- হর্ষ দত্ত
চলুন, পঞ্চাশ বছর পেছনে ফিরে যাই। বাংলা সাল ১৩৮২, ইংরেজি ১৯৭৫। আমরা কেউ কেউ তখন কলেজে পড়তে যাব বলে পা বাড়িয়ে আছি। কারও প্রথম বর্ষ, কেউ বা দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হয়েছি। আমরা সকলেই কিন্তু সাহিত্যের ছাত্র নই। বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, পদার্থবিদ্যা, ভূগোল ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা একদল পড়ুয়া। বিকেল ও সন্ধ্যার সন্ধিলগ্নে কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় এসেছি।
আজ পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ ১৩৮২। বঙ্কিম চাটুর্জে স্ট্রিট, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলেজ রো, টেমার লেন, বিধান সরণি, পটুয়াটোলা-বেনিয়াটোলা লেন ও মহাত্মা গান্ধি রোডের অংশ বিশেষ জুড়ে বিরাট বইয়ের জগৎ। বই প্রকাশকদের দপ্তর আর বইয়ের দোকান। লোকের মুখে মুখে অঞ্চলটির পরিচিতি কলেজ স্ট্রিট বইবাজার। প্রায় সব দোকান আজ খোলা। চতুর্দিক আলো ঝলমলে। রজনীগন্ধা ফুল ও গোলাপ জলের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। অভিজাত চেহারার, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা কিছু মানুষ এ-রাস্তা থেকে ও-রাস্তায় দ্রুত চলে যাচ্ছেন। লোকজনদের মধ্যে অনেকেই পরে এসেছেন নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি। তাঁদের বাঁ কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা। কারও হাতে মাঝারি সাইজের মিষ্টির প্যাকেট কিংবা তেল শুষে নেওয়া কাগজের ঠোঙা। দোকানে দোকানে নানা বয়সি ক্রেতাদের ভিড়। তবে উপচে পড়ছে না। তখন সদ্যতরুণ আপনি-আমি, সাহিত্য-রচয়িতাদের স্বচক্ষে দেখব বলে, প্রকাশকদের অফিসের সামনে দ্বিধাগ্রস্ত ও ভিতু চোখে দাঁড়িয়ে আছি। দিকপাল স্রষ্টারা হাসি-ঠাট্টা-আড্ডায় মগ্ন। এঁদের দেখতে পেলে জীবন যেন সার্থকতায় ভেসে যাবে।
কম পাওয়ারের হলদেটে ফিলামেন্ট বালবের লম্বা চেন ঝুলছে, কিন্তু মাইকের কোনও উৎপাত নেই। তবে মন্দ-মধুর কোলাহল আছে। কোথাও কোথাও কোনও কবি বা লেখক, রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজের বই বিক্রি করছেন। তাঁর গলার আওয়াজে সেই জায়গাটুকু সরগরম। লোকারণ্য হয়নি, কিন্তু সমগ্র অঞ্চলটা জমজমাট। সুবিখ্যাত তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, জীবনানন্দ দাশ কবেই বিদায় নিয়েছেন। সম্প্রতি চলে গেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। শিবরাম চক্রবর্তী খুব সুস্থ নন। প্রতিষ্ঠিত কবি-প্রাবন্ধিকরা আছেন, আবার অনেকে নেই। তবু আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পাঠক, প্রতিষ্ঠিত ও জীবিত এবং সেই সময়ের পাঠকপ্রিয়, বহুপঠিত প্রতিভাসম্পন্ন লেখকদের বই কিনতে, নিজের সংগ্রহে রাখতে সোৎসাহে কলেজ স্ট্রিটে চলে এসেছেন। পুরোনো, অনতিপুরোনো বইয়েরা যেন পাঠককে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে- ভুলবে না, ১লা বৈশাখ বইয়ের জন্মদিন। ওইদিন অবশ্যই বইপাড়ায় আসবে।
পঞ্চাশ বছর আগেকার এই ছবি কাল্পনিক নয়, গ্র্যানাইট পাথরে খোদিত ইতিহাস। কিংবা প্যাপিরাস পাতায় লেখা একটি তথ্য। ১৪৩২-এর বেশ কয়েক বছর আগে থেকে, এই চিত্র একটু একটু করে বদলাতে শুরু করে। তবে এতটা বদল স্বপ্নাতীত! হ্যাঁ, যথারীতি ২০২৫-এর ১৫ এপ্রিল বাংলা বইয়ের জন্মদিন পালিত হবে। কিন্তু তা অতীতের ছায়ামাত্র। অথবা বলতে পারেন, পুরোহিতকে মূল্য ধরে দেওয়ার মতো একটা কৃত্য। সত্যি সত্যি, সেদিনের আলো এখন ছেঁড়া ছেঁড়া অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। সেই অসহনীয় অন্ধকার দু-হাতে সরিয়ে, যদিও কিছু বড়সড়ো প্রকাশক পয়লা বৈশাখ এখনও পালন করেন। কিন্তু অতীতের সঙ্গে তুলনায় তা যেন নিয়মরক্ষা। কেন এই অবিশ্বাস্য পরিবর্তন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যেসব কারণের মুখোমুখি হতে হয়, তা মন খারাপ করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আবার তাদের মেনে নেওয়াও কঠিন। তবু বলতে হবে। হিরণ্ময় শব্দ দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখার চেয়ে জেনে নেওয়া ভালো।
বাংলা পুস্তক পাঠ সম্পর্কে অনীহা, বেশ কয়েক বছর ধরে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাস থেকে জন্মেছে অনভ্যাস নামক ভয়ংকর রোগ। বই পড়ার অভ্যাসকে বিদায় জানাতে বাঙালির হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়নি। পাঠকের ক্রমবর্ধমান অভাবে, পাড়ায় কিংবা অঞ্চলে অবস্থিত বহু লাইব্রেরির নিঃশব্দ অপমৃত্যু তার অন্যতম প্রমাণ। অনেকে সময়াভাবের দোহাই দেন। এর চেয়ে বাজে অজুহাত আর নেই। সব কাজ করার জন্যে সময় বরাদ্দ আছে, কেবল বই পড়া ও গ্রন্থাগারে যাওয়ার ব্যাপারে সময় তলানিতে চলে যায়! নিজের পড়ার তাগিদে বা উপহার দেওয়ার জন্যে, শিক্ষিত বাঙালি পরিবারের কেউ দোকান থেকে বা বুক ফেয়ার থেকে বই কেনেন কিংবা আদৌ কেনেন না- এ সম্পর্কে সরকারি বা বেসরকারি স্তরে কোনও বছরওয়াড়ি সমীক্ষা হয় কি? আমার জানা নেই। সদস্য সংখ্যার অভাবে অথবা পুস্তকের অপ্রতুলতার জন্যে পাঠাগারগুলো বন্ধ হয়ে গেছে- একথা ভাবলে ভুল হবে। এই দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী আমাদের স্বভাব। সেইসঙ্গে সরকারি অব্যবস্থা এবং ঔদাসীন্য। দুর্ভাগ্য এই যে, শৈশবের মধ্যেও চারিয়ে গেছে এমন স্বভাব। মা-বাবা সন্তানকে টানতে টানতে গানের, নাচের, আবৃত্তির ক্লাসে অথবা আউটডোর-ইন্ডোর স্পোর্টস কমপ্লেক্সে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু পাড়ার আশপাশে অবস্থিত যেসব লাইব্রেরি প্রবল সংগ্রাম করে ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে এখনও বেঁচে আছে, সেখানে ওই অভিভাবকরা ভুলেও, সপ্তাহে দু-তিন ঘণ্টার জন্যে বাচ্চাদের বাংলা শিশুসাহিত্য পড়াতে নিয়ে যান না। এর ব্যতিক্রম থাকতেই পারে, অস্বীকার করছি না। তবে তা যৎসামান্য। হিসেবের মধ্যে আসে না।
বাংলা বইয়ের বিপুল পাঠযোগ্যতাকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার পেছনে একদিকে যদি থাকে বাঙালির আত্মঘাতী স্বভাব, তাহলে অপর দিকে আছে বিজ্ঞানের এক অসীম, অনন্ত অবদান। তার নাম কম্পিউটার। অখণ্ড বিশ্বকে সে তার সত্তার ভেতরে যেমন ঢুকিয়ে নিল, তেমনই বিভিন্ন যুগের অযুত-কোটি কাগজে ছাপা বইগুলো গ্রাস করল। কম্পিউটার তার অন্যতম উপাঙ্গ অ্যাপ-এ, পিডিএফ ফর্ম্যাটে নির্বিচারে তাদের সাজিয়ে রাখল। একটা আস্ত বই ‘ই-বুক’ নামে পরিবর্তিত হয়ে গেল। এধার-ওধার ছাপার বদলে প্রতিটি পাতার স্বতন্ত্র ছবি। বইয়ের জন্যে কোনও আলমারি, শেলফ, ডিসপ্লে টেবিল বা চ্যানেলের দরকার নেই। চেয়ারে বসে কাঙ্ক্ষিত বইটি মনিটরে আনতে যেটুকু সময় লাগবে। বই-আগ্রাসন শুধু কম্পিউটারেই শেষ হয়ে গেল না। নানান ব্র্যান্ড ‘ই-বুক’ বিতরণে নামল। বই এলো মোবাইলে, ট্যাবলেটে, ল্যাপটপে। বইটি পড়ার জন্যে পেমেন্ট মিটিয়ে শুধু ডাউনলোড করার অপেক্ষা। কোনও কোনও বই আবার বিনে পয়সায় পড়া যায়। ফলে, ছাপার অক্ষরে কাগুজে বই তার অনেক শতাব্দীর গৌরব হারাতে শুরু করল। প্রায় পাঁচশো পঁচাত্তর বছর আগে ইউরোপে, ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে বই ছাপানোর শুভারম্ভ। ইংরেজি ও বাংলা হরফ মিশিয়ে বাংলা ছাপা বইয়ের প্রথম আত্মপ্রকাশ ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে।
সহজলভ্য, সংরক্ষণহীন ‘ই-বুক’-এর আক্রমণে বাংলা বইয়ের প্রকাশকরা বিপর্যস্ত হয়ে গেলেন। ছাপা বই ডাঁই হয়ে পড়ে আছে। ক্রেতা নেই। আকাশের মতো বাজার ফাঁকা। সমীক্ষা করে তাঁরা দেখলেন, উপন্যাস-গল্প-কবিতা ইত্যাদি সৃষ্টিধর্মী বইয়ের বিক্রি সবচেয়ে খারাপ। হাতেগোনা কয়েকজনকে বাদ দিলে নবীন প্রজন্ম (ধরা যাক ২৫ থেকে ৪৫ বছর) পাঠকপ্রিয় হতে পারছেন না। তাঁদের নামের সঙ্গে পরিচিত নন, সেই জন্যে নবীনদের রচনার প্রতিও পাঠক অনাগ্রহী। ষাট-সত্তর থেকে বিশের দশক পর্যন্ত যাঁরা পাঠক টানতে পেরেছিলেন, তাঁরা এখনও কমবেশি টানছেন। কিন্তু একুশ থেকে খরার প্রাবল্য নাকি বেড়েই চলেছে। এই দুর্ভোগের কারণে ও বাঁচার তাগিদে, অনেক প্রকাশক ইতিমধ্যে সৃজনশীল লেখা ছাপানো বন্ধ করে দিয়ে, স্কুলপাঠ্য বই প্রকাশ করছেন। কলেজ স্ট্রিটে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, এই বিপরীত মেরুর ব্যবসায় লাভ আশাতীত। পাঠ্যপুস্তক বিক্রি এখন প্রকাশক ও বইবিক্রেতাদের কাছে সেরা অবলম্বন।
অবস্থা যদি এই পথে চালিত হয়, তা হলে কবিতা-প্রবন্ধ-গল্প-উপন্যাস কি ধুলোয় গড়াগড়ি খাবে? আজ্ঞে না। এই সমস্যার সমাধানের জন্যে, বেশ কিছু মাঝারি ও ছোটখাটো প্রকাশক, একটা রফাসূত্র কয়েক বছর আগে বের করে ফেলেছিলেন। সূত্রটি এই, নিজের টাকায় নিজের বই ছাপুন। প্রকাশক হিসেবে আমার নাম থাকবে। আমি বইটি বিক্রির ব্যাপারে সচেষ্ট থাকব। কিন্তু সেটা দায়বদ্ধতা নয়। রয়্যালটি বলে কিছুই থাকবে না। কেননা ইনভেস্টমেন্ট, প্রফিট ও লস–তিনটেই আপনার। যশঃপ্রার্থীদের সামনে এখন এই একটি রাস্তাই খোলা আছে।
এই মুহূর্তে বাংলা বইয়ের ভবিষ্যৎ কি তাহলে এগিয়ে চলেছে এমন দুরবস্থার দিকে? দোলাচলে অবস্থিত এই জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়া প্রায়ান্ধকারের মধ্যে, আশার আলো জ্বালিয়ে রাখতে চেষ্টা করছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন বড়মাপের ঐতিহ্যবাহী প্রকাশক। সৎপথে উচ্চমান ও মধ্যমানের বই প্রকাশ করার কাজে তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নীরবে তাঁরা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন। কিন্তু বাংলা বই প্রকাশের একমাত্র দায়িত্ব তাঁদের নয়। অন্য প্রকাশকদেরও সোজা রাস্তায় দায় নেওয়া জরুরি। সবচেয়ে বড় দায় পাঠকদের। তাঁদের এখনই এগিয়ে আসতে হবে। মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর জন্যে নয়, বাংলা বইকে বাঁচিয়ে রাখার শপথ নেওয়াই তাঁদের প্রধান কাজ।