- হিমাংশু রায়
– শাক নিবেন শাক, পুঁই শাক, পুঁই শাক
একটা বুড়ি হেঁটে যাচ্ছে সকালবেলা। ব্রাশ করতে করতে প্রদীপ হাঁটতে বেরিয়েছে। গায়ে একটা লাল রঙের সোয়েটার আর কোমরে লাল আর সবুজ রঙের একটা গামছা জড়ানো। সকালবেলার এই সময়টাই শুধু সুখী মনে হয় প্রদীপের। সূর্য ধীরে ধীরে লাল রঙের লেপ সরিয়ে নিচ্ছে। পাখিরা কুজন করছে। শুকনো পাতাগুলো শিশিরের জলে স্নান করে নিচ্ছে সকাল সকাল। কুয়াশার আবছা ভাবটা আছে এখনও। এর পরেই আলো আসবে, আলো এলে ধুলো আসবে, ধুলো এলে বিশ্রী শব্দগুলোর মেলা হবে। মানুষ তখন সময়ের চেয়েও বেশি দৌড়াবে। প্রদীপের এসব দৌড়াদৌড়ি ভালো লাগে না। মানুষ একটা জীবনে যত দৌড়ঝাঁপ করে, সেগুলো গুনে রেখে সরলরেখায় রাখলে হয়তো পৃথিবী পেরিয়ে যেত।
তবে পৃথিবীর মায়া বড় মায়া। যার কেউ নেই তার হয়তো একটা ফুল গাছ আছে, যাকে সে যত্নে আগলে রাখে। ফুল ফুটলে এক চিলতে রোদ কেটে যায় তাদের দেখে। যার জন্য অপেক্ষা করার মানুষ নেই তার জন্য হয়তো একটা বিড়াল বা কুকুর অপেক্ষা করে থাকে। শীতের সকালে যখন মানুষ চেনা যায় না, তখনও কুকুর বা বেড়ালটা ঠিক পায়ের কাছে এসে গুটিশুটি মেরে পড়ে থাকে, লেজ নাচায়। এসব মায়াই মানুষকে প্ররোচিত করে হাসতে, ভালোবাসতে, বেঁচে থাকতে।
প্রদীপও এমন। তিনকুলে কেউ নেই।
সামনে দিয়ে সকালবেলা বুড়িটাকে এই কনকনে ঠান্ডার মধ্য দিয়ে পুঁই শাক নিয়ে যেতে দেখে কষ্ট হল প্রদীপের। বলল
-বুড়িমা, পুঁই শাক কত করি?
-পাঁচ টাকা আঁটি
-নিবু
-হ্যাঁ। বাড়িত শাক নাই, গোটায়লায় দেও।
বুড়িমা খুশি হয়ে গেল। বলল
-তোক তো আগোত দেখং নাই বাপই। নয়া আসিছিস নাকি?
-হ্যাঁ। তিন মাস হইল। এটে বন্ধন ব্যাংকোত চাকরি করং।
-আচ্ছা ভাল ভাল।
২
এখন প্রায়ই প্রদীপের বাড়ির সামনে দিয়ে বুড়িমা যায়। কিছু বেচতে নিয়ে গেলে বাইরে থেকে বলে
– বাপই শাক আছে নিবু নাকি?
প্রদীপ কোনওদিন নেয়, কোনওদিন নেয় না। কিন্তু প্রদীপ লক্ষ করে প্রতিদিন অন্তত একবার হাঁক দেয়।
প্রদীপের মাঝেমধ্যে রাগ হয় এই দশ-পনেরো হাজারের চাকরির ওপর। তারপর যেদিন থেকে বুড়িমাকে বলেছে যে, ব্যাংকে কাজ করে, সেই থেকে মনে হয়, বুড়িমা ভেবেছে প্রদীপের অনেক টাকা। তাই প্রতিদিন আসে। অথবা এমনও হতে পারে যে জোয়ান ছেলে, চাকরি করে। ওইজন্য দেখে রাখছে কিছুদিন পর সম্বন্ধ নিয়ে আসতে পারে। কিছুদিন আগে প্রদীপের এক বন্ধু চাকরি পাওয়ার কিছুদিন পরপরই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল এভাবেই।
প্রদীপের এখনই বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। ছোটবেলা থেকে ভেবেছে, টাকা হলে পুরো পশ্চিমবঙ্গ ঘুরবে। দার্জিলিং, কালিম্পং, গৌড়, কোচবিহার, গোসানিমারি, দিঘা আরও কত জায়গার নাম লিখে রেখেছে ডায়েরিতে। প্রতিরাতে ডায়েরিটা খুলে দ্যাখে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এবারও কোথাও যাওয়া হল না। আসলে প্রদীপের চাকরিটাই এমন, ছুটি থাকেই না বলতে গেলে। তারপর চাকরিতে টাকাও খুব বেশি নেই। যদি কিছু টাকা জমিয়েও রাখে, কোনও এক মাসে খরচ হয়ে যায়। হাতে টাকা থাকেই না বলতে গেলে। তাই ডায়েরিটায় হাত বুলিয়েই প্রদীপের রাত কেটে যায়।
এখন মাঝেমধ্যেই এমন হয় যে, প্রদীপ বাড়িতে নেই, অথচ বুড়িমা আঙিনায় শাক রেখে যায়। এ নিয়ে প্রদীপ বকাও দিয়েছিল একদিন। কিন্তু বুড়িমার সামনে গেলে কেন জানি রূঢ়কথা বলতেই পারে না প্রদীপ, থমকে যায়। বুড়িমার বয়স হয়েছে, কপালে চারটা বয়সের কুঁচকানো দাগ, বড় কপাল আধপাকা চুল আর চোখদুটো একটু বেশিই ভিতরে যেন। নাকে একটা ছোট সোনার ফুল। হাসলে সুপারি পান খাওয়া লাল দাঁত দেখা যায়। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে।
প্রদীপও তাই কিছু বলে না। মাঝেমধ্যে দেখা হলে টাকা দেয়, সুপারি পান দেয়। গল্প করে। সেদিন ব্যাংক থেকে আসতে রাত্রি হয়ে গিয়েছিল, ঠান্ডা লেগে জ্বর ধরিয়েছিল। এমনিতে প্রদীপের রোগভোগ কম কিন্তু এবার যে কী হল কে জানে। মাথা ওঠাতেই পারছে না। দুই-তিনদিন এভাবেই পড়ে রইল। কোনওরকমে সেদ্ধভাত করে খেল। চারদিনের দিন আর সহ্য হল না। মাথা ঘুরে পড়ে গেল আঙিনায়।
বুড়িমা সেদিন শাক দিতে গিয়ে দ্যাখে, প্রদীপ মাটিতে পড়ে আছে।
বলল
-বাপই কি হইছে, জ্বর ধরাছিস?
অস্ফুট কণ্ঠে প্রদীপ বলল
-হুম
তারপর আর কিছু মনে নেই প্রদীপের। যখন চোখ মেলল, দেখতে পেল, মাথার কাছে বুড়িমা দাঁড়িয়ে জলপট্টি দিচ্ছে। হাঁড়িতে ভাত রান্না করা হয়েছে। বুড়িমা বলল,
-গরম গরম মারুয়া ভাত আন্ধিছুং, খা। জ্বর পালে যাবে।
জ্বরটা একটু কমেছে বোধহয়, খিদেও পেয়েছে। প্রদীপ না করল না। সন্ধ্যার দিকে যখন প্রদীপ একটু সুস্থ বোধ করল, বুড়িমা ফিরে গেল তার ঘরে।
পরের দিন সকাল সকাল বুড়িমা এসে হাজির বলে
– বাপই কেমন আছিস এলা?
– ভালে আছং। কালি তোমা না থাঁকিলে মোর কি যে হইল হয়।
– জ্বর কমিছে?
– হ্যাঁ
– এত বড় একান আঙিনা শাকপাতি নাগের পাইস তো তাহৈলে আর বাজার করির যাবার নাগে না। কালি সুদায় সুদায় ভাতগিলা খালু নুন ত্যাল দিয়া। পাশুন আছে?
– হ্যাঁ
– দে তো পুঁই শাকের বিচি গাড়ি দিয়া যাং। হেইল্যা আরো কেনে করির নাগে, মুই করি নিম।
– করিলে এতদিনে করিলুকে হয়। দে মোক আনি।
বুড়িমা আঙিনায় মাটি খুঁড়ে পুঁই শাকের বীজ বপন করে দিয়ে গেল।
৩
পাঁচ-সাতদিন ধরে বুড়িমা আর এদিকে আসে না। প্রদীপের কেমন জানি লাগছে। বুড়িমা এলে একটু গল্প করা যেত। প্রমোশন হয়েছে আজকে। বুড়িমাকে কিছু কিনে দিতে পারলে ভালো লাগত।
অভ্যাস জিনিসটা আঠার মতো, যতক্ষণ আলগাভাবে লেগে থাকলে হাত সরিয়ে নেওয়া সহজ, একবার ভালোমতো সেঁটে গেলে হাতের চামড়া উঠে যায়, রক্তক্ষরণও হতে পারে।
দশদিনের দিন প্রদীপ আর অপেক্ষা করতে পারল না। যেদিক দিয়ে বুড়িমা আসত, সেদিক দিয়ে খোঁজ নিতে নিতে এগিয়ে যাচ্ছিল।
বাড়ির সামনে এসে শুনল, বুড়িমা আর নেই। আজকেই মারা গিয়েছে। কয়েকদিন ধরেই অসুখে ভুগছিল। শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এতক্ষণে হয়তো দাহ করা হয়ে গিয়েছে। প্রদীপ পড়িমরি করে ছুটল শ্মশানে। গিয়ে দ্যাখে, সবাই চলে গিয়েছে। শুধু চিতাটা জ্বলছে অল্প অল্প করে। প্রদীপের চোখ দিয়ে জল, সামনে চারটা বা চিতার চারটা বাঁশ, মাঝে সাদা কাপড়টা পতপত করে উড়ছে। আশপাশে চিতায় দেওয়ার মতো একটা কাঠ বা আম্রপল্লবও নেই। শ্মশানের পাশে একটা পুঁই শাকের গাছ দেখতে পেল বেগুনি রঙের পাতা। বুড়িমার সঙ্গে প্রথম দেখা পু্ঁই শাক কেনার জন্য। প্রদীপের মনে হল, পুঁই শাকের পাতাই দিই একটা। কিন্তু চিতায় পু্ঁই শাক কি দেওয়া যায়? চিতায় পু্ঁই শাকের ডালটা দিতেই ধপ করে একটু আগুন দেখা গেল। প্রদীপের মনে হল, কেউ বলছে
-বাউ আসছিস?
পরের দিন সকালবেলা, আঙিনার কোণে বুড়িমার রোপণ করে যাওয়া পুঁই শাকের একটা চারা দেখতে পেল প্রদীপ। সবে জন্মাল বোধহয়।
আমাদের সম্পর্কগুলো পুঁই শাকের মতো পিচ্ছিল, হড়কে যেতে চায়। ধরে রাখতে পারি না। পাটকাঠির মতো নরম দেওয়াল আমাদের ছাদে ছড়িয়ে দেয় পুঁই শাক, তারা একদিন আমাদের ভাতের সঙ্গী হয়। আলতুফালতু কচুঘেঁচুর সঙ্গেও মানিয়ে নিই তাদের। তারপর একদিন শেষ হয়ে আসে পুঁই, যাকে আপন করে থুই। একদিন সব শেষ হয়ে যায়। পুঁই নামক শোক জন্মায়।