- ময়ূরী মিত্র
একগাদা নাল ফেলে ঘুমোচ্ছিল পানু৷ নাল ঝরিয়ে ঘুমোতে আজকাল খুব সুখ হয়৷ না খেয়ে খেয়ে রোগ বাধাবার পর পানুর নালসুখ আরও বেড়েছে৷ ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষ তো আর নাল পড়ছে কি না বুঝতে পারে না৷ ফলে ঘুমিয়ে উঠে ঠোঁটের গোড়ায় জমা জল দেখে পানুকে বুঝতে হয় …ঘুমটা ঠিক কতটুক ঘন হয়ে এসেছিল! আজও সেই ঘুমটাই দিচ্ছিল! হঠাৎ ওপর থেকে মানুষের বাচ্চার পটি ভর্তি থলে মাথার ওপর পড়ল। ধড়ফড় করে উঠে বসল পানু৷
তিনটে ম্যাও লাফ মেরে পাঁচিলে চলে গেল৷ তিনটেই পানুর৷ ম্যাও তিনটে পোষার পর থেকেই ওপর থেকে যা তা ফেলার এই বাড়তি উৎপাতটা যোগ হয়েছে তার জীবনে৷ ম্যাওগুলোকে খুবই স্নেহের চোখে দ্যাখে পানু৷ স্নেহভরেই তাদের হিসু হাগু একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে রাস্তায় ফেলে আসে দু’বেলা৷ সেটাই বোধহয় কোনওদিন ওপর থেকে দেখে ফেলেছিল তিনবাচ্চাওয়ালা মাড়োয়ারি বৌটা৷ ব্যাস! সেই থেকে শুরু হয়েছে পানুর আধা টেকো মাথার ওপর যখন-তখন হিউম্যান পটি, দুধে গোলা ওটস, ড্রাগন ফলের গোলাপি খোসা ইত্যাদি আপাত মূল্যবান সব জিনিস ছুড়ে ফেলা৷ মানুষের হাগা পড়ছে তার মাথায়! মনে পড়লেই পানুর আর পরিষ্কার করতে ইচ্ছে হয় না৷ এইসব সময়ে তাই ইংরেজি নামটাই মনে আনার চেষ্টা করে৷
মানুষ ও পশুর দু’ধরনের পটি বড় প্যাকেটে মাখন মিক্সিং করে ফেলে দিল পানু৷ সামান্য ময়লা ফেলার কাজটিকে যথেষ্ট পরিমাণ জটিল করে গন্ধসাবান আর তোয়ালে নিয়ে বৈকালিক চানের জন্য প্রস্তুত হল৷ বন্ধু আলি প্রতি মাসে সাবান, ক্রিম, গা ঘষার স্পঞ্জ একটা প্যাকেটে করে পানুকে দিয়ে যায়৷ এ মাসে গায়ের ময়লা তোলার ছোবড়াও দিয়ে গেছে৷ আলি ছেলেটা গুছোনো৷ তবে পানুর বিরুদ্ধে সারাক্ষণ অভিযোগ রাখে …।
‘হ্যাঁ রে, পানু বৌটাকে নিজেই তো তাড়ালি! এমন ভাব করলি যেন বৌ দূর না হলে তোর সংসারই ব্যর্থ! তা কেন এখন সাবান টাবান না মেখে এমন ভূত হয়ে যাচ্ছিস! তাড়িয়ে আবার তার জন্য এত দুঃখ মানায়!’
এসব কথায় পানুও চুপ থাকে না৷ মুখের ওপর সটান বলে দেয় ‘আলি যা বুঝিস না, তা নিয়ে কথা বলিস না প্লিজ৷ প্রেম ঘেন্নার মানানসই বলে কিছু হয় না! দুটোই একেবারে চরম! ধর গিয়ে দোদোমা৷ একসঙ্গে দু’বার শোর মাচায়৷ যা যা, তোর ছোবড়া সাবান নিয়ে চলে যা! রোজ রোজ ফর্সা হতে পারব না!’
পানু জানে, তার মুখে ‘যা যা’ সহ্য করতে পারে না৷ হাত-পা ধরে একদম কান্নাকাটি শুরু করে দেয় …
‘ও পানু৷ ও আমার মনাসোনা৷ তোর কথা মানছি রে! এই দ্যাখ ….আবার মুখ ঘুরোয়৷ পুরো মানছি রে তোকে! অমন সুন্দরী বৌয়ের শরীর ঘাঁটার পর তার আগুনপোড়া লাল মুখ দেখতে নারাজ হয়েছিল তোর মন! তাই তাড়িয়েছিস! তা সে তো বাপু চলে গেছে! এখন গা না মেজে, দই দুধ না খেয়ে নিজের কাঁধ ভুঁড়ি শুকোচ্ছিস কেন? কেনই বা বাপের এত্ত বড়ো বাড়িটা প্রোমোটারকে দিলি? আচ্ছা বেশ বেশ! নাহয় ক্যাশের জন্য দিয়েছিস! তাহলে ক্যাশ বুঝে নে৷ ওপরের বড় বারান্দাওয়ালা ফ্ল্যাটটায় উঠে যা৷ তা না– একতলার মশাভর্তি খুপরি ঘরে তিনটে বেড়াল নিয়ে ন্যাকামো লাগিয়েছিস৷ সরি সরি, ন্যাকামি শব্দটা বাজে বলে ফেললাম আবার! বেড়ালের সঙ্গে এত প্রেম কেন তোর! এবার থেকে প্রতি সপ্তায় চারটে করে, মোট ষোলোটা পাতা শ্যাম্পু দিয়ে যাব৷ সপ্তা শেষে পাতা গুনে নেব৷ দেখি, মাথায় শ্যাম্পু না দেওয়ার আর কত বাহানা তুই করতে পারিস!’
কত কী যে বলে আলি! আলি যতক্ষণ বকে পানু হাসে৷ মুখে যতই গাল পাড়ুক পাড়ার সব লোক জানে পানু আলি পরস্পরকে নিয়ে সুখে থাকে৷ পানু বিড়ি মুখে মশকরা করে৷ আলি পানুর নখের ময়লা পরিষ্কার করে৷ আলির মা ম্যাওদের জন্য লাইলনটিকা মাছ রেঁধে পাঠায়৷ ঠিকঠিক মশলা থাকলে ম্যাওদের টিফিনবক্স থেকে পানুও খেয়ে নেয়৷
চানঘরে ঢুকতে যাবে, পাশের হোমিওপ্যাথি ডিসপেনসারির টিনের চালে চোখ গেল পানুর৷ দু’দিন ধরে বড্ড চুপচাপ বাড়িটা৷ ও বাড়ির মেয়ে সারদার বর মরেছে৷ সারদার বর পর্বতারোহী ছিল৷ ব্যাটা ওপরে উঠতে গিয়ে পা হড়কে মরেছে! হাসতে হাসতে খানিকটা বডিঅয়েল ম্যাসাজ করে নিল পানু৷ আজ সে গন্ধ মেখে সারদাকে দেখতে যাবে৷
২
আজও যত্ন করে রোগী দেখলেন হরিচরণ৷ সকাল থেকে চা অব্দি খাননি৷ ফিরেও খাবেন কি না, ঠিক করতে পারেননি৷ একমাত্তর মেয়েটা বিয়ের এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার স্বামীহারা হয়েছে৷ দু’দিন আগে সারদার ফোন বেজেছিল৷ শীতের রাত ঘন কুয়াশা ছড়াচ্ছে তখন৷ বিছানায় শুয়ে শুয়েই হরিচরণ দেখলেন শুকতারার আলোয় মোবাইল কানে সারদা৷
‘এই সারদা ভোররাতে কার ফোন? আমায় না দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কী ফিশফিশ করছিস! এই সারদা …’
ততক্ষণে সারদা পাথর৷ একটুও না কেঁদে বাবাকে সুব্রতর মরার খবর দিয়েছিল৷ ঠিক সেইসময় সারদার আগুনে পোড়া সাদা হাত দুটো চোখে পড়েছিল হরিচরণের৷ দুটো হাত একটু বেশিই ফাঁকা মনে হচ্ছিল৷ হরিচরণের মনে পড়েছিল, এক মাস আগে রেজিস্ট্রি বিয়ের পরপরই মায়ের শেষ বালা দুটো সুব্রতর হাতে তুলে দিয়েছে সারদা৷ ঘরদোরহীন সুব্রতর মাটি ছেড়ে পর্বতে ওঠার রাহাখরচ৷ সারদার এটা দু’নম্বর বিয়ে৷
শুকতারা দেখতে দেখতে বিড়বিড় করছিলেন হরিচরণ, ‘সুব্রত অনেক উচ্চ হয়ে গেল সারদা! ঘরে এসে ভালো করে সিঁদুর পরে নে৷ খানিক রেখে চেঁছে তুলে নিস!’
সারদা কথা বলেনি৷ ঘরে আসেনি৷
রোগী শেষ হয়ে গেছে কখন! তবু ওষুধের শিশিগুলো ঠুকঠুক করেই যাচ্ছিলেন হরিচরণ। সারদার মুখে মাখবার মলম ফুরিয়েছে৷ পোড়ার পর থেকে আজ পনেরো বছর ধরে মেয়ের মুখে মলম লাগান৷ মেয়ের মাথার চুল সাদা হয়ে গেল! তবু মুখের ক্ষত সারল না৷ কালীপুজোর আগুনে সারদা পুড়েছিল খুব৷ হাসপাতালে পূর্ণ চিকিৎসার পর প্রথম বরটা যখন সারদাকে হরিচরণের কাছে দিয়ে গেল, তখনও হরিচরণ ভেবেছিল বড়জোর মাসতিনেক! এর মধ্যেই চিকিৎসক বাবার সেবা নিয়ে সারদা বরের বিশাল বাড়িতে ফিরবে৷ যে বর এত খরচ করে বৌয়ের জ্বালাপোড়া সারাতে চায়, সে কখনও বৌকে বাপের কাছে ফেলে রাখবে না৷ বরের বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হল৷ সারদা বাবার কাছে থেকেই গেল৷ মলম হাতে কড়া চোখে পাশের ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল হরিচরণ৷ একবার তাঁকে যেতে হবে ওখানে৷
হতভাগা ইদানীং আবার বেড়াল পুষে রেখেছে ক’টা৷ মেয়েটার এত ভয় বেড়ালে! তবু দেখো, তিনটে ধাড়িকে যখন-তখন ছেড়ে দেয় এদিকে!
টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে আলি ঢুকছে! ফ্ল্যাটবাড়ির গলি এত সরু, বিরক্ত লাগে! হরিচরণ চেঁচালেন, ‘এই আলি বন্ধুকে শোধরাতে পারিস না! শুধু খাইয়ে খাইয়ে হাতি করছিস! চান করাচ্ছিস! ছুঁচুটা বাদ থাকে কেন!’
‘বাবা!’
৩
বেড়ার গেট খুলে পানু যখন হরিচরণের উঠোনে পৌঁছাল, পা দিয়ে বকুলগুলো পিষছিল সারদা৷ বাবা আজ তার মুখের পোড়া নিয়ে যাচ্ছেতাই গালাগাল করেছে৷ কী জোরে জোরে মলম ঘষেছে! একটার ছাল উঠি উঠি করছিল৷ সেটাকে একটানে ছিঁড়ে নিয়েছে বাবা৷ সারদা রাগে ফুটছিল৷ কী করবে! কান্না অনেকদিন কাছে আসে না৷
‘এতদিন পর আমার শান্তি হল রে সারদা– এতদিন পরে তোর পোড়া মুখ দেখার ফের ইচ্ছে হল’, হিসহিসিয়ে বলল পানু৷
সারদা চুপ৷ কঠিন চোখ টানটান৷ পানুর দিকে তাকিয়ে৷ আরও দুটো বকুল মাটিতে মিশল৷
‘এই একদম অমন তাকাবি না৷ চোখ খুবলে নেব তোর৷ শয়তান মেয়ে একটা! এই–এই চুপ করে থাকতে দেব না কিছুতে৷ বল–পোড়ার পরও আমি তোকে বুকে জড়িয়ে রাখতে চেয়েছিলাম কি না! হরি ডাক্তার এখনও জেগে আছে৷ যা, বাপকে গিয়ে বলে আয়! আমার বুকটাকে ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত কার ছিল! বল কে আমাকে পাঁচিলের ওপারে একা করে চলে এসেছিল! আজ তোকে বলতে হবে সারদা৷’
হাউহাউ করে কাঁদছে পানু৷
‘ওরে সারদা সবাই ভেবেছে, আমি আগুনে পোড়া অসুস্থ বৌটাকে ছেড়ে দিয়েছি৷ সারদা রে! পনেরো বছর ধরে মানুষের ঘেন্না সয়েছি৷ যদি ভেবে থাকিস তোর ওপর আমার এখনও মায়া দয়া আছে ভুল ভাবছিস! দ্বিতীয় বর মরেছে বলে আবার আমার ঘরে ফিরবি, আশা করছিস তো! ভুল ভুল৷ তোর ঘা নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে শেষ করে দেব৷ তবু আমার ঘরে তোকে আর ফেরাব না৷ তোকে আগে বলতে হবে৷ বল বলছি– সারদা৷ আমি তোর বন্ধু৷ তোকে বিধবা দেখতে তবু কী আনন্দ হচ্ছে রে!’
বেড়ার কাছে আলি দাঁড়িয়ে৷ সেও তার ছেলেবেলার বন্ধুকে দেখতে এসেছে৷ নিশ্চুপ সারদার সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে পানু কখন মাটিতে মুখ দিয়ে শুয়ে পড়েছে! সারদা বাকি ফুলগুলো রাখার জন্য পাত্তর খুঁজছে!
‘ও আলি, পানুকে ছাড়া ছোটবেলা থেকে কাউকে ভালোবাসিনি রে আলি৷ আমার এত ভালোবাসার–এত সুন্দর দেখতে বরটা রোজ সকালে আমার চামড়া কুঁচকানো মুখ দেখবে! আমার এ মুখ ওর ঘাড়ে চাপালে আমিই যে বইতে পারব না রে আলি! তুই গিয়ে পানুকে বলিস–আমিই আর ফিরব না৷ কিছুতে না৷’
কবেকার কথা। দগ্ধ বন্ধুর একটি শব্দও ভোলেনি আলি৷
হরিচরণ ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছেন৷ বাড়ি ফিরে আলি মায়ের কাছে সারদা পানুর পুরোনো গল্পটা শোনাতে বসেছে৷ তাতে হয়তো নতুন কথারা ঢুকে পড়ছে৷ সারদা বাকি বকুল বাবার ওষুধখানার টেবিলে সাজাচ্ছে৷ কালকের রোগীরা সুবাস পাবে৷
আধা চাঁদের আলোয় কেবল তিনটে ম্যাও৷ একই পাড়ার তিন তিনটে বন্ধুর সুখ দেখে তারা মাছের কাঁটা খুঁজতে যাবে৷
The put up বসন্তে পানুকুমার appeared first on Uttarbanga Sambad.