল সম্রাটের সুনজর লাভ করেছিলেন তবু রাজামশাই রামেশ্বর হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর বিশ্বাসের অধিকারী ছিলেন। বিশেষ করে বিষ্ণু সম্বন্ধে তাঁর অত্যন্ত আগ্রহ ছিল। বাংলায় তখন শ্রীচৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণবধর্ম প্রসার লাভ করছে। বিষ্ণুপুরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে নতুনভাবে বৈষ্ণব ভাবনা ও উপাসনার ধারা। ঠিক এই সময় বিষ্ণুপুর যে শিল্পরীতিতে মন্দির গঠন করে গুপ্ত বৃন্দাবন হয়ে উঠছিল, ঠিক সেই ধারাকে অনুসরণ করে রাজা রামানন্দ বিরাট রাজবাড়ির পাশে, গঙ্গার তীরে গড়ে তুললেন চারচালা কাঠামোর একরত্ন অনন্ত বাসুদেবের মন্দির। এই মন্দির স্থাপিত হল ১৬৭৯ সালে। মন্দির গঠনের সঙ্গে সঙ্গে মন্দির গাত্রে উৎকীর্ণ হল উত্সর্গ ফলক –
‘মহীব্যোমাঙ্গ শীতাংসু গণিতে শক বৎসরে।
শ্রীরামেশ্বর দত্তেন নির্ম্মমে বিষ্ণুমন্দিরং’।। ১৬০১ শকাব্দ
শিলালেখে কিন্তু রাজা রামেশ্বর রায় নিজেদের পুরাতন ও আদি পদবি ‘দত্ত’ ব্যবহার করেছেন। ইতিহাসের এ এক অদ্ভুত গতি।
মন্দিরটির তিন দিকে তিনটি খিলান শোভিত অলিন্দ রয়েছে। একরত্ন মন্দিরের শিখরের চূড়াটি অষ্টকোণাকৃতি। মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে ৩৫ ফুট ৪ ইঞ্চি আর প্রস্থে ৩২ ফুট ৪ ইঞ্চি। গর্ভগৃহে কষ্টিপাথরের যে বিষ্ণুমূর্তিটি রামেশ্বর রায় প্রতিষ্ঠা করেন তা কোনওসময় চুরি হয়ে যায়। তারপর নতুন মূর্তি বসানো হয়নি। অনন্ত বাসুদেবের পটে পূজিত হন। মন্দিরটির গাত্রে যে টেরাকোটার কাজ উত্কীর্ণ করা হয়েছে সেই কাজগুলি অত্যন্ত মূল্যবান। এই টেরাকোটার কাজের মধ্যে পুরাণের বিভিন্ন কাহিনীকে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে দক্ষযজ্ঞ, মহিষাসুরমর্দিনী, দশমহাবিদ্যা, হরধনুভঙ্গ, জনকনন্দিনীর সঙ্গে রামের বিবাহ, রাম-রাবণের যুদ্ধ, বিষ্ণুর দশাবতার, যুদ্ধবিগ্রহ, সন্ন্যাসীর কাছে রাজার দীক্ষা গ্রহণ, নৌযুগে সমুদ্রযাত্রা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি স্থানলাভ করেছে।
১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনন্ত বাসুদেবের মন্দির ও তার টেরাকোটার কাজ দেখে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তিনি নন্দলাল বসুকে এক মাস ধরে এই মন্দিরে উৎকীর্ণ টেরাকোটার কাজগুলি কপি করে রাখার কাজে নিযুক্ত করেন। বর্তমানে এই মন্দির আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীন।
অনন্ত বাসুদেবের মন্দির ছাড়াও অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের পাশে যে মন্দিরটি ভুবনবিখ্যাত সেটি হল হংসেশ্বরী দেবীর মন্দির। মন্দিরটি আসলে দেবী কালিকার। অবশ্যই এর বিগ্রহ চিরাচরিত কালীমূর্তির থেকে একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকে গঠিত।
এই মন্দিরটি গঠন করেন রামেশ্বর রায়ের প্রপৌত্র রাজা নৃসিংহদেব রায়। তাঁর মায়ের নাম ছিল হংসেশ্বরী। নিজের মায়ের নাম অনুসারে এই মন্দিরের নাম হয় দেবী হংসেশ্বরীর মন্দির। রাজা নৃসিংহদেব ১৭৯৯ খ্রিঃ এই মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু মন্দির সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৮০২ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। নৃসিংহদেবের দুই স্ত্রীর মধ্যে জ্যেষ্ঠজন স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হন। ছোটজন রানি শংকরী স্বামীর এই অতি প্রিয় ইচ্ছাকে রূপ দেওয়ার জন্য আবার মন্দিরের কাজ শুরু করেন। অবশেষে ১৮১৪ সালে মন্দিরটি সম্পূর্ণ হয়। মন্দিরের গঠন, প্রকৃতি, আরাধ্যা দেবীর বিচারে অন্য মন্দির থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র।
হংসেশ্বরী দেবীর মন্দির তেরোটি চূড়াবিশিষ্ট, প্রতিটি চূড়া পদ্মের কুড়ির আকারে সজ্জিত করা হয়েছে। তার প্রস্ফুটিত দলগুলি দূর থেকে স্পষ্ট হয় না অনেকের কাছে, তাই অনেকেই সেই মন্দির স্থাপত্যকে ইউরোপের ডিজনিল্যান্ডের চূড়া বা ইউরোপীয় বা ইতালির প্রাসাদ বা রাশিয়ার সেন্ট বাসিল ক্যাথিড্রালের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত বলে মনে করেন। প্রধান চূড়াতে ধাতুমূর্তি ধ্বজার মতো রয়েছে, যা সূর্য দেবতার আরাধনাকে চিহ্নিত করে। কিন্তু এই মন্দিরের গঠনশৈলীতে ছিল রাজা নৃসিংহদেবের তন্ত্রশাস্ত্রের সুগভীর জ্ঞান ও মানুষের দেহতত্ত্বের সুনিবিড় প্রকাশ। শোনা যায় রাজা নৃসিংহদেব ১৭৯২ থেকে ১৭৯৮ পর্যন্ত বারাণসীতে থেকে তন্ত্রের ‘কুণ্ডলিনী’ চক্রের সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তন্ত্রসাহিত্য স্বীকার করে মানবদেহের মধ্যে ছয়টি চক্র আছে। এই ছয়টি চক্র ভেদ করে সর্বশেষ চক্র সহস্রারে শিব বাস করেন এবং সেখানেই শিব ও শক্তির মিলন হয়। সেই হল চরম প্রাপ্তি। আমাদের দেহের মধ্যেই আছে ছয়টি চক্র তার উত্তরণই হল সাধনা। লিঙ্গ, গুহ্য, নাভি, অনাহত, মণিপুর, সহস্রার- এই ছয়টি চক্র। আর তার সঙ্গে রয়েছে ইড়া ও পিঙ্গলা নামে দুটি নাড়ি। যা সাপের গতিতে পরস্পর পরস্পরকে ভেদ করে মেরুদণ্ডকে আশ্রয় করে নীচ থেকে ওপরের দিকে উঠেছে। কিন্তু এখানে ইড়া ও পিঙ্গলার সঙ্গে বজ্রিনী ও চিত্রিনী নামে আরও দুটি নাড়িকে কল্পনা করা হয়েছে। এটি শক্তিতন্ত্রের সঙ্গে বৌদ্ধতন্ত্রের মিশ্রিত রূপ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
নৃসিংহদেব যে মন্দির পরিকল্পনা করেছিলেন তা ছিল একেবারেই ব্যতিক্রমী। রাজা নৃসিংহদেব তন্ত্রসাধনা করতেন। নিজের মায়ের নামে দেবীর নামকরণ করেছিলেন, তাই আশা করা যায় তিনি দিব্যভাবে তন্ত্রাচার পালন করতেন। তখন বাংলায় তন্ত্রের প্রাধান্য মানবদেহের কুলকুণ্ডলিনী তত্ত্বকে এই মন্দিরের স্থাপত্যের মধ্যে ফুটিয়ে তোলার ভাবনা তত্কালের অন্য রাজাদের থেকে নৃসিংহদেবকে পৃথক করেছিল। তেরোটি চূড়াবিশিষ্ট সত্বর ফুট উঁচু এই মন্দিরের বিভিন্ন স্থানে তান্ত্রিক পূজাপদ্ধতির বিভিন্ন আঙ্গিক, বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশায় তন্ত্রসাধনার অপরিহার্য ‘যন্ত্র’-গুলিও যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে। এই মন্দির তৈরির জন্য পাথর আনা হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের চুনার থেকে। তার সঙ্গে মন্দির নির্মাণের জন্য দক্ষ কারিগর নিয়ে আসা হয়েছিল রাজস্থান থেকে। তাই মন্দিরটির অবয়বে রাজস্থানের শেখওয়াতি হাভেলির প্রভাব লক্ষ করা যায়। এত বড় মন্দিরটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল তখনকার দিনের ৫ লক্ষ টাকা। বর্তমানে তা পাঁচ কোটির বেশি হবে বই কম নয়। মন্দিরে প্রবেশপথে, ঠিক দেবীর সম্মুখে একটি ঝরনার আকারে কুণ্ড, ঠিক তার মুখোমুখি দেবীমুখ। মন্দিরের গর্ভগৃহে পঞ্চমুণ্ডি আসনের ওপর সহস্রটি নীলপদ্মের আসন দেখে অবাক হতে হয়। এ যেন মিনে করা নিখুঁত কাজ! সেই নীলপদ্মের বেদির ওপর আবার অষ্টদল পদ্ম। সে পদ্মের বেদি একটি ত্রিকোণ যন্ত্র আকারে বিন্যস্ত! কালীযন্ত্র অষ্টদল পদ্মের মধ্যস্থলে ত্রিকোণাকার রেখা দিয়ে অঙ্কিত হয়।
এখানে সবটাই পাথর দিয়ে তৈরি। সেই যন্ত্রের ওপর শায়িত শিব বা মহাকাল। আর সেই শিবের হৃদয়পদ্ম থেকে একটি পদ্মের নাল উঠে শেষে ষোড়শদল প্রস্ফুটিত পদ্ম। আর ষোড়শ দল পদ্মের ওপর দেবী হংসেশ্বরী। দেবী একটি পায়ের ওপর অপর পা রেখে বসে আছেন। দেবীমূর্তি নিমকাঠের তৈরি, গায়ের রং নীল। কিন্তু তাঁর রূপ নীলসরস্বতীর মতো নয়। এ একেবারে নতুন এক রূপে বিন্যস্ত। আমরা দেখেছি যেখানেই তন্ত্রের আচার পালিত হত সেখানেই দেবীমূর্তি বসা মুদ্রায়। একটি মূর্তিতে দেখেছিলাম, শিবের হৃদয়পদ্ম থেকে পদ্মের নাল নির্গত হয়ে শেষে প্রস্ফুটিত পদ্মে দেবী দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু শিব শায়িত অবস্থায় তার হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে দেবীর একটি হাত স্পর্শ করে আছেন।
মনে হয় আমাদের প্রতিটি দেহের মধ্যে একত্রে শিব ও শক্তির যুগ্ম অধিষ্ঠান বোঝাবার জন্যই দেবীমূর্তির রূপ এমনটি করা হয়েছে। এই মন্দিরে দেবীমূর্তি যেমন নিমকাঠের তৈরি, শিবের মূর্তি কিন্তু পাথরের। শোনা যায় দেবীরূপ নির্মিত হয়েছে যে কাঠে সেই কাঠটি বারাণসী থেকে নাকি ভেসে এসেছিল। দেবীমূর্তি চতুর্ভুজা, ওপরের ডান হাতে অভয় মুদ্রা ও অপর হাতে তরবারি। নীচে বর মুদ্রা ও অন্য হাতে মুণ্ড। মাথার পিছন দিকে একটি লোহার কাঠামো লাঠির মতো। তার গায়ে লতানো ঝাড়বাতির মতো অলংকরণ। দেবীরূপ ঊর্ধ্বগামী করে তোলে মনকে। ষটচক্রের প্রতিটি চক্রকে এক-একটি তলায় রূপায়িত করা হয়েছে। সেখানে কৃষ্ণবর্ণের লিঙ্গ রূপে শিব বিরাজিত। সর্বশেষে রয়েছেন সাদা রঙের সদাশিব। যেখানে শিব ও শক্তির মিলন হলে মানব আত্মাতত্ত্ব লাভ করতে সক্ষম হয়।
দেবীমূর্তির পূজা হয় দক্ষিণকালিকা রূপেই। কেবল কালীপুজোর দিন দেবী আলুলায়িত কেশে উগ্রারূপে পূজিতা হন। সেদিন তাঁর অঙ্গে থাকে কেবল ফুলের গহনা। এই একটি দিন তিনি ভিন্ন রূপে আরাধিতা। হংসেশ্বরী দেবী ও তাঁর পটভূমিকে আশ্রয় করে প্রখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ স্যানাল ‘হংসেশ্বরী’ উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন। তা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি উপন্যাস।
শোনা যায়, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বিতীয় অধ্যক্ষ, শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ পার্ষদ স্বামী শিবানন্দ এই মন্দিরে এসে তপস্যা করেন এবং পরবর্তীকালে দেবীর প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা সকলকে চমকিত করত। তিনি হংসেশ্বরী মাতার একটি ফোটো সর্বদা নিজের কাছে রাখতেন এবং অনেক সময় রাতে ঘুম ভেঙে গেলে সেই পটমূর্তি মাথায় স্পর্শ করাতেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ পার্ষদরা এক-একজন আধ্যাত্মিক জগতের নক্ষত্রতুল্য। তাঁদের সাধনজীবনও বিচিত্র। কিন্তু স্বামী শিবানন্দের পূর্বাশ্রমের দিকে যদি আমরা তাকাই তবে আমরা দেখব তাঁর পিতা ছিলেন তন্ত্রসাধক। যাঁর সাধনার কথা স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ উল্লেখ করছেন। শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি একটি সূর্য কবচ তৈরি করে দিয়েছিলেন। তাঁর সাধিত পঞ্চমুণ্ডির আসন এখনও তাঁর বাস্তু বা বর্তমানের রামকৃষ্ণ মঠ বারাসতের ঠাকুর মন্দিরে সংরক্ষিত আছে। হংসেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় ১৮১৪। এই সময়ে কিন্তু স্বামী শিবানন্দের পিতা ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল নামকরা তান্ত্রিক। তাই এই মন্দিরের সঙ্গে তাঁর কিছু সম্পর্কের ক্ষেত্রটি অস্বীকার করা যায় না। যদিও তন্ত্রসাধনার প্রকৃষ্ট স্থান এই মন্দির তবু আজ তা জাতীয় সম্পত্তি রূপে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীন। রাজস্থানের হাভেলির খিলান মিনে করা উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ, তন্ত্রের বাস্তব রূপ নিয়ে এই মন্দির আজ নিশ্চয় এক বিস্ময় রূপে প্রতিভাত।