যে বাঙালি, যে বাংলা ভাষা বলে, সে ভারতীয় নয়, অনুপ্রবেশকারী, এই জনতোষী বচনের মধ্যে আছে বিভেদের ‘বাইনারি’ তৈরির রাজনৈতিক চক্রান্ত।
রাক্ষসের নিরিখে মানুষ– ‘বাইনারি’ দৃষ্টিকোণে লাগসই দৃষ্টান্ত– অন্তত সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে তো বটেই। কেননা, মানুষ উন্নততর রাক্ষসের চেয়ে। কিন্তু রাক্ষসের নিরিখে বানরপ্রজাতি– যতই শক্তিশালী হোক না কেন– সামূহিক বিচারে কি বাইনারি বোধ তৈরি করে– যেমন কিনা ভালো ও মন্দ, আলো ও ছায়া, সেরকম?
‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ রচনায় সুগ্রীব প্রতিনিধিত্ব করছে বানর কুলের। রাক্ষসরাজ রাবণের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে সে। হাতাহাতির আগে চলছে কলহ-কাহন। ‘তবে রে রাবণ ব্যাটা/ তোর মুখে মারব ঝ্যঁাটা’, সুগ্রীবের কথা-হিংসার প্রত্যুত্তরে রাবণ বলছে– ‘ওরে বেয়াদব কহিলে যেসব/ ক্ষমাযোগ্য নহে কখনো’। তারপর যখন প্রকৃতই অস্ত্রপ্রয়োগের মুহূর্ত এল, তখন রাবণের প্রহারে সুগ্রীবের প্রাণ যায়-যায়। সুকুমারের কলম লিখছে এইভাবে– ‘ওরে বাবা ইকী লাঠি/ গেল বুঝি মাথা ফাটি/ নিরেট গদা ইকী সর্বনেশে!’
রাবণের লাঠির সঙ্গে সুগ্রীবের গদা এঁটে উঠতে পারে না শেষত। সাধের প্রাণটি নিয়ে অতএব সুগ্রীব প্রস্থান করে। রাক্ষসের সঙ্গে বানরকুলের যুদ্ধে বানর হারে, যেভাবে ‘মানুষ’ কুলপ্রদীপ লক্ষ্মণ শক্তিশেল খেয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এরপরেও বলতে হয়– মানুষের সঙ্গে রাক্ষসের ‘বাইনারি’ যেভাবে প্রতিষ্ঠিত, বানরের সঙ্গে রাক্ষসের ‘বাইনারি’ সেভাবে নয়। জঁাক দেরিদার কথা ধার করে বলতে পারি, ‘বাইনারি’ বা দ্বিমূল বিপ্রতীপ সম্পর্কে দু’টি
‘আইটেম’-এর একটি সবসময় অন্যের উপর প্রভুত্বের সম্পর্ক কায়েম করে।
‘শুভ’ যেমন ‘অশুভ’-র উপর সর্বাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়, যেভাবে ‘পুরুষ’ চায় ‘নারী’-র উপর অধিকার স্থাপন করতে। বানরের সঙ্গে মানবের সমন্বয় তৈরি করে রাক্ষস-বিজয়ের যে-বার্তা ‘রামায়ণ’ রেখেছে, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাটকে সেই শৃঙ্খলা ভাঙতে চাননি সুকুমার রায়, আবার মজা ও শ্লেষের অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়ে এও প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, মানব ও বানরের যোগসাজশ– আত্মশক্তিতে অতখানি বলীয়ান নয় যে, রাক্ষসের বিপ্রতীপে ‘যুগ্মক’ বলে প্রতিপন্ন হতে পারবে। রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধে হনুমান থেকে সুগ্রীব তাই নাকানিচোবানি খায়, জাম্বুবান কেবল বিরাটাকার বাণী দিয়ে ক্ষান্ত হয়, রামের অসহায়তা বাড়তে থাকে।
‘বাইনারি’ সম্পর্কে একপক্ষ আদতে অন্যপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, দেরিদার এই বক্তব্যকে আমরা সম্প্রসারিত করতে পারি ঘটমান রাজনীতির মর্মমূলে। ‘বাংলা বলা’ ও ‘বাঙালি সত্তা’ ঘিরে ভারতীয় জনতা পার্টি যে রাজনীতির সূচনা ঘটিয়েছে, তা এক আশ্চর্য ‘বাইনারি’ সমীকরণের দিকে আমাদের বাহিত করে যেন।
বাংলা যার মাতৃভাষা, সে ‘বাংলাদেশি’, আর সে-নিরিখে ‘অনুপ্রবেশকারী’। এ দেশ তার নয়। এই জনতোষী ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে ‘বঙ্গভাষা’র সঙ্গে ‘অনুপ্রবেশকারী’– এই তকমার একটি বিপরীতবাহী মনোভাবও তৈরি করা হচ্ছে। যে-সম্পর্কে, বঙ্গভাষার ঊর্ধ্বে প্রাধান্য পাচ্ছে ‘অনুপ্রবেশ’-জনিত অপরাধ। ‘নিয়ন্ত্রণ’ বা ‘ডমিনেন্স’-এর কথা উঠলে, এখানে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে বাঙালি সত্তার অবস্থান ও অভিমান। এই ‘বাইনারি’ বাঙালি কেন স্বীকার করবে?