‘ফ্লাওয়ার অফ দ্য নেটিভ স্টেজ’ বিনোদিনী 

‘ফ্লাওয়ার অফ দ্য নেটিভ স্টেজ’ বিনোদিনী 

ভিডিও/VIDEO
Spread the love


অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য

‘বঙ্কিমবাবু মহাশয় নিজে বলিয়াছিলেন যে— আমি মনোরমার চিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম, কখনো যে প্রত্যক্ষ দেখিব এমন আশা করি নাই, আজ বিনোদের অভিনয় দেখিয়া সে ভ্রম ঘুচিল।’ বিনোদিনী দাসী বলেছিলেন একথা। অন্যদিকে অমৃতলাল বলেছিলেন, ‘যে বঙ্কিমচন্দ্রকে আমরা আজ সাহিত্যগুরু বলে থাকি, থিয়েটারই তাঁকে সর্বসাধারণের চোখের সামনে ফুটিয়ে দিয়েছে।’ এই অমৃত বচনটি সর্বাংশে স্বীকার করে নেবার মতো কোনও যুক্তি আমাদের নেই। তবে কথাটার গুরুত্ব আমরা একেবারে অস্বীকারও করতে পারি না। আমরা বলি, শুধু বঙ্গসাহিত্যের ইতিবৃত্তেই নয়, বঙ্গীয় নাট্যশালা বা বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসেও বঙ্কিমচন্দ্রের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রয়েছে। এবং এই শাখায় নাট্যকার মধুসূদন, দীনবন্ধু ও গিরিশচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র এক আসনে বসার অধিকারী। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের কাছে বঙ্কিমচন্দ্র নিশ্চয় কিছু পরিমাণে ঋণী, তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রঙ্গমঞ্চের ভূমিকা অস্বীকৃত হবার নয়। কিন্তু সেইসঙ্গে একথাও আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না যে, বঙ্কিমচন্দ্রের কাছেও বঙ্গীয় নাট্যশালা বিশেষভাবে ঋণী এবং সেই ঋণের পরিমাণটাও সামান্য নয়।

যে বঙ্কিমের নিকট নাট্যশালার ঋণের কথা বলছি, সেই বঙ্কিম নিজে কিন্তু একখানিও নাটক লিখলেন না সারা জীবনে। উপন্যাস লিখলেন, সাহিত্য সমালোচনা করলেন, কবিতা লিখলেন, পত্রিকা চালালেন— কিন্তু নাটক লেখায় হাত দিলেন না কখনও।

সে যুগে বঙ্কিমের অনেক ক্ষুদ্র শত্রু ছিল— তাঁদেরই একজন লিখেছিলেন, ‘উপন্যাসে মজা লুটে কাব্যের বাজারে,/ সুরসিক কোনো কবি উঁকি-ঝুঁকি মারে।/ ইনি যে সমালোচক/ সুপ্রসিদ্ধ সম্পাদক/ লিখেছেন বঙ্গদেশে বহু উপন্যাস।/ কবিতা পুস্তকে এঁর বিদ্যার প্রকাশ,/ বিশ্বকর্মা শিল্পকর/ জগন্নাথে চরাচর/ সহজেই বুঝিয়াছে, ওগো সম্পাদক।/ সব হল বাকি কেন বাঙ্গালা নাটক?’

শ্রীশচন্দ্র মজুমদার একবার বঙ্কিমচন্দ্রকে বলেছিলেন, এবার একটা নাটক লিখতে চেষ্টা করুন না কেন? উত্তরে বঙ্কিমচন্দ্র বলেন, কার জন্য লিখব? তেমন শ্রোতা নেই, তেমন অভিনেতা নেই, তারপর নাটকের ভাষাও এখনও তৈরি হয়ে ওঠেনি। শ্রীশচন্দ্র বলেছিলেন, মৃণালিনীর সপ্তম সংস্করণে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, আগাগোড়া তো প্রায় নাটক! বঙ্কিম কথাটা অস্বীকার করেননি। বলেছিলেন, থিয়েটারে আমার বইয়ের দুর্দশা করা হয়েছে, তা দেখে ওরকম করতে হয়েছে আমাকে।

চুঁচুড়ায় এই মৃণালিনী উপন্যাসেরই একবার অভিনয় দেখতে দেখতে বঙ্কিমচন্দ্র কীরকম আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন তার বিবরণ পাই শচীশ চট্টোপাধ্যায়ের বঙ্কিম-জীবনী বইটিতে। ‘‘অনেক গণ্যমান্য লোক অভিনয় দর্শন করিতে আসিয়াছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রও অবশ্য উপস্থিত ছিলেন। তিনি একাগ্রচিত্তে ব্যোমকেশের অভিনয় দেখিতেছিলেন। যেখানে ব্যোমকেশ মৃণালিনীর হাত ধরিয়া টানাটানি করিতেছে, আর পদাঘাত খাইয়া বলিতেছে, ‘ও চরণস্পর্শে মোক্ষপদ পাইব। সুন্দরী তুমি আমার দ্রৌপদী—আমি তোমার জয়দ্রথ’—সেখানে বঙ্কিমচন্দ্র আত্মহারা ও বাহ্যজ্ঞান-বিরহিত হইলেন। তারপর যখন অকস্মাৎ গিরিজায়া ব্যোমকেশের পশ্চাতে আসিয়া তাহার পৃষ্ঠে দংশন করিল ও বলিল, ‘আর আমি তোমার অর্জুন’—তখন বঙ্কিমচন্দ্র সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত হইয়া চেয়ার ছাড়িয়া মহাবেগে লাফাইয়া উঠিলেন। তাঁহার এ কার্য অনেকেই লক্ষ্য করিয়াছিলেন, লক্ষ্য করিবার বিষয়ও বটে।’’

দুর্গেশনন্দিনীর প্রথম ছত্রটি মনে পড়ে! ‘৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন।’ এর পৌনে তিনশো বছর পরে এই মানুষটি একেবারে জ্যান্ত আরবি ঘোড়ায় চড়ে বঙ্গের রঙ্গমঞ্চে এসে উপস্থিত হলেন, যেমন তেজি সেই শ্বেতবর্ণ অশ্ব তেমনি সুদর্শন তার অশ্বারোহী পুরুষ। সেটা ১৮৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। বাঙালি পাঠক এতদিন দুর্গেশনন্দিনীর জগৎ সিংহকে ছাপার হরফের মধ্যেই দেখে এসেছিল, এখন কলকাতার বেঙ্গল থিয়েটারের মঞ্চে তাকে চোখের সামনে অশ্বপৃষ্ঠে দেখতে পেয়ে চঞ্চল হয়ে উঠল। নিশীথে শৈলেশ্বরের মন্দিরে একদিন জগৎ সিংহ সুন্দরী তিলোত্তমাকে দেখে তার রূপে মুগ্ধ হয়েছিল, বেঙ্গল মঞ্চে মহারাজ মানসিংহের পুত্রের সঙ্গে বঙ্গজননীর সন্তানেরাও তিলোত্তমাকে কাছের থেকে দেখতে পেয়ে মুগ্ধ এবং পুলকিত হলেন। সৌন্দর্যে মুগ্ধ কে নয়? জগৎ সিংহের ভূমিকায় শরৎচন্দ্র ঘোষ এবং তিলোত্তমার ভূমিকায় জগত্তারিণী অভিনয় করেন। তবে আয়েষার চরিত্রে রূপদান করেন জনৈক পুরুষ অভিনেতা। রূপসজ্জার গুণে অভিনয়ের নৈপুণ্যে ও গল্পের আকর্ষণে আয়েষা যে মহিলা নয়, সেকথা সেই রজনীতে কে বোঝে!

বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে শরৎচন্দ্র ঘোষের জগৎ সিংহের অভিনয় প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। সেকালের সুবিখ্যাত নটী বিনোদিনী দাসী তাঁর ‘আমার কথা’য় বেঙ্গলের স্টেজ ও অশ্বারোহী অভিনেতা শরৎচন্দ্র ঘোষের কথা লিখে গেছেন। ‘প্ল্যাটফর্মের আগাগোড়া মাটি—মাঝে খানিকটা তক্তা বসানো, নীচে সুড়ঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে স্টেজের ভেতর হতে বরাবর অডিটোরিয়াম যাওয়া যেত। যারা কনসার্ট বাজাত তারা ওই পথ দিয়েই যাতায়াত করত। মাটির প্ল্যাটফর্মের কারণ এই—বেঙ্গল থিয়েটারের স্টেজে অনেক নাটকে ঘোড়া বার করা হত। শরৎবাবুর ঘোড়ার সখ ছিল খুব, তিনি খুব ভালো সওয়ার ছিলেন।’

৩ জানুয়ারি ১৮৭৪ বেঙ্গল মঞ্চে দুর্গেশনন্দিনীর আবার অভিনয় হয়। বঙ্কিমের নাটক দেখতে সেকালে দারুণ ভিড় জমত। রঙ্গালয়ে জায়গা পাওয়া যেত না। ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজ ৩ জানুয়ারির অভিনয়ের বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছে— রঙ্গালয় কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল। দুশোরও বেশি লোক স্থানাভাবের জন্য টিকিট পায়নি। এই সফল নাট্যাভিনয় আরও কয়েক রজনী প্রদর্শনের জন্য আমরা ম্যানেজারকে অনুরোধ জানাচ্ছি।

এদিকে, গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে বিপুল সমারোহের সঙ্গে মঞ্চস্থ হল বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা—১৮৭৪-এর ৭ এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি। উপন্যাসের নাট্যরূপ দিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। ভারত সংস্কারক পত্রিকার সমালোচক ২০ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় এই নাট্য রূপান্তরের প্রশংসা করেননি। সমালোচকের মতে, উপন্যাসের নাট্যরূপ দেওয়া সহজ কাজ নয়। ‘নাটককার মনে করিয়াছিলেন, উপন্যাসের কেবল কথোপকথন ভাগগুলি নির্বাচন করিয়া লইলেই বুঝি নাটক প্রস্তুত হইল। উপন্যাসে যে সমস্ত কথাবার্তা থাকে, নাটকে তাহা আবশ্যক না হইতে পারে। উপন্যাসকে নাটকরূপে পরিণত করিতে হইলে তাহার কল্পনার উত্তমরূপে পর্যালোচনা করা চাই। পরে কল্পনাকে এমত সকল অঙ্কে এবং গর্ভাঙ্কে বিভক্ত করিতে হইবে, যাহাতে পাত্র ও পাত্রীগণের চরিত্র, আন্তরিক কার্য ও ভাব তাহাদিগের রিপুদোষ ও হৃদয়ের মহদ্ভাব-সকল এবং পরিশেষে নাট্যকাব্যের সমুদায় কল্পনার বৃহদ্ভাবগুলি অভিনয়কালে পরিষ্কৃতরূপে হৃদগত হইতে পারে। এজন্য নাটকে যে সমস্ত দৃশ্য সন্নিবিষ্ট হইবে, উপন্যাসে তাহা না থাকিতে পারে।’

২১ এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে নামানো হল বঙ্কিমের আর একখানি উপন্যাস মৃণালিনী। এই উপন্যাসেরও নাট্যরূপ দিলেন গিরিশচন্দ্র। পশুপতির ভূমিকায় অংশগ্রহণ করলেন তিনি। তাছাড়া বিভিন্ন চরিত্রে রূপদান করলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমৃতলাল বসু, মতিলাল সুর, মহেন্দ্রলাল বসু প্রমুখ। এই নাটকে কোনও অভিনেত্রী অংশগ্রহণ করেননি। পুরুষেরাই স্ত্রী চরিত্রে রূপদান করেন। এই নাট্যাভিনয় খুবই সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল। কয়েকদিন পর ১৩ মার্চ ১৮৭৪ ভারত সংস্কারক পত্রিকা এই অভিনয় দেখে লেখে, ‘মৃণালিনীর প্রতি ব্যোমকেশের আসক্তি ও তন্নিবন্ধন অত্যাচারোদ্যম ও ঘৃণিত ভাবব্যঞ্জক শারীরিক বৈলক্ষণ্য এবং গুরুতর আঘাত নিবন্ধন প্রলাপ ও আর্তনাদ এবং অবশেষে যবন কর্তৃক আক্রান্ত হইয়া সভয়ে কম্পন ও পতন এবং মৃত্যুকালে আত্মদুষ্কৃতি স্মরণ ও অঙ্গাদি সঞ্চালন প্রভৃতি যাবতীয় ক্রিয়া কোনো রিপুপরতন্ত্র মূর্খ চঞ্চলমতি ভীরু ভদ্র সন্তানের অনুষ্ঠিত কার্য সকলের ন্যায় অবিকল হইয়াছিল।’

গ্রেট ন্যাশনাল ২৫ জুন ১৮৭৪ বহরমপুরের স্টেশন থিয়েটারে কপালকুণ্ডলা অভিনয় করে। এই অভিনয় দেখে বঙ্কিমের এক অনুরাগী ভক্ত-পাঠক রীতিমতো রেগেমেগে ৫ জুলাই সাধারণী পত্রিকায় এক দীর্ঘ পত্র লেখেন। ‘এরূপ অভিনয় দেখিতে রাত্রি জাগরণ বৃথা কষ্ট এবং অর্থব্যয় করা অপব্যয় ভিন্ন নহে। কপালকুণ্ডলা বাঙ্গালা ভাষার একখানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ। ইহার রচনাপ্রণালী এবং গল্পটি আদ্যোপান্ত মধুর ও নির্দোষ কিন্তু নাটকখানি তেমনি কদর্য হইয়াছে, এখানি মুদ্রিত হইলে বঙ্কিমবাবুর কাব্যের অপমান করা হইবেক।’

১৮৭৭ সালের এপ্রিলে বেঙ্গল থিয়েটার বঙ্কিমের তিনখানি বই পরপর মঞ্চস্থ করল। ১৬ এপ্রিল মৃণালিনী, ১৮ এপ্রিল কপালকুণ্ডলা ও ২১ এপ্রিল দুর্গেশনন্দিনী। মৃণালিনীতে মৃণালিনী, গিরিজায়া ও মনোরমার ভূমিকায় অংশগ্রহণ করেন যথাক্রমে বনবিহারিণী, সুকুমারী দত্ত ও বিনোদিনী। বিনোদিনীর অভিনয় নৈপুণ্য দেখে সকলেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। কপালকুণ্ডলায় নবকুমার ও কপালকুণ্ডলা হন যথাক্রমে হরি বৈষ্ণব ও বিনোদিনী। এইসব নাটকে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য সেসময় বিনোদিনীর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজি সংবাদপত্র তখন থেকে বিনোদিনীকে ‘ফ্লাওয়ার অফ দ্য নেটিভ স্টেজ’ বলে উল্লেখ করতে থাকে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *