বাংলা সিনেমা আজ অভিভাবকহীন

বাংলা সিনেমা আজ অভিভাবকহীন

শিক্ষা
Spread the love


  • লিলি চক্রবর্তী

উত্তমদার সঙ্গে আমার প্রথম অভিনয় ‘বিপাশা’ ছবিতে। যদিও ওই ছবিতে তাঁর সঙ্গে আমার কোনও দৃশ্য ছিল না। তারপর ‘দেওয়া নেওয়া’ ছবিতে কাজ করি। পুরো ছবিতে তাঁর সঙ্গে অভিনয় করেছি। তখন বলতে গেলে আমি একদমই নতুন। সবে চার-পাঁচটা ছবি করেছি। উত্তমদা এতটাই ভালো মানুষ ছিলেন যে, একবারও বুঝতে দেননি আমি নবাগতা। তাঁর অমায়িক ব্যবহারে মনে হয়েছিল আমরা যেন কতদিনের চেনাশোনা। ওই ছবির পর থেকে আমাকে উনি ‘বৌঠান’ বলে ডাকতেন। একবার অন্য একটা ছবিতে কাজ করছি, উনি হঠাৎ স্টুডিওতে এসে বললেন, ‘ও বৌঠান, কোন রেশনের দোকানের চাল খাওয়া হয়? এখনও এত সুন্দর চেহারা ধরে রেখেছ?’ আমি বললাম, ‘সেটা তো আপনাকেও বলতে পারি। আপনার কাছ থেকেই তো শেখা কীভাবে শরীর ঠিক রাখতে হয়।’

‘দুই পুরুষ’ ছবিতে কল্যাণীর রোল করেছি। উত্তমদার সাবলীল অভিনয় দেখে নিজেকে প্রস্তুত করতাম। মুম্বই থেকে আমাকে ডেকে এনে ‘ভোলা ময়রা’ ছবিতে নিলেন। ছবির গানে একটা দৃশ্য ছিল, উত্তমদা আমাকে মুক্তোর হার পরিয়ে দেবেন। তারপর জড়িয়েটড়িয়ে ধরার ব্যাপার ছিল। বেণুদি মানে সুপ্রিয়া দেবীও সেটে ছিলেন। উত্তমদা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আর ছাড়ব না।’ আমি বেণুদির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কী করছেন দাদা! আমাকে ছাড়ুন।’ বললেন, ‘ছাড়ব কেন? সেটে তুমি আমার বৌ। বেণুদি আবার কী বলবে!’ এই রকমই মজার মানুষ ছিলেন উত্তমদা।

শুধু আমি নয়, প্রত্যেকের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। তখন পুরোনো টেকনিসিয়ান স্টুডিও ছিল। উত্তমদা গেটের কাছে গাড়ি থেকে নেমে টেকনিসিয়ানদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভেতরে আসতেন। তাঁদের থেকে সিগারেট চেয়ে খেতেন। ভাঙা বেঞ্চে বসে অনায়াসে কাঁধে হাত দিয়ে গল্প করতেন। তাঁর কাছে প্রত্যেকের হাঁড়ির খবর থাকত। কারও মেয়ের বিয়ে, কারও বাবা অসুস্থ– সব ছিল নখদর্পণে। একজন ভদ্রলোক ছিলেন যিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুঃস্থ শিল্পীদের প্রতি মাসে টাকা দিয়ে আসতেন। প্রত্যেককে আলাদা আলাদা খামে নাম লিখে টাকা দেওয়া হত। খুব সুন্দর ব্যবস্থা করেছিলেন। বিশেষ করে পুরোনো আর্টিস্ট, যাঁরা কাজ পেতেন না, তাঁদের সাহায্য করতেন। এসবের কিছুই আমরা সেসময় জানতে পারিনি। উনি চলে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে জেনেছি। একেবারেই অবাক হয়নি। বরং শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়েছে। উত্তমদার মৃত্যুর পর অনেক আর্টিস্ট খুব সংকটে পড়ে গিয়েছিলেন।

‘হার মানেনি’ বলে একটা ছবিতে একসঙ্গে শেষ অভিনয়। চারদিন শুটিং হয়েছিল। ইন্ডোর শুটিং হয়ে গিয়েছিল। তারপরই ওনার মৃত্যু হয়। আউটডোরটা আর হয়নি। মনে পড়ে, ওই ছবির শুটিংয়ে একটা টেক দেওয়ার পর আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, অভিনয়টা ঠিক হচ্ছে কি না। আমি লজ্জায় পড়ে গিয়ে বলেছিলাম, ‘দাদা, আমি আপনাকে কী বলব!’ তখন উনি বললেন, ‘তুমি তো সামনে থেকে দেখেছ। ঠিক বা ভুল, তুমিই বলতে পারবে।’ অভিনয়ের সময় খুব সিরিয়াস হয়ে যেতেন। রেডিওতে হয়তো কেউ খেলার ধারাভাষ্য শুনছে। উনি বলতেন, বাইরে গিয়ে শোনো, এখানে কাজ চলছে। নিজের চোখে দেখেছি, ব্যালকনিতে পায়চারি করতে করতে সংলাপ মুখস্থ করছেন। তখন কারও সঙ্গে কথা নেই। কাজের প্রতি এতটাই নিষ্ঠাবান ছিলেন।

উত্তমদা যেদিন প্রয়াত হন, তখন সকালবেলা। আমি বাড়িতে চা খেতে খেতে কাগজ পড়ছিলাম। আমার থিয়েটারের এক বন্ধু ফোন করে ঘটনাটা জানায়। আমি তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি। কাঁদতে শুরু করে দিয়েছি। তখন ড্রাইভারও আসেনি। ট্যাক্সি করে উত্তমদার বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি, লোক থিকথিক করছে। আমি কোনওভাবেই কান্না থামাতে পারছি না। চারদিকে সবার চোখে জল। উত্তমদা হঠাৎ এভাবে চলে যাবেন কেউ ভাবতে পারেনি। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ভালো ছিলেন। সেদিন অনেকক্ষণ ছিলাম ওখানে। তারপর আর থাকতে পারিনি। বাড়ি চলে আসি। উত্তমদার মৃত্যুশোক সামলাতে আমার অনেক সময় লেগেছিল, আজও বোধহয় মনের সেই ক্ষত পুরোপুরি সারেনি।

উত্তমদার পরিচিতি তো কেবল বাংলায় সীমাবদ্ধ ছিল না, ভারতজুড়ে তিনি সমান জনপ্রিয় ছিলেন। যাকে বলা যায়, ‘হিরো নম্বর ওয়ান’। হাতিবাগান থেকে থিয়েটার করে ফেরার পথে দেখতাম উত্তম-সুচিত্রার ছবির টিকিটের জন্য মেয়েরা মারামারি করছে! উনি চলে যাওয়ার পর আমরা খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। এমনকি ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হতে বসেছিল বললেও অত্যুক্তি হবে না। তারপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তা-ও আমার মনে হয়, এখনও উত্তমদার বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি। উনি বেঁচে থাকলে হয়তো আর অভিনয় করতেন না, পরিচালনা বা অন্য কিছু করতেন। মোট কথা, বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে এরকম অভিভাবকহীন হয়ে পড়তে হত না।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *