ঠ্যালার নাম বাবাজি। সেই বাবাজির কল্যাণে হঠাৎ ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত রথী-মহারথীদের মনে পড়ে গিয়েছে যে, ঘরোয়া ক্রিকেট ব্যাপারটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এবং রনজি ট্রফি বলে একটা প্রতিযোগিতা হয় দেশে।
ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের কাছে নাকানিচোবানি খাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়াতেও অপমানিত হয়ে ফেরার পর বাধ্য ছেলের মতো রনজি খেলতে নেমে পড়েছেন বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, শুভমান গিল, ঋষভ পন্থ প্রমুখ তারকারা। ফলে জন্মে রনজি ট্রফির ধারেকাছে না যাওয়া সংবাদমাধ্যমকেও রোজ জানান দিতে হচ্ছে, বিরাট নেটে কার সঙ্গে কথা বললেন, কতজন তাঁকে দেখতে এল, কেমন ওজনের ব্যাট নিয়ে খেললেন ইত্যাদি।
কোটলায় এক যুগ পরে রনজি খেলতে নামলেন বিরাট। তাঁর বিশ্বরূপে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়ে বাংলার সংবাদমাধ্যমও দু’চার লাইন লিখেই ক্ষান্ত দিচ্ছে, এই রাউন্ডে সম্ভবত জীবনের শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলতে নামছেন ঋদ্ধিমান সাহা। কারণ বাংলার নক আউট স্তরে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।
কেন দু’চার লাইনের বেশি প্রাপ্য ঋদ্ধিমানের? কারণ সর্বকালের সেরা পুরুষ বাঙালি ক্রিকেটারদের তালিকায় তিনি তিন নম্বরে থাকবেন। ইডেন উদ্যানে বৃহস্পতিবার বাংলা বনাম পাঞ্জাব ম্যাচ খেলতে নামার আগে পর্যন্ত ১৪১ খানা প্রথম শ্রেণির ম্যাচে শিলিগুড়ির ছেলে ঋদ্ধিমান ৩৪৪ খানা ক্যাচ ধরেছেন আর ৩৮ খানা স্টাম্পিং করেছেন, প্রায় ৪২ গড়ে সাত হাজারের বেশি রানও করেছেন। ফলে তিনি যে বাংলার সর্বকালের সেরা উইকেটরক্ষক তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।
কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আর পঙ্কজ রায়কে বাদ দিলে আর কোনও বাঙালি ক্রিকেটার ঋদ্ধিমানের চেয়ে বেশি টেস্ট (৪০) খেলে উঠতে পারেননি। শুধু খেলেছেন বললে ভুল হবে। বরেণ্য উইকেটরক্ষক অ্যালান নটের সমসাময়িক হওয়ায় প্রতিভাবান বব টেলরের যেমন ইংল্যান্ডের হয়ে বেশি খেলা হয়নি, মহেন্দ্র সিং ধোনির সমসাময়িক হওয়ায় ঋদ্ধিমানও ভারতীয় দলে নিয়মিত হয়েছেন তিরিশের কোঠায় পা দিয়ে। তা সত্ত্বেও উইকেটের পিছনের দক্ষতায় মুগ্ধ করেছেন সৈয়দ কিরমানি, অ্যাডাম গিলক্রিস্টের মতো কিংবদন্তিদের। তাঁর কোনও কোনও ক্যাচ চোখ কপালে তুলে দিয়েছে, ঘূর্ণি উইকেটে তাঁর উইকেটরক্ষা শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে অনেকসময়। নিঃসন্দেহে বলা যায়, ঋষভ পন্থ এসে না পড়লে ঋদ্ধিমান অনায়াসে পঞ্চাশের বেশি টেস্ট খেলে ফেলতেন।
অথচ এই লোকটার অবসর নিয়ে বাংলায় কোনও হইচই নেই। বেহালার নীল রক্তের ক্রিকেটারের খেলোয়াড় জীবনে তাঁকে ঘিরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাবল্য দেখলে বোধহয় সুরেন বাঁড়ুজ্জেও আশ্চর্য হতেন। অথচ শিলিগুড়ির মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেটার ব্যাপারে কোনওদিন তার ছিটেফোঁটা দেখা যায়নি। স্বভাবতই সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদেরও তাঁকে নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই। চোট আঘাতে চিরকাল জর্জরিত দিল্লির ছেলে আশিস নেহরা, যিনি খেলেছেন মাত্র ১৭ খানা টেস্ট আর ১২০ খানা একদিনে আন্তর্জাতিক ম্যাচে মনে রাখার মতো পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন মাত্র একবার– তাঁকে যখন বিশেষ সম্মান দিয়ে ঘরের মাঠে টি টোয়েন্টি খেলে অবসর নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড, তখন বাংলার সাংবাদিকরা কত কাব্য যে করেছেন! ঋদ্ধিমানের বেলায় সাজানো কালি শুকিয়ে গেল? একখানা সর্বভারতীয় ইংরিজি খেলার পত্রিকা ছাড়া কোথাও তো ঋদ্ধিমানের কোনও দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেখছি না!
অথচ ঋদ্ধিমানের ক্রিকেটজীবন যেভাবে শেষ হল, তিনি তত অযত্নের পাত্র ছিলেন না। টেস্ট দলে জায়গা পাকা করে নেওয়া ঋদ্ধিমান ২০১৮ সালে অস্ত্রোপচারের জন্য বিশ্রামে যেতে বাধ্য হলেন। যখন ফিরে এলেন, তখন তাঁকে জায়গা ফিরিয়ে দেওয়া হল না, রেখে দেওয়া হল তরুণ ঋষভকে। কেন? না তিনি ইংল্যান্ডে শতরান করে ফেলেছেন।
ঋষভের উইকেটরক্ষা এখন যত ভালোই হোক, তখনও মোটেই ভরসা জোগানোর মতো হয়নি। সে যতই তিনি এক ইনিংসে পাঁচটা ক্যাচ ধরে থাকুন। বিশেষত, স্পিনারদের বিরুদ্ধে তাঁর উইকেটরক্ষা হাস্যকর হয়ে দাঁড়াত প্রায়শই। তা সত্ত্বেও ঋদ্ধিমান হয়ে গেলেন দ্বিতীয় পছন্দ। একটা অভিনব সূত্র দিল টিম ম্যানেজমেন্ট– বিদেশে কিপিং করবেন ঋষভ, কারণ ওখানে স্পিনারদের সামলাতে হয়। আর দেশে ঋদ্ধিমান। সবসময় অবশ্য তাও মানা হয়নি। সৌরভের গোটা কেরিয়ারে প্রতিদিন তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া বাঙালি সমাজ তখন বিক্ষোভে ফেটে পড়েনি।
ঋষভ ভালো খেলে দিয়েছেন, ঋদ্ধিমানকে জায়গা ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় ছিল না– এ যুক্তি কিন্তু অসাঢ়। কারণ প্রথমত, ভালো খেলার বহরটা আগেই উল্লেখ করলাম। দ্বিতীয়ত, অধিনায়ক বিরাটের আমলেই ২০১৬ সালে চোটের জন্য দলের বাইরে থাকা সিনিয়ার ক্রিকেটার অাজিঙ্কা রাহানের জায়গায় একটা টেস্টে সুযোগ পেয়ে করুণ নায়ার ত্রিশতরান হাঁকিয়েছিলেন। অথচ পরের টেস্টেই সুস্থ রাহানেকে তাঁর জায়গা ফেরত দেওয়া হয় (করুণ আজ পর্যন্ত আর মোটে তিনটে টেস্ট খেলেছেন)। তখন বিরাটের যুক্তি ছিল– একটা পারফরমেন্স অন্য একজন খেলোয়াড়ের কয়েক বছরের পরিশ্রমের মূল্য চুকিয়ে দিতে পারে না। সঠিক ক্রিকেটীয় যুক্তি, কিন্তু সেটা ঋদ্ধিমানের বেলায় খাটল না!
তাঁকে একেবারে বাদ দেওয়ার সময়ে অবশ্য কোচ রাহুল দ্রাবিড় আলাদা করে ডেকে বলেছিলেন, বয়সের কারণে তাঁকে নিয়ে আর ভাবা হবে না। এটাও ক্রিকেটীয় যুক্তি হিসাবে ভুল নয়। কিন্তু তাঁর বদলে যাকে ভাবা হয়েছিল, সেই কে এস ভরত ইতিমধ্যেই তলিয়ে গিয়েছেন। আরও বড় কথা, ঋদ্ধিমানের চেয়ে অনেক বেশি ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরেও একই বয়সে পৌঁছে যাওয়া বিরাট আর রোহিতকে আজ ‘তোমাদের নিয়ে আর ভাবা হবে না’ বলার সাহস গৌতম গম্ভীর বা প্রধান নির্বাচক অজিত আগরকর দেখাতে পারছেন না। দলের স্বার্থে নিজেকে বাদ দেওয়া, ধেড়ে বয়সে রনজি দলের নেটে এসে ব্যাকফুটে খেলার অনুশীলন ইত্যাদি আদিখ্যেতা চলছে।
ঋদ্ধিমানের প্রতি সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ব্যবহার করেছেন অবশ্য বাঙালিরাই। ভুললে চলবে না, তাঁকে যখন দল থেকে ক্রমশ সরিয়ে দেওয়া হল তখন বোর্ড সভাপতি ছিলেন বাংলার গৌরব সৌরভ। তারপর ২০২২ সালে এক বাঙালি সাংবাদিক সাক্ষাৎকার না দেওয়ার ‘অপরাধে’ ঋদ্ধিমানকে রীতিমতো হুমকি দেন– দলে একজন উইকেটরক্ষকই সুযোগ পায়, তুমি ১১ জন সাংবাদিককে বেছে নেওয়ার চেষ্টা করছ। এটা আমার মতে ঠিক নয়… তুমি আমায় ফোন করোনি… কাজটা কিন্তু ভালো করলে না… ইত্যাদি। সেই হুমকি টুইটারে ফাঁস করে দেন ঋদ্ধিমান। বোর্ড বাধ্য হয়ে সেই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে এবং সাময়িকভাবে তাঁর ভারতীয় ক্রিকেট কভার করা নিষিদ্ধ হয়। তবে তিনি বহালতবিয়তে ফিরে এসেছেন। তাঁর প্রতি অবিচার হয়েছে– এই মর্মে বই লিখেছেন, সে বই ক্রিকেট মহলের পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছে। মাঝখান থেকে ঋদ্ধিমানের আন্তর্জাতিক কেরিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছে।
তারপর সিএবি কর্তাদের ব্যবহারে আঘাত পেয়ে তিনি ত্রিপুরার হয়ে খেলতে চলে গিয়েছিলেন। শেষমেশ গ্যালারির ফাঁক দিয়ে ইডেন উদ্যানে শুভবুদ্ধির হাওয়া এসে পড়ে হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে। এবং সৌরভের কথায় (ঋদ্ধিমানের বয়ান অনুযায়ী) তিনি শেষ মরশুমটা বাংলার হয়ে খেলার সুযোগ পান।
সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে ঋদ্ধিমানের যে সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করলাম, তাতে অভিমানের সুর স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘আমি বরাবর বিশ্বাস করেছি, পারফরমেন্সই একজন খেলোয়াড়ের পরিচয়, পাবলিক রিলেশন নয়।’ যুগটা বদলে গিয়েছে। একটা ব্যাপার অবশ্য বদলায়নি– কলকাতার বাইরের বাঙালি সম্পর্কে বাঙালির উদাসীনতা।