সেই পুলিশকর্মীটির কথা একবার ভাবুন। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে, উপরওয়ালাদের গালমন্দ সয়ে সবে ঘরে ফিরেছেন। ফিরেই টিভিতে যখন দেখছেন নেতা, তার চামচা, তস্য চামচা একেবারে তাঁর মা-মাসি তুলে কাঁচা খিস্তি দিচ্ছেন, তখন নিজের অজান্তেই তাঁর মাথাটা নেমে আসে। আত্মগ্লানিতে ভালো করে তাকাতে পারেন না সন্তানের দিকে।
একবার ভাবুন, পরের দিন ডিউটির জন্য বেরিয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের কৌতুকের লক্ষ্য হচ্ছেন তিনি। কোনও শুভাকাঙ্ক্ষী এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলবে, আর কেন, চাকরিটা ছেড়ে দিন এবার মানসম্মান থাকতে থাকতে। পুলিশের যে ইমেজ তৈরি হয়েছে বছরের পর বছর তাতে পুলিশ যে এখন বিদ্রুপের খোরাক তাতে সন্দেহ নেই। কোলের বাচ্চাও জানে পুলিশের হাতে কিছু নোট গুঁজে দিলে কিংবা বড় কোনও নেতাকে দিয়ে ফোন করালে সাত খুন মাফ হয়ে যায়। উলটে স্যালুট ঠুকে পুলিশই গারদের গেট খুলে দেয়। সাধারণ মানুষের ধারণা এটাই। সেখানে মাথা উঁচু করে কাজ করবেন কী করে ভাবতে ভাবতে রিটায়ারমেন্টের দিন গোনেন সেই পুলিশকর্মীটি।
তাঁকে কেউ বিশ্বাস করে না। আত্মীয়স্বজন, মায় নিজের গিন্নিও। সবাই জানে তাঁর যা মাইনে তার থেকে তাঁর উপরির পরিমাণ অনেক বেশি। তিনি ঘুষ খান না একথা কেউ ভাবতেই পারেন না। আর তারই সঙ্গে পুলিশ অত্যাচারী, পুলিশ নারী নির্যাতনকারী, পুলিশ উপরওয়ালার নির্দেশে রাতকে দিন করতে পারে এমন কত বিশেষণ তার গায়ে লেপটে রয়েছে সেই কবে থেকে। বলতে গেলে বহুদিন ধরে এসব ধারণা তৈরি অর্জন করেছে খাকি উর্দির বাহিনী। নিজেদের রোজকার যাপন দিয়ে এমন একটা ধারণা তৈরি করেছে ছাপোষা সাধারণ মানুষও। তাঁরা জানেন, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। তাদের যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেন পাঁচ পাবলিক।
পুলিশের ‘দলদাস’ তকমাটা অবশ্য এই আমলের নয়। কথাটা চালু হয়েছিল বাম আমলেই। পরিবর্তনের সরকার আসার পর অনেক কিছু বদলালেও, লাল থেকে নীল সাদা হলেও পুলিশ সেই দলদাসই থেকে গিয়েছে। থানা এলাকায় কোনও অঘটন ঘটলে বড়বাবুকে অপেক্ষা করতে হয়, এলাকার নেতারা কী নির্দেশ দেবেন তার জন্য। আগে ছিল লোকাল কমিটির কমরেডদের দাপট, এ আমলে ছোটবড় নানা সাইজের দাদাদের আদেশের জন্য। এই যেমন ধরুন না, বোলপুর থানার আইসি লিটন হালদারকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করার পরেও বীরভূমের বাঘের গায়ে আঁচড় দেওয়ার ক্ষমতা হল না পুলিশের। তিনি হুমকি দিয়েছেন, থানার মধ্যে ঢুকে টেনে বের করে নিয়ে আসবেন আইসিকে। তাঁরও এককাঠি সরেস শাসক দলের ছাত্রনেতা। রীতিমতো তুইতোকারি করে তিনি শাসিয়েছেন আইসিকে, ছিলি তো সিআইডিতে গ্যারাজ হয়ে। দল, সরকার দয়া করে এই জায়গায় এনেছে। তাঁর খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ, পারলে টিএমসিপির কারও বিরুদ্ধে এফআইআর করে দেখাক। সেই দম আছে?
সেই আধপোয়া নেতাকে দল সাসপেন্ড করেছে বটে, কিন্তু তাঁর মুখনিঃসৃত কথাগুলো পুলিশের গায়ে চাবুকের মতো এসে লাগবে না? এমন নেতাই তো সব দলের সম্পদ। বাম আমলের তপন-সুকুর থেকে এই আমলের কেষ্ট। সবাই দলের সম্পদ। তাই পুলিশকে বোমা মারব থেকে শুরু করে ঘাড় ধরে সবাইকে মারব বলে পুলিশকর্তাকে প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়ার পরেও তাঁর কিছু হয় না। বরং উলটে পুলিশই ভয়ে ভয়ে থাকে, এই বুঝি চাকরি গেল, এই বুঝি সুন্দরবনে বদলির অর্ডার আসে। এই বুঝি ঠেলে দেওয়া হয় কম্পালসরি ওয়েটিংয়ে। তাই থানা জ্বালিয়ে দেওয়া হলেও প্রাণ বাঁচাতে পুলিশকে নিজেদের মাথা বাঁচানোর জন্য ছোটাছুটি করতে হয়। হামলাকারীরা কোন দলের কোন নেতার চ্যালা আগে তা বুঝে সেইমতো ব্যবস্থা। নিজে থেকে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে সচরাচর এমনটা দেখা যায় না।
তাই দর কমেছে পুলিশের। বড় ক্রিমিনালদের বাদ দিন, পাড়ার ছেঁদো মস্তানরাও থানাকে পাত্তা দেয় না। পুলিশই বরং নেতাদের পিছনে পিছনে ঘোরে এমনটাই দেখা যায়। ফলে পুলিশকে কে আর কোনও গুরুত্ব দেবে! পুলিশের থেকে নেতা ধরলে তাদের কাজ হয়ে যায় মাখনের মতো মসৃণভাবে। অনেক আগে পুলিশের এক কর্তা বড় দুঃখে বলেছিলেন, পুলিশ হল হিজ মাস্টার্স ডগ। যখন যে তার মালিক তখন সে তার। আজ যে অবস্থা তাতে তাই কেউই অবাক হয় না। আর এই অবস্থা নিজেরাই তৈরি করেছে পুলিশ। নিজেরা আকণ্ঠ দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকলে অন্যের দুর্নীতি তারা দেখতে যাবে কেন। বরং মুখ বুজে কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম করলে তাদের লাভ।
এমনটা নয় যে এসব নবান্ন জানে না। খোদ মুখ্যমন্ত্রী নিজে ভরা সভায় বলেছেন, পুলিশের কেউ কেউ ঘুষ নিচ্ছে। আলু থেকে বালি, কয়লা, সিমেন্ট পাচার করছে। এতে রাজ্যের বদনাম হচ্ছে। পুলিশের নীচুতলার দুর্নীতির দায় সরকারকে বা দলকে নিতে হচ্ছে। এরপরই পুলিশে বেশ কিছু রদবদল করেছিলেন মমতা, ঘটনাচক্রে তিনিই পুলিশের মন্ত্রী। তাই যে কোনও ঘটনার জন্য বিরোধীরা সরাসরি দায়ী করে তাঁকেই। রদবদলের কতটা বদল হল কে জানে! তবে তারই সঙ্গে তাঁর দলের নেতাদের সামলানোর কাজটা সমান জরুরি। তাতে দলের বদনাম হচ্ছে বহুগুণ বেশি।