- পবিত্র সরকার
পাঠকেরা জানেন বসন্ত একটা ঋতু, বছরে ছ’টা ঋতুর মধ্যে একটিমাত্র। তাও ভারতে বসন্ত অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, সব ঋতুর মতো অঙ্কের সমান সমান ভাগ ভাগ করে তাকে দু’মাসের মেয়াদ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এই দিশি বসন্ত খুব স্বল্পজীবী, তার আধখানা গ্রীষ্ম এসে গিলে খায়। আর বিদেশে বরফে ঢাকা শীতের পরে যে বসন্ত আসে, তার যে বিপুল সৌন্দর্য মহিমা, আমাদের বসন্তের সেই রাজকীয় আবির্ভাব নেই। আমাদের এতদঞ্চলে বরফ নেই, খুব বেশি গাছের পাতাও একবার ঝরে গিয়ে নতুন করে গজায় না (পুরোনো গাছে নতুন পাতা অবশ্যই গজায়), ক্রোকাস, টিউলিপ ইত্যাদি ফুলের বাগান নেই। তবু আমাদের বসন্তকে নিয়ে আদিখ্যেতার শেষ নেই।
তার কারণ, বসন্ত, সুন্দরতম ঋতু বলেই হয়তো প্রেমের ঋতু বলে এ দেশে কবিরা তারস্বরে চেঁচিয়ে গেছেন। তাকে বলা হয়েছে ঋতুরাজ বা ঋতুপতি। তাতে অজস্র ফুল ফোটে এবং ফুল ফোটানো হয়, মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের বাগানে বাগানে শীতের নানা মরশুমি ফুল, বিশেষ করে গোলাপ– বসন্তেও কিছুটা সঙ্গ দেয়। কিন্তু মানুষের বাগানে শুধু নয়, প্রকৃতি তার বাগানে বসন্তের কিছু মার্কামারা ফুল ফুটিয়ে থাকে। বসন্তের লক্ষণগুলি একে একে লিস্টি করা যায়—দক্ষিণের হাওয়া বইবে, গাছে নতুন পাতা আসবে, আম গাছে নতুন মুকুলমঞ্জরি জাগবে, পথেঘাটে অযত্নলালিত শিমুল গাছে বা পুরুলিয়া অঞ্চলে পলাশ গাছ আকাশকর লাল করে রাখবে, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া ফুটবে আর ঝরে পড়বে, সব ফুলের মধু খেতে আসা মৌমাছিদের গুঞ্জন সুনীল আকাশে খেলে বেড়াবে, বৌ-কথা কও-এর ডাকে দিনরাত্রি মুখরিত হবে, আর দু’মাসে গোটাদুয়েক পূর্ণিমা আসবে ‘বসন্তের মাতাল সমীরণে’ মাত করে দেবার জন্যে– ইত্যাদি ইত্যাদি, আর প্রেমিক-প্রেমিকার মন হু-হু করে উঠবে পরস্পরকে কাছে পাওয়ার জন্যে। এ বিষয়টা প্রায় সত্তর বছর আগে দেখা রাজ কাপুর-নার্গিস জুটির প্রথম ছবি ‘বরসাত’-এর একটা গানে, বোধ হয় শংকর জয়কিষেণের সুরে শামসাদ বেগমের গাওয়া, খুব পরিষ্কার করে বলা হয়েছিল— জিয়া বেকরার হ্যয়, ছাই বহার হ্যয়, আ জা মোরে বালমাঁ, তেরা ইন্তেজার হ্যয়।’ এটি বসন্ত সম্বন্ধে আমার জীবনের প্রথম ‘হট ফেভারিট’ গান বলা যায়।
আপনারা জানেন, বসন্ত প্রেমের ঋতুও বটে। কবি কালিদাস তাঁর ‘মেঘদূত’ কাব্যে অলকাপুরী বলে এমন এক দেশের কল্পনা করেছেন যেখানে চিরবসন্ত বিরাজ করে। চিরবসন্ত ব্যাপারটা খুব সুবিধের হবে কি না জানি না, তবে সেখানে নাকি যৌবন ছাড়া অন্য বয়সও নেই—তাই দুয়ের যোগফলে বা গুণফলে কিছু একটা ব্যাপার দাঁড়ায় হয়তো। কিন্তু তবু আমার মন খুঁতখুঁত করে— যে দেশে শিশুর কলরব নেই, সে কেমন আনন্দের দেশ। কালিদাস তাঁর ‘ঋতুসংহার’-এও (এটা খাঁটি কালিদাসের লেখা কি না তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে তর্ক আছে) প্রেমিক-প্রেমিকাদের ওপর বেশ খোলামেলাভাবেই নজর দিয়েছেন। অন্যদিকে জয়দেব বলুন, বৈষ্ণব পদাবলি বলুন, বসন্তের গানে গানে ছয়লাপ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের বা ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে গেলে এ লেখা আর শেষ হবে না। শুধু ইংরেজি সাহিত্যের এই পরিচিত কবিতর পংক্তিটি তুলি, কিটসের—If winter comes, can spring be far behind— যাতে বসন্তকে জীবনের একটা ইতিবাচক প্রত্যাশা হিসেবে দেখানো হয়েছে। আমরা সকলেই বসন্তের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। গ্রীষ্মের জন্য অন্তত এ দেশে আমরা হেদিয়ে মরি না। অন্যান্য নানা ঋতুকে চাই নানা কারণে। কিন্তু বসন্তের জন্যে আমাদের একটা স্পেশাল চাহিদা তৈরি হয়েছে, সব সংস্কৃতিতেই। রবীন্দ্রনাথ অবিশ্যি বর্ষার প্রতিই একটু বেশি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। ‘গীতবিতান’-এ প্রকৃতি পর্যায়ে তাঁর বর্ষার গান ১১৫টি। সেখানে বসন্তের গান ৯৬টি। অবশ্যই অন্যত্রও ঋতুগুলোকে ব্যবহার করেছেন তিনি, কখনও প্রেমের পটভূমিকা হিসেবে, কখনও অলংকার হিসেবে। যেমন ‘চিত্রাঙ্গদা’তে ‘রোদন ভরা এ বসন্ত’।
যাই হোক, প্রেমের ঋতু হওয়ার পাশাপাশি বসন্ত হয়তো সংক্ষিপ্ত ও ক্ষণস্থায়ী বলেই তাকে নিয়ে এত আদেখলেপনা আমাদের। হিন্দি ফিল্মের গানকে ছেড়ে বহুদূর চলে আসার পর আমার প্রিয় একটি রবীন্দ্রসংগীত হল, ‘চলে যায়, মরি হায়, বসন্তের দিন’। আর কোনও ঋতুর বিদায়ে কি আমরা এত হাপুস-হুপুস কাঁদি?
ফলে গান আর কবিতার শেয়ার বসন্তের জন্যে একটু বেশি। প্রথমত, তার নিজের সৌন্দর্য তো আছেই, তেমনই আছে মানুষের প্রেমের অনুষঙ্গ। তার ওপর রবীন্দ্রনাথ আবার তাকে মৃত্যুর বিপরীতে জীবনের পুনরুত্থান বা জয় হিসেবে দেখান তাঁর ‘ফাল্গুনী’, ‘বসন্ত’ বা ‘ঋতুরঙ্গশালায়’— ফলে আমরা এখন রবীন্দ্রনাথের গান দিয়েই আমাদের বসন্তের উদ্যাপন সারি। হ্যাঁ, আধুনিক বা চলচ্চিত্রের কিছু গান, যেমন বিমল রায়ের ‘মধুমতী’তে মুকেশের ‘সুহানা সফর, ইয়ে মৌসম হসী’, ‘বন্ধু’ ছবিতে নচিকেতা ঘোষের সুরে হেমন্তবাবুর সেই অবিস্মরণীয় ‘মৌ বনে আজ মৌ জমেছে, বউ কথা কও ডাকে, ‘পথে হল দেরী’ ছবির ‘এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার’, বা সেদিনকার আধুনিক ‘বসন্ত এসে গেছে’— এ সব গান আমাদের রবীন্দ্রসংগীত-সাম্রাজ্যের পাঁচিলের বাইরে স্মৃতিতে ঘোরাফেরা করে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান। আমাদের মতো অতিবৃদ্ধের— জীবনের বসন্তকাল যার দীর্ঘদিন অতীত হয়েছে— এই জীবনের অন্তিম শীতকাল আর কখনও কোনও বসন্তকে ফিরিয়ে দেবে না— সে রবীন্দ্রনাথের বসন্তের গানগুলোকে আঁকড়ে ধরেই স্মৃতিতে ডুব দেয়, হারানো বসন্তকে আবার আমন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। হাতের কাছে একটা ‘গীতবিতান’ রাখে সব সময়, আর ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ থেকে আরম্ভ করে ‘ঝরা পাতা গো আমি তোমারি দলে’ পর্যন্ত। আমাদের শেষ গান হয়তো হবে— ‘দিয়ে গেনু বসন্তের এই গানখানি; বরষ ফুরায়ে যাবে, ভুলে যাবে জানি।’