সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: মহাঅষ্টমীর সন্ধ্যায় গমগম করছে না কাশিপুর রাজবাড়ি। উলটে গড়পঞ্চকোট প্যালেস জুড়ে শুধুই আঁধার। লোহার বড় ফটক ভেতর থেকে তালাবন্ধ। মা যে এবার পা-ই রাখেননি এই রাজবাড়ির অন্দরমহলে।
আজ থেকে ৫৩ বছর আগেও একবার পুজো হয়নি। এবারও তাই। অথচ ৩৬৫ দিনের মধ্যে শুধুমাত্র পুজোর এই চারটে দিন কাশিপুর রাজবাড়ির মূল দরজা খোলা থাকত। বিশেষ অনুমতি ছাড়া ৩৬১ দিন ওই রাজবাড়িতে প্রবেশ করা যায় না। তাই ভিড় উপচে পড়ে পুজোর সময়, মহাসপ্তমী থেকে মহাদশমী। কিন্তু সেই ১৯৭২ সালের মতো এবার কেন মা এলেন না? এই রাজবাড়ি বর্তমানে যাঁর তত্ত্বাবধানে অর্থাৎ পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজকন্যা মহেশ্বরী দেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র অনসূল রাজাওয়াত-র স্ত্রী বীরাঙ্গনা রাজাওয়াত দেউড়া পঞ্চকোট রাজপরিবারের ভাগ্নে বধূ মাত্র ৪৮ বছর বয়সে অকালে মারা যান। প্রায় আড়াই বছর ধরে তিনি ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। তাঁর প্রয়াণের কারণেই মা এবার রাজবাড়িতে পা রাখেননি।

ইতিহাস বলছে, পঞ্চকোট রাজপরিবারের শেষ রাজা ভুবনেশ্বরী প্রসাদ সিংহ দেও-র মৃত্যুতে ১৯৭২ সালে একইভাবে এই রাজবাড়িতে দুর্গাপুজো বন্ধ ছিল। রাজকন্যা মহেশ্বরী দেবীর কথায়, “প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যেই এই খারাপ খবরটা আসে। অশৌচের কারণে পুজো হচ্ছে না।” রাজ পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ন’টার সময় দুর্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজপরিবারের ওই ভাগ্নে বধূ মারা যান। তারপর থেকেই শোক গ্রাস করেছে এই রাজবাড়িকে। ১০০ বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত এই রাজবাড়িতে মহাঅষ্টমীর সন্ধ্যায় রয়েছে শূন্যতা। অথচ ফি বছর শুধু এই জেলার মানুষজন বা দর্শনার্থীরা নন, দূরদূরান্ত থেকে বহু পর্যটক পুজোর সময় এই রাজবাড়িতে পা রাখেন। যদিও অন্দরমহলে ঢোকার অনুমতি কোনওদিনই ছিল না। কিন্তু রাজবাড়ি চত্বরে ঘুরে বেড়ান তাঁরা। দু’চোখ ভরে সাবেকি প্রতিমাকে দেখেন।

ওই বধূর অকাল প্রয়াণে ইটালিয়ান মার্বেলের ঝাঁ চকচকে মেঝে, বেলজিয়ামের বিশাল ঝাড়লন্ঠন, ইটালির নজরকাড়া আসবাবপত্র, বেলজিয়ামের পেইন্টিং করা কাঁচ, নানান পাথরের মূর্তি, রাজরাজাদের শিকার করা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, লেপার্ড, বাইসন, চিতল হরিণ, সম্বর হরিণগুলো সাজানো থাকলেও মা না আসায় অন্দরমহল জুড়ে শুধুই বিষাদ। যেখানে সাবেকিয়ানা প্রতিমায় পুজো হতো। সেখানে শুধুমাত্র একটা আলো জ্বলছে। এই গড়পঞ্চকোট প্যালেস এখন পুরুলিয়ার অন্যতম হেরিটেজ। পঞ্চকোট রাজপরিবারের শেষ রাজধানী ছিল কাশিপুর। এখন অবশ্য সেই রাজা, রাজতন্ত্র নেই। এই স্টেট ২,৭৭৯ বর্গমাইল বিস্তৃত। যার মধ্যে রয়েছে সাবেক মানভূম, রাঁচি, বাঁকুড়া, ওড়িশা, কলকাতা এবং বেনারসে মূল্যবান খনি। এই প্যালেস মহারাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিং দেও তাঁর ১২ বছরের শাসনকালে ৩০ লাখ টাকা খরচ করে নির্মাণ করেন। চিন থেকে রাজমিস্ত্রি এনে ১২ বছর ধরে ওই রাজার আমলে তৈরি করা এই প্রাসাদ জ্যোতি বিলাস বা প্যালেস নামে পরিচিত। ১৯১৬ সালে এই প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল।