শুরু হয়েছে আমাদের নতুন ফিচার। প্রতি সপ্তাহে একজন অতিথি কলমনিস্ট কোনও একটি বিশেষ ইস্যু নিয়ে লিখবেন। এবারের প্রসঙ্গ বাজারের অস্থির সময়ে টিকে থাকার মন্ত্র। সময় কখনও কারও সমান যায় না। ওঠা-নামা জীবনের অঙ্গ। মানুষের মতোই এই সারসত্য বাজারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে কিছু নিয়ম মেনে চললে বাজারের উত্থান-পতনেও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হতে পারে। সেই পথেরই সন্ধান এই লেখায় দিলেন বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ পার্থ প্রতীম চট্টোপাধ্যায়।
“যে সহে, সে রহে” প্রাচীনকাল থেকে এই কথাটা সত্য। সহা করতে পারলেই আপনি টিকতে পারবেন। বিবর্তনবাদ বারে বারে এই সত্যকেই উপলব্ধি করিয়েছে। বিনিয়োগের জগতেও এই বাণী বিনিয়োগকারীর একটি প্রধান গুণ হিসেবে চিহ্নিত। বাজারের উত্থান পতনে, টিকে থাকলে বিনিয়োগকারী তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন। বর্তমানে শেয়ার বাজার তার সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে কিছুটা নিচে আছে।
এর জন্য একাধিক কারণ উল্লেখ করা যায়, যেমন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক চাপানো যা বিশ্বের এক অংশকে মন্দার মুখে ঠেলে দেবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। সেই সঙ্গে রয়েছে আমাদের দেশীয় কোম্পানির একটি অংশে দুর্বল ফলাফল। আশার কথা, এর ফলে শেয়ার বাজারের নানান কোণে চলছে ‘ডিসকাউন্টের’ অফার। এই সুযোগে আপনিও আপনার পোর্টফোলিওকে আরও একবার ভালোভাবে রি-ব্যালেন্সিং করে নিতে পারেন। তা আপনাকে দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে বাজারে টিকে রাখতে সাহায্য করবে।
আমার বক্তব্য, এই সময়ে বিনিয়োগ করলে ভালো লাভ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তবে কিছুই নিশ্চিত নয়। আরও কিছুটা নিচে যেতে পারে সূচক, এই ভয়ের জন্যই অনেক বিনিয়োগকারী নিজেদের লক্ষ্যপূরণ হওয়ার আগেই টাকা তুলে নেন। বিনিয়োগকারী হিসেবে তা অপেশাদারি মনোভাবের পরিচয় দেয়। অচল অবস্থার মেঘ কেটে গেলে বাজার কিন্তু আবার তার আগের জায়গা ফিরে পাবে, আশা করা যায়। কিন্তু বিনিয়োগকারীকেও থাকতে হবে বাজারে সেই সুদিন দেখার জন্য। যাই হোক, দেখে নেওয়া যাক এইরকম একটা অস্থির সময়ে কীভাবে আপনি টিকে থাকবেন বাজারে দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে। নিচে রইল সেই সঞ্জীবনী মন্ত্র।
১. নিজের ‘মেন্টাল সেটআপ’ তৈরি করবেন দীর্ঘকালীন বিনিয়োগের ভিত্তিতে। অস্থির পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীর হার না মানা মানসিকতা থাকা জরুরি।
২. ছোট ছোট করে বিনিয়োগ করবেন, প্রয়োজনে সিপ-এর মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে পারেন। বাজার আরেকটু নিচে গেলে আপনার হাত যেন শূন্য না হয়ে যায়, অর্থাৎ
রিস্ক ম্যানেজমেন্টের জন্য হাতে টাকা থাকা দরকার।
৩. এককালীন কিছু টাকা বিনিয়োগ
করতে চাইলে এসটিপি-র মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারেন, অর্থাৎ লিকুইড বা তেমন কোনও শর্ট টার্ম ফান্ডে টাকা জমা করে সেখান থেকে সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে একটি ইক্যুইটি ফান্ডে টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন।
৪. যিনি একটু বেশিই ঝুঁকি নিতে চান তিনি মাল্টি অ্যাসেট ফান্ডে বিনিয়োগ করতে পারেন। এই জাতীয় ফান্ডে সোনা, G-Sec, ইক্যুইটিতে (আন্তর্জাতিক ইক্যুইটিও থাকে)
বিনিয়োগ করা হয়। ফলে আপনার ‘রিস্ক অ্যাডজাস্টেড রিটার্ন’ ভালো হবে, এমন ভাবা হয়। এই সমস্ত ফান্ডে ‘ভোলাটিলিটি’ কম থাকার জন্য বিনিয়োগকারী বাজার পতনের ভয় থেকে কিছুটা মুক্ত থাকেন।
৫. শেয়ার বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনি বিনিয়োগ করতে পারেন লার্জ ক্যাপ ফান্ডে। ভ্যালুয়েশনের দিক থেকে বলা যায় এই ফান্ডগুলি বর্তমান সময়ে বিনিয়োগের উপযুক্ত।
৬. মিড ক্যাপ ফান্ড এবং স্মল ক্যাপ ফান্ডে এখন বিনিয়োগ করলে সাবধানে থাকবেন। সিপ এবং এসটিপি-র মাধ্যমে বিনিয়োগ করুন এই ফান্ডগুলিতে। সেক্টোরাল ফান্ডে বিনিয়োগ করতে চাইলে অবশ্যই পরামর্শদাতার সুরাহা নেবেন।
৭. একটি ফান্ডে আপনার সব টাকা বিনিয়োগ না করে তা ছড়িয়ে দিন বিভিন্ন ফান্ডে। এতে বিনিয়োগকারীর ঝুঁকির পরিমাণ অনেকটা কমবে।
৮. অন্যের বিনিয়োগকে কখনোই নকল (কপি) করবেন না। মনে রাখবেন, প্রত্যেকের প্রয়োজন আলাদা আছে বলে বিনিয়োগের পোর্টফোলিও হবে আলাদা।
৯. ‘সলিউশন ওরিয়েন্টেড’ ফান্ড (যেমন রিটায়ারমেন্ট ফান্ড বা চিলড্রেনস ফান্ড) পরখ করে দেখবেন দরকার হলে।
১০. বিনিয়োগ করার ব্যাপারে ধৈর্য্য ধরাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাড়াহুড়ো করলে সেই বিনিয়োগের ফল ভালো হয় না।
তাছাড়া ধৈর্য্য না ধরলে সামান্য বাজারের পতনে বিনিয়োগকারী বিব্রত হতে পারেন, ফলে তিনি চট করে ‘রিডেম্পশন’ করে নিতে পারেন। তা কাম্য নয়।
১১. নিজের রিস্ক প্রোফাইল নিয়ে সদা সতর্ক থাকবেন। তবে নিজের রিস্ক প্রোফাইল বোঝা খুবই কঠিন কাজ, সেই জন্য আপনি সাহায্য নিতে পারেন বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞদের।
বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে সর্বদা এই বিষয়গুলোকে মাথায় রাখবেন। এর ফলে দেখবেন আপনার সম্পদ সব প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হবে। বর্তমানে বাজার অর্থনীতি যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এই পরিস্থিতিতে বাজারের পতনের ফলও আপনাকে সহ্য করতে হবে। আর সহ্য করে আপনি দীর্ঘদিন বাজারে টিকে গেলে আপনার বিনিয়োগও আপনাকে ভালো ফল দেবে। ‘যে সহে, সে রহে’ গোড়াতেই বলেছি। এই বাণী বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও দারুণভাবে কার্যকরী হবে।