পেটে খিদে, ফোনে ভ্লগার

পেটে খিদে, ফোনে ভ্লগার

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


                                                                        শুভ সরকার

‘তিরিশ টাকায় তিনটে পরোটা, আনলিমিটেড তরকারি…’

‘ঝরে ঝরে পড়ছে…’

‘আড়াইশো গ্রাম খাসির মাংসের টুকরো…’

সো, হ্যালো গাইজ! উপরে যে কথাগুলো লেখা রয়েছে, সেগুলো পড়তে গিয়ে চেনা চেনা স্বর কানে বেজে উঠল কি না? এমনকি হ্যালো গাইজ বললেও তো এখন আমাদের মনে হয় এই বুঝি স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলেন কোনও ফুড ভ্লগার। সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় সাবস্ক্রা‌ইবার বাড়াতে এখন নিত্যনতুন টপিক চাই। আর সেই টপিক খোঁজার সঙ্গে ফুড রিভিউকে গুলিয়ে ফেলে বনেবাদাড়ে, ডেকার্স লেনে, শিয়ালদা স্টেশনে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন এইসব ফুড ভ্লগাররা।

আর তাঁদের কল্যাণেই আজ যে রাজা, কাল সে ফকির। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও কিছুই তো আর খুব একটা টেকসই নয়। কয়েক বছর আগে রাণু মণ্ডলের কথা মনে করে দেখুন। এক অসহায় মহিলা তখনকার সোশ্যাল মিডিয়া সেনসেশন। সর্বভারতীয় অনুষ্ঠানের মঞ্চে গান গাইছেন। হিমেশ রেশমিয়ার সঙ্গে গান গাইছেন। সেই রাণু মণ্ডল এখন কী করেন? কেউ খবর রাখেন? আসলে গরিবের হিরো হয়ে ওঠার গল্পটা মানুষ বরাবরই ভালো ‘খায়’। সেই আটের দশকে অ্যাংরি ইয়াংম্যান যখন ফেলে দেওয়া পয়সা কুড়িয়ে নিতেন না, তখনও তো সিনেমা হলে হাততালিতে পায়রা উড়ে যেত। কাট টু ২০২৪-’২৫। রাত জেগে বাড়িতে পরোটা বানিয়ে ভোর ৬টা থেকে শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে পসরা সাজিয়ে বসা রাজুদার স্ট্রাগলের কাহিনী এখন লোকে ভালো ‘খায়’। আর বাড়তি সুবিধা হল রাজুদার যে ‘প্রোডাক্ট’, সেটা আক্ষরিক অর্থেই লোকজন খায়। আর ঠিক এই জায়গাটা ছুঁয়ে ফেলেছে বলেই ফুড ভ্লগারদের এত রমরমা। রাজুদার স্ট্রাগল বিক্রি করে যে জন প্রথম ভ্লগটা বানিয়েছিলেন, তাঁকে কুর্নিশ। তাঁর সুবাদেই তো পরোটার জগতে এখন রাজুদা একটা ব্র্যান্ড নেম।

ঠিক যেমন তার কয়েক মাস আগে পরোটা মুলুকে ব্র্যান্ড নেম ছিলেন ডিজে অরুণ আর ফোন পে পরোটা। রাজুদা-সমুদ্রে এখন তিনি ভেসে থাকবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এদিক-ওদিক মুখ দেখিয়ে। এভাবেই কখনও ফুটেজ পেয়ে যান পাইস হোটেল চালানো স্মার্টদিদি। কখনও ভাইরাল হয়ে যায় দুই বোনের বিরিয়ানি। খাবারের স্বাদ নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলোয়ার গোনা নিয়ে গুঁতোগুঁতি লাগে আমেরিকান দাদার বিরিয়ানি আর বাচ্চার বিরিয়ানির মধ্যে। আর এই ভাইরাল হওয়ার চক্করে ফুড ভ্লগারদের সামনে কেউ বানাচ্ছেন কোল্ড ড্রিংকস দিয়ে ম্যাগি। কেউ চায়ের পাত্রে উঁচু করে দুধ ঢালতে ঢালতে সাপের মতো জিভ লকলক করছেন। ব্যাস, ভিডিও হিট।

আর ফুড ভ্লগিংয়ের এতসব হইচই, ভিউজ, কমেন্ট, লাইক, শেয়ারের মধ্যে চাপা পড়ে যায় সামান্য একটা বিষয়, খাবারটা খেতে কতটা ভালো, বা আদৌ ভালো কি না।

এত অবধি পড়ে যদি কেউ ভেবে থাকেন, ফুড ভ্লগিং একটা অতি বিচ্ছিরি ব্যাপার, ভুল ভাবছেন। আচ্ছা বলুন তো, এই যে সেদিন দেখলাম, রাজুদার পরোটা খাওয়ার জন্য শীতের ভোরেও লাইন পড়ছে, এটা কি তিনি ভাইরাল না হলে হত? রাজুদার পরোটা বিক্রির বিপুল বাড়বৃদ্ধি তো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভর দিয়েই। আর রাজুদা কোনও ব্যতিক্রম তো নয়। সেই যে ফুটপাথে পাইস হোটেল চালানো স্মার্টদিদি, এখন তাঁর নিজের রেস্তোরাঁ হয়েছে। রিয়েলিটি শো-তে ডাক পেয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে এসব হত? আচ্ছা, আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। বছর দুয়েক আগে শিলিগুড়িতে হইচই পড়ে যায় মাছের মোমো নিয়ে। তখন এই শহরের বাঘা যতীন পার্কের কাছে এক মহিলা বসতে শুরু করেছেন সেই মোমো নিয়ে। স্থানীয় ফুড ভ্লগারদের সৌজন্যে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে, ব্যবসাও। খেতে গেলে অপেক্ষা করতে হত রীতিমতো। আবার এই তো, গত সপ্তাহে ইনস্টাগ্রামে পরপর রিলস দেখে জানলাম, অস্থায়ী ঠ্যালায় বিক্রি হচ্ছে গরমাগরম ছোলে-কুলচা। শিলিগুড়ি শহরে নাকি এই প্রথম। স্বাদ পরখ করব ভেবে দোকানের সামনে গিয়ে দেখি সাংঘাতিক ভিড়। না খাবারের গুণমানে লোক টানছে ভাবলে ভুল করবেন, কারণ দোকানটা খুলেছেই সপ্তাহ পেরিয়েছে কি পেরোয়নি। লোক টেনেছে ভ্লগে।

মার্কেটিং তো অনেক বড় শব্দ, এইসব ছোট ছোট ব্যবসায়ীর পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় বিজ্ঞাপনের জন্য আলাদা করে বিশাল কিছু খরচ করা। তাঁদের সেই সুবিধাটা পাইয়ে দিচ্ছেন ফুড ভ্লগাররা। তার বদলে তাঁরা যদি বিনা পয়সায় দোকান থেকে কিছু খেয়ে থাকেন, যে অভিযোগটা নাকি প্রায়ই ওঠে তাঁদের বিরুদ্ধে, তাতে আমি অন্তত খারাপ কিছু দেখি না।

ফুড ভ্লগিংয়ে যা যা বলা হয় সব সত্যি? খাবারগুলো সত্যি সত্যি অতটাই ‘ওসাম’? না। কিন্তু টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখার সময়ও তো আমরা প্রশ্ন তুলি না যে, অমুক সাবানে ৯৯.৯ শতাংশ জীবাণু সত্যি সত্যি মারে কি না। তাহলে?

শিবরাম চক্রবর্তীর দেবতার জন্ম বলে একটা গল্প রয়েছে। রাস্তার একপাশে পড়ে থাকা একটা সাধারণ পাথর কীভাবে লোকের মুখে মুখে একটা সময় দেবতা হয়ে ওঠে, তা নিয়ে। ফুড ভ্লগাররাও সেটাই করছেন। দেবতা তৈরি করছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেসব ভ্লগে ভিউ বাড়লে তাঁদেরও তো আর্থিক লাভ হয়। তবে দেবতা থাকলে তার বিসর্জনও থাকবে। মানুষ সৎভাবে খেটেখুটে ব্যবসা করলে, তার বিসর্জন হওয়াটা কিন্তু বাঞ্ছনীয় নয়। শিলিগুড়ির সেই মাছের মোমো বিক্রেতা মহিলা এখন কোথায় বসেন, সেই শহরের কেউ জানেন কি?



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *