অনুপ সাহা, ওদলাবাড়ি: ২০০৩-’০৪ সালের ঘটনা। তখন কত আর বয়স মেয়েটার, বছর সাতেক। শামুকতলার কার্তিকা চৌপথি থেকে মা-বাবাকে ছেড়ে কীভাবে যে সিকিমে পৌঁছোল তা সে মনে করতেও পারে না। ভাসা ভাসা মনে আছে, কয়েক বছর পর সিকিম থেকেই তাকে একটা লোক নিয়ে গেল অনেক দূরে একটা জায়গায়। বেশ কয়েকমাস পরে সে জেনেছিল নতুন জায়গাটার নাম বেঙ্গালুরু। মেয়েটার নাম? ধরে নিন উমা।
বেঙ্গালুরুতে এসে মেয়েটা বছর দশেক বয়সেই বুঝে গেল, পাচার শব্দটার মানে কী? দিল্লি থেকে ফোনে উমা শোনাচ্ছিল সেই গল্প। বেঙ্গালুরুর যে বাড়িতে তাকে কাজে লাগানো হয়েছিল সেখানে পান থেকে চুন খসলে খাওয়া বন্ধ, অমানুষিক মারধর, কথায় কথায় গালিগালাজ। একবার বাড়ি ফেরার জন্য জেদ করায় মারধরের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায়। তার আর্ত চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। উমাকে উদ্ধার করেন তাঁরাই। ঠাঁই হয় আরেক পরিবারে। সেখানে নির্যাতন ছিল না, কিন্তু বাড়ি ফেরার পথও ছিল না মেয়েটার।
এভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কেটে যায়। হঠাৎ একদিন একটা ফোন আসে তার কাছে। ডুয়ার্স থেকে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধি রাজু নেপালি কথা বলেন উমার সঙ্গে। মূলত তাঁরই চেষ্টায় আবার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ হয় উমার। ততদিনে কৈশোর পেরিয়ে মেয়েটা তরুণী। ২০১৮ সালে বাড়ি ফিরে উমা প্রথমে তো চিনতেই পারেনি বাবা-মা-বোনেদের।
পরবর্তী সময়ে কর্মসূত্রে একে একে দিল্লির বসন্তকুঞ্জ, গাজিয়াবাদ, নয়ডা ঘুরে বর্তমানে গুরুগ্রামের বাসিন্দা উমা। নিজে পাচার হওয়ায় সে বোঝে, পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের যন্ত্রণা কতটা। বছর ৩০-এর দোরগোড়ায় পৌঁছে পাচারকারীদের লোভী চোখ দুটো চিনে নিতে একটুও ভুলচুক হয় না তার।
তাই গত দু’বছর ধরে গুরুগ্রামের একটি পরিবারে ‘বেবি কেয়ার’-এ কাজ করার ফাঁকে অবসরকালীন সময়ে ডুয়ার্সের বন্ধ, রুগ্ন চা বাগান থেকে পাচার হয়ে যাওয়া একাধিক কিশোরী, তরুণীকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে গোপনে কাজ করে চলেছে উমা। গুরুগ্রাম ও দিল্লিতে ছড়িয়ে থাকা তার নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই চারজন তরুণীকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে সে। তার এই মিশনে সবসময় পাশে পেয়েছে একসময় তাকে উদ্ধার করে আনা ডুয়ার্সের নারী ও শিশু পাচার বিরোধী সংগঠন ‘ডুয়ার্স এক্সপ্রেস মেল’-কে।
উত্তর ভারতে, বিশেষ করে দিল্লি-নয়ডা-গাজিয়াবাদ এলাকায় নিজস্ব নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে উমা। ডুয়ার্সের কোনও মেয়েকে পাচার করা হয়েছে বলে খবর পেলেই গোপনে কাজ শুরু করে দেয় তার টিম। মেয়েটি কোথায়, কার বাড়িতে আছে সব খোঁজ নেওয়ার পর নিকটবর্তী থানায় যোগাযোগ করা হয়। তার আগে অবশ্য মেয়েটি ডুয়ার্সের যে এলাকার বাসিন্দা সেখানকার থানাতেও পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ দায়ের করানো হয়। প্রয়োজনে ডুয়ার্সের সংশ্লিষ্ট থানার অফিসাররা চলে যান উত্তর ভারতে। সেখানকার পুলিশের সাহায্যে উদ্ধার করা হয় পাচার হওয়া মেয়েটিকে। সম্প্রতি এভাবেই ডুয়ার্সের নাগরাকাটা থানার এক তরুণীকে উদ্ধার করে আনা হয়। মাল থানা এলাকার একটি বন্ধ চা বাগানের মেয়েকেও উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে। পুরো অপারেশন হয় একেবারে নিখুঁত গোপন বোঝাপড়ার মাধ্যমে। কোথাও একটু এদিক-ওদিক হলেই যে পাচারচক্রের চাঁইরা দাঁত-নখ বের করবে, তা ভালোভাবেই জানে উমা।
তারপরও ঝুঁকি নিয়ে এ কাজ করার পর অনেকটা মানসিক শান্তি পায় সে। তিন বোনের মধ্যে উমা মেজো। বড় দিদি বিয়ের পর দিল্লিতে সংসারী। ছোট বোন থাকে মিরাটে। বাবা-মা দুজনেই প্রয়াত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর হল। শামুকতলার বাড়িতে আসতে ইচ্ছে করে না?- প্রশ্ন শুনে খানিকটা গলা ধরে আসে উমার। বলে, ২০১৮ সালে কয়েকমাসের জন্য বাড়িতেই কাটিয়েছিলাম। তারপর কাজের সূত্রে দিল্লি চলে আসি। এখন আমার একটাই মিশন- কীভাবে ডুয়ার্স থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অবুঝ মেয়েগুলোকে ঘরে ফিরিয়ে দেব। পুজোর সময় তাই বাড়ি আসে না উমা। সারাবছর মেয়েদের ঘরে ফেরানোর দায়িত্ব যে তার উপর।