বাঘ নামে বহু জনপদ পুরুলিয়ায়, ‘টাইগার মোড়’-কে স্বীকৃতি পূর্ত দপ্তরেরও

বাঘ নামে বহু জনপদ পুরুলিয়ায়, ‘টাইগার মোড়’-কে স্বীকৃতি পূর্ত দপ্তরেরও

ইন্ডিয়া খবর/INDIA
Spread the love


সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: নামে কী এসে যায়! এই প্রবচন বা কথায় বোঝা যায়, নামের চেয়ে কাজের গুরুত্ব বেশি। কিন্তু নামেও এসে যায়! ‘বাঘৎবাড়ি’, ‘বাঘাডাবর’, ‘বাঘেরডাঙ’, ‘বাঘবিন্ধ্যা’। সর্বোপরি বাঘমুন্ডি। বাঘ শব্দে পুরুলিয়ায় নানান গ্রামের নাম। জনশ্রুতি আছে, এই অঞ্চলে বাঘের যাওয়া-আসা ছিল। তাই বাঘ শব্দবন্ধে এমন জনপদ। আর সেই বাঘ থেকে বাঁচতে নানান লৌকিক দেব-দেবী বা গ্রামীণ দেবতা। তার তালিকাও নেহাত কম নয় এই জঙ্গলমহলে। ‘বাঘরাইবুড়ি’, ‘বাঘরাইচন্ডি’, ‘বাঘুৎঠাকুর’, ‘রায়বাঘিনী’-কত কি!

লোক সংস্কৃতি গবেষকরা বলেন, বাঘ থেকে বাঁচতে ও তাদের হামলা ঠেকাতে এই দেব-দেবীর পুজো দিতেন এই জেলার মানুষজন। তবে আজও সেই পুজোপাঠ চলে। এর থেকেই প্রমাণ অতীতের পুরুলিয়া বা সাবেক মানভূমে কিংবা যখন জঙ্গলমহল জেলার অধীনে ছিল এই পুরুলিয়া। তখন ওই সব অঞ্চল ছিল রীতিমতো বাঘের ডেরা! তাই বাঘ শব্দ দিয়ে গ্রামের নামকে স্বীকৃতি দিয়েছে পূর্ত দপ্তর। বাঘমুন্ডিতে সবুজ বোর্ডে সাদা অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে ব্রিটিশদের নাম দেওয়া ‘টাইগার মোড়’! মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবসে পুরুলিয়ার এই জনপদ যেন নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পুরুলিয়া জেলা পরিষদের পূর্ত, কার্য ও পরিবহন স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ তথা লোকসংস্কৃতি গবেষক হংসেশ্বর মাহাতো বলেন, “জঙ্গলমহল পুরুলিয়ার বহু গ্রামে বাঘের যাওয়া-আসা শুধু নয়। রীতিমতো ডেরা ছিল। সেই জন্যই তো বাঘ দিয়ে নানান নাম। আর সেই নাম জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ায় পূর্ত দপ্তর তাতে শিলমোহর দিয়ে বোর্ড বসিয়েছে।”

Many towns named after tigers in Purulia
পুরুলিয়া-রাঁচি সড়কে রায়বাঘিনী গ্রামীণ দেবতা থান। ছবি: অমিতলাল সিং দেও।

জিনাত এবং জিনাত সঙ্গী। এই বাঘিনী ও বাঘের এই জেলায় পদচারনাতেই উঠে এসেছে অতীতেও পুরুলিয়ায় বাঘের যাওয়া-আসা ছিল। আর তার সমর্থনেই বাঘকেন্দ্রিক একাধিক নাম সামনে আসছে। ‘টাইগার মোড়’ যেমন বাঘমুন্ডিতে রয়েছে। তেমনই ঝালদা ১ ব্লকে আছে ‘বাঘবিন্ধ্যা’। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে মাওবাদীদের হামলায় যেখানে সাত ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা-কর্মীর মৃত্যু হয়। তেমনই পুরুলিয়া এক ব্লকে ‘রায়বাঘিনি’। রঘুনাথপুর এক ব্লকে রয়েছে ‘বাঘাডাবর’, নিতুড়িয়ায় ‘বাঘৎবাড়ি’, সাঁতুড়িতে ‘বাঘেরডাঙ’, হুড়ায় ‘বাঘাটাড়’, বলরামপুরে ‘বাঘাডি’, বরাবাজারে ‘বাঘুডি’, মানবাজার দুই ব্লকে ‘বাঘাবাইদ’।

একইভাবে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়ানো বাঘকে সন্তুষ্ট করতে রঘুনাথপুর ২ নম্বর ব্লকের চেলিয়ামায় রয়েছে ‘বাঘরাইবুড়ি’, ওখানেই আছে ‘বাঘরাইচন্ডী’ দেবীও। এছাড়া ‘বাঘুৎঠাকুর’ পুজো হয় হুড়া ও বাঘমুন্ডি থানার বিভিন্ন গ্রামে। লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায়ের ‘মানভূমের লৌকিক দেব-দেবী’ গ্রন্থে রয়েছে বাঘরুৎ ঠাকুরের পুজোর কথা। যা বাঘ থেকে বাঁচতেই সাঁতুড়ি থানার বড়শাল মেলার চন্ডী দেবী থানে আজও পুজো হয়ে আসছে। ওই দেবতার-ই আরেক নাম রয়েছে ‘বাঘরহ’। এই পুজো হয়ে থাকে ১৩ জ্যৈষ্ঠ রহিন পরবে। এছাড়া বাঘ কেন্দ্রিক এই দেবদেবীর পূজা আজও হয় ১ আষাঢ় ও ১ মাঘ। ১ আষাঢ় যেহেতু আমনের মরশুম শুরু। একইভাবে ১ মাঘ সাবেক মানভূমের কৃষি বর্ষের সূচনা। এছাড়া ১৩ জ্যৈষ্ঠ রহিন পরবেও আমন বীজ ফেলা হয়। অর্থাৎ কৃষিকেন্দ্রিক এই জেলায় ফাঁকা মাঠ-ঘাটে চাষ আবাদের কাজে গিয়ে যাতে বাঘের হামলার মধ্যে না পড়েন, সেই কারণেই এই লৌকিক দেব-দেবীর আরাধনা বলছেন লোকসংস্কৃতি গবেষকরা।

সুভাষ রায়ের কথায়, “বাঘ শব্দ দিয়ে গ্রামের নামের কথার অর্থ-ই হচ্ছে ওইসব জনপদে অতীতে বাঘের আসা-যাওয়া ছিল। এমনকী স্থায়ীভাবেও থাকত ওই বন্যপ্রাণ। সেই কারণেই এমন নামকরণ। তাছাড়া বাঘকে সন্তুষ্ট করতে সেই নামেই লৌকিক দেব-দেবীর যেমন পুজো হতো। এখনও তা হয়।” কিন্তু এখন তো আর সেভাবে বাঘের ভয় নেই? তাঁর কথায়, “প্রথা, ঐতিহ্য তো আর সহজে ছেদ পড়ে না। তাই সেই রেওয়াজ চলছেই।” ওই বাঘমুন্ডির ‘টাইগার মোড়’-কে নিয়ে যেসব গল্পকথা আছে। তা রীতিমতো ব্যঙ্গ রস। ওই এলাকার প্রবীণ মানুষজনরা বলেন, বলরামপুর-বাঘমুন্ডি সড়কে পাখি পাহাড়ের কাছে ওই ‘টাইগার মোড়ে’ সকল বাঘেরা জমায়েত হয়ে আড্ডা দিত! তবে লোকসংস্কৃতি গবেষকদের কথায়, ওই ‘টাইগার মোড়’-র নাম দেওয়া ব্রিটিশদের। পর্যটকদেরকে নিয়ে ওই পথে যাওয়া গাড়ির চালকরা ওই নাম বললেই তারা যেন চমকে ওঠেন। তাই টাইগার মোড়ে বাঘের ভয়ে সন্ধ্যা নামে! আজও…!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ






Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *