বিশ্বজিৎ মান্না, গুরুগ্রাম (হরিয়ানা): অদ্ভুত বৈপরীত্য। একদিকে বাঙালিদের নিরাপদে বসবাসের ছবি। অন্যদিকে, বাঙালি বলে হেনস্তার বাস্তব। দুই-ই চোখে পড়ছে হরিয়ানায়। গুরুগ্রামের কথাই ধরা যাক। চিকিৎসকের পেশায় প্রচুর বাঙালি। এই যেমন, মূল গুরুগ্রাম শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে বাসাই গ্রামে নদিয়ার রোহিত সরকারের চেম্বার। ১৫ বছরেরও বেশি যাঁর হরিয়ানায় বসবাস। তাঁর কথায়, যাঁর সঠিক পরিচয়পত্র আছে, তাঁর কোনও সমস্যা নেই।
সামগ্রিকভাবে হরিয়ানায় বাঙালি বিদ্বেষের অভিযোগের সঙ্গে তিনি একমত নন। রোহিত বলেন, ‘হরিয়ানায় বাঙালিদের ওপর দিদি যে অত্যাচারের কথা বলছেন, বাঙালিদের খেদানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলছেন- সেসব বাজে কথা। যাঁদের সঠিক পরিচয়পত্র আছে, তাঁদের কোনও সমস্যা নেই।’ অথচ হয়রানি যে হচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি সন্দেহ করা হচ্ছে। সম্প্রতি শহরের শ্রমিক মহল্লা থেকে পুলিশ কয়েকজন বাঙালিকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁদের অনেকে সেক্টর ১০এ, বাদশাপুর, মানেসর এলাকায় বহুদিন ধরে বসবাস করেন।
হয়রানি, নিগ্রহ এত তীব্র হয়ে উঠেছে যে, ভয় ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা থেকে আসা শ্রমিকদের মনে। কেউ কেউ তল্পিতল্পা গুটিয়ে পাকাপাকিভাবে গুরুগ্রাম ছাড়ার কথা ভাবছেন। যাঁদের আটক করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। কেউ ড্রাইভার, কেউ সাফাইওয়ালা, কেউ আবার বাড়ি বাড়ি রান্না করেন। অভিযোগ, এখন তাঁদের বাড়িভাড়া দিতে চাইছেন না স্থানীয়রা।
যেখানে এমন বাঙালি হেনস্তার ছবি, সেখানে রোহিতের দাবি, হরিয়ানার লোকজন বাঙালি ডাক্তারদের একটু বেশিই ভরসা করেন। গুরুগ্রাম শহরের অলিগলিতে তাঁর কথার সমর্থন মিলবে। চোখে পড়বে বেশ কয়েকজন ডাক্তারের চেম্বারের বোর্ডে লেখা ‘বাঙালি ক্লিনিক’। হিন্দি এবং ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও লেখা থাকে চিকিৎসকের নাম। বুঝতে অসুবিধা না হয়, ওই চেম্বারের ডাক্তার একজন বাঙালি। এত বাঙালি ডাক্তার কেন? হরিয়ানায় কি ডাক্তারের অভাব? আদৌ তা নয়। রোহিত জানালেন, অর্শ কিংবা ভগন্দরের মতো রোগের চিকিৎসায় হরিয়ানাবাসীর কাছে বাঙালি ডাক্তারই প্রথম পছন্দ।
যদিও ওই ক্লিনিকগুলোতে যাঁরা রোগী দেখেন, তাঁরা সবাই এমবিবিএস পাশ নন। অধিকাংশই রেজিস্টার্ড মেডিকেল প্র্যাকটিশনার। শুধু এঁদের মতো ডাক্তার নন, আরও অনেক বাঙালি হরিয়ানায় আইটি সেক্টর বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি কিংবা অন্য কোনও কর্পোরেট ক্ষেত্রে চাকরি করছেন নির্বিবাদে। কয়েক হাজার বাঙালি তরুণ-তরুণীর কেউ থাকেন দিল্লিতে, কেউ গুরুগ্রামে। তাঁদের ওপর ঝামেলার এখনও কোনও খবর মেলেনি। যত সমস্যা হচ্ছে গরিব বাঙালি শ্রমিকদের। আরও স্পষ্ট করে বললে সংখ্যালঘু বাঙালিদের। তাঁদের সবাই বাংলাদেশি বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ উঠছে, এঁরা বেআইনিভাবে ভারতে বসবাস করছেন। আদতে কলকাতার বাসিন্দা, হরিয়ানার একটি অফিসের চাকুরে টুইঙ্কল বসু জানালেন, রোহিঙ্গা সন্দেহে যাঁদের পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে, তাঁদের সবাই ভারতীয় নাগরিক নাও হতে পারেন। তাঁর কথায়, ‘কিছু মানুষ সত্যিই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।’
আইটি সেক্টরে কর্মরত গুরুগ্রামের বাসিন্দা হিমাংশু সিং ছোট থেকে এলাকায় বাঙালিদের দেখেছেন। তাঁর বাড়ির কাছে ২০-২৫ বছর ধরে বাঙালি ক্লিনিক রয়েছে। যেখানে ডাক্তারও বাঙালি। তবে তাঁর কথায়, ‘শহরে যে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা বলা হচ্ছে, তা পুরোপুরি হয়তো মিথ্যা নয়।’ শুধু রোহিঙ্গা নন, বাংলাদেশ থেকে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করে বসবাস করছেন বলে কারও কারও দাবি।
দাবিটা পুরো মিথ্যা নাও হতে পারে। যেমন বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ হিসাবে পরিচিত ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের বাসিন্দা রঘুনাথ রায় বলেন, ‘হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ সত্যিই বেড়েছে। এদের সবাই সংখ্যালঘু নয়। অনেক সংখ্যাগুরু লোকজনও ভারতে বেআইনিভাবে এসে পরিচয় লুকিয়ে বসবাস করছেন, কাজ করছেন।’