পাকিস্তানের স্বর্ণভূমিই মৃত্যু-বিপ্লবের অন্য নাম

পাকিস্তানের স্বর্ণভূমিই মৃত্যু-বিপ্লবের অন্য নাম

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


রূপায়ণ ভট্টাচার্য

একটার পর একটা নোংরা মর্গ ঘুরে সেই বালোচ কিশোরীর শুরু হত সকাল। প্রতিদিন। সামনের রুক্ষ প্রকৃতি, পাথরের মাঝে জেগে ওঠা ফুল–মাথায় থাকত না কিছু। বীভৎস মুখচোখ, ক্ষতচিহ্ন দেখে বোঝার উপায় ছিল না, ওটা কার মুখ। দেখতে দেখতে মর্গের ওই শবদেহের গন্ধ, ভিতরের গুমরে ওঠা কান্না, হারানো স্বজনের জন্য প্রার্থনার উচ্চারণ, সামান্য আলো –সব তাঁর সঙ্গী হয়ে গেল।

সাত বছর চলেছে এভাবে। সেদিনের সেই কিশোরী, সায়রা বালোচ আজ তরুণী। সে যাকে খুঁজছিল, আজও পায়নি তাকে। তাঁর হারিয়ে যাওয়া দাদা।

মাস দুয়েক আগে বিবিসির উর্দু সাংবাদিক ফারহাত জাভেদ ইন্টারভিউ নিয়েিছলেন সায়রার। সেখানেই স্পষ্ট, পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজ্য বালোচিস্তান কেমন আগ্নেয়গিরির শিখরে, অথবা মৃত্যু উপত্যকায়। সায়রার দাদা ছিলেন পুলিশ অফিসার। ২০১৮ সালে তাঁর সঙ্গে তিনজনকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তান সেনা। বালোচ বিদ্রোহীদের ধরার এক অপারেশনে। বাকিরা ফিরলেও সায়রার দাদাকে আর পাওয়া যায়নি। ওই তিনজনও আর একটা কথা বলেনি। একটা প্রতিবাদও না।

পুলিশ অফিসারকেই যদি এভাবে তুলে নিয়ে যেতে পারে পাক প্রশাসন, তা হলে বাকি বালোচিস্তান কেমন থাকতে পারে? রুখাসুখা শহর-গ্রামে আজও কয়েকশো লোক সায়রার মতো এ মর্গ থেকে ও মর্গ ঘুরে বেড়ান। হারানো স্বজনের সন্ধানে। বহু ‘বিদ্রোহী’ বহুকাল উধাও। সদ্য প্রথম পাক হিন্দু তরুণী হিসেবে বালোচিস্তানে কমিশনার হয়েছেন কাশিশ চৌধুরী। ছবি তাতে বদলাবে না।

সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান হামলার পর আমাদের অনেকেরই কৌতূহল ও ভাবনায় বারবার হানা দিয়েছে বালোচিস্তান। বাঙালির বহু আলোচিত শক্তিপীঠ মরুতীর্থ হিংলাজ যেখানে।

দিন দুই আগে সেখানকার দুটো ঘটনা আমাদের অতি দেশভক্তদের উল্লসিত করেছে। বালোচ লিবারেশন আর্মি ‘অপারেশন হেরফ ২.০’ নাম দিয়ে বালোচিস্তানে ৫৮ জায়গায় ৭৮টি হামলা চালিয়েছে। লক্ষ্য পাক সেনা। দুই, বালোচ বিদ্রোহী নেতা মির ইয়ার বােলাচ স্বাধীন ঘোষণা করেছেন বালোচিস্তানকে।

দ্বিতীয় ঘটনা অনেকটাই প্রতীকী। বরং ভারতের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ জিতে বিজয় দিবস পালন হয়েছে বালোচিস্তানের রাজধানী কোয়েটায়। উপেক্ষা-অবহেলার বালোচিস্তান ফুঁসছে, তবে স্বাধীনতা দূর অস্ত। মনে থাকবে অনেকের, ৯ বছর আগে নরেন্দ্র মোদি স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে বালোচদের আলাদা করে ধন্যবাদ জািনয়েছিলেন। ট্যাকটিকাল ধন্যবাদ। বালোচিস্তান কিন্তু তারপরেও স্বাধীন হতে পারেনি। ওভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া কঠিন। অতীতে সোভিয়েত বা যুগোস্লাভিয়া বা চেকোস্লোভাকিয়ায় হতে পারে, সুদানে হতে পারে। এখানে কঠিন।

মার্চে যেভাবে রুক্ষ পাহাড়ের মধ্যে, জনমানবহীন প্রান্তরে জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনকে কার্যত হাইজ্যাক করেছিল বােলাচ জঙ্গিরা, তাতে ওই রাজ্য নিয়ে ভারতে আগ্রহ বেড়ে যায় আরও। বালোচিস্তানের ওই প্রান্তরে জঙ্গিরা খুঁজছিল সে রাজ্যের বাইরের বাসিন্দাদের, দুই কামরাবোঝাই েসনাদের। নারী, শিশু, প্রবীণদের সঙ্গে তারা পরিচয়পত্র দেখে ছেড়ে দিচ্ছিল বালোচদের। এর বাইরে কেউ থাকলেই পলকে গুলি।

পহলগামের ঘটনার সঙ্গে কিছু কি মিল পান?

পহলগামের সবুজ স্বর্গীয় প্রকৃতির সঙ্গে বালোচিস্তানের মিল নেই কোনও। জমির হিসেবে বােলাচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রাজ্য, লোকসংখ্যা ধরলে সেখানে সবচেয়ে কম লোক। এবং সবচেয়ে উপেক্ষিত, অনুন্নত। বহু জায়গায় পানীয় জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, চাকরি নেই। অথচ বালোচিস্তানের মতো খনিজ পদার্থ সে দেশে কোথাও নেই। তামা এবং সোনা রয়েছে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের। তেল, গ্যাস েতা আছেই। পাকিস্তান প্রচুর লাভ করে সোনার হাঁস থেকে। স্থানীয়দের লাভ নেই।

বছর কুড়ি আগে পাকিস্তানের জাতীয় ফুটবল দলে ছিলেন বালোচিস্তানের এক ফুটবলার। তিনি ভারতীয় সাংবাদিকের কাছে আক্ষেপ করেছিলেন, ‘খেলা ছেড়ে কী করব জানি না। আমাদের ওখানে েতা চাকরি নেই।’ তা হলে কী করবেন? সটান উত্তর ছিল, ‘কী করব আর? রাস্তায় নেমে গুন্ডামি করব।

যে বালোচদের খুঁজে পাওয়া যায় না আর, যে বালোচরা উগ্রপন্থী হয়ে পাক প্রশাসনের বিরুদ্ধে নামে, তাদের মধ্যে কি ওই ছেলেটি থেকে যেতে পারে?

একটা সময় বােলাচিস্তান থেকে প্রচুর ফুটবলার এসেছেন কলকাতায় খেলতে। স্মরণীয়তম নাম জুম্মা খান, তাজ মহম্মদ। এই শতাব্দীতেও ভারতীয় ফুটবল টিম সেখানে খেলতে গিয়ে সমর্থন পেয়েছে প্রচুর। তারপর সব সম্ভাবনা শেষ।

এ সমস্ত ভাবি আর চোখের সামনে ভাসে বালোচিস্তানের সমুদ্রশহর নিউ গোয়াদরে জনমানববীন প্রান্তরে এক নতুন বিমানবন্দরের কথা। সিএনএন বলছে, এই বিমানবন্দর এক রহস্য। সবকিছু আছে সেখানে। শুধু যাত্রী নেই, বিমানও একখান-দুইখান। শহর এত দূরে, বিদ্যুৎ আসে ইরান বা সোলার প্যানেল থেকে।

তা হলে ৯০ হাজার লোকের শহরে ৪ লক্ষ যাত্রীর সুবিধেসম্পন্ন বিমানবন্দরের দরকার কী? পাকিস্তান-চিন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আজিম খালিদ সিএনএন-কে বলেছেন, ‘এই বিমানবন্দর পাকিস্তানের জন্যও নয়, গোয়াদরের জন্যও নয়। এটা চিনের জন্য। চিনা নাগরিকরা যাতে বালোচিস্তানে আসতে পারে। এখান থেকে আরব সাগর দিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় ব্যবসা করতে পারে।’ হিসেবটা বুঝলেন? চিনের পশ্চিমাঞ্চল জিনজিয়াং থেকে গোয়াদর চিন-পাকিস্তান আর্থিক করিডরের অঙ্গ।

চিনাদের কথা ভেবে এ শহর এখন ব্যারিকেড, কাঁটাতার, ওয়াচ টাওয়ার, চেকপয়েন্টে ভর্তি। সাধারণ মানুষ সন্ত্রস্ত। বােলাচ জঙ্গিদের স্বাধীনতার ডাকে তাঁদের সমর্থন থাকবে না?

ভারত-পাক সংঘর্ষের সময় দক্ষিণ ভারতের কাগজে চর্চায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। বালোচিস্তানে দ্রাবিড়িয়ান ভাষা ‘ব্রাহুই’-তে কথা বলেন অন্তত ২০ লক্ষ মানুষ। সে ভাষায় অনেক শব্দ দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত। কোথায় দক্ষিণ ভারত, কোথায় বালোচিস্তান! সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত দক্ষিণের সেওয়া রাজারা বালোচিস্তানের কিছু রাজ্যে রাজত্ব করত। দু’দিক থেকেই যাতায়াত ছিল। মারাঠীদের অনেক পূর্বসূরি যে বালোচিস্তানে চলে গিয়েছিল বাধ্য হয়ে, তা তো তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের ইতিহাসই বলে। যুদ্ধে জিতে ২২ হাজার মারাঠীকে ক্রীতদাস করে ওদিকে নিয়ে যান আমেদ শা আবদালি।

উত্তর ও দক্ষিণের বহু রাজনীতিক এখন এই তথ্য বক্তৃতায় বা সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে কাজে লাগাচ্ছেন। অসমের কংগ্রেস থেকে দল পালটে হঠাৎ চরম উগ্র হিন্দুত্ববাদী মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা যেমন মরুতীর্থ হিংলাজের উপস্থিতিকে টেনে এনেছেন দেখলাম।

বালোচিস্তান নিয়ে লেখা হবে, আর কুলভূষণ যাদব প্রসঙ্গ তুলব না, তা কী করে হয়? বছর নয়েক হল পাকিস্তানের জেলে বন্দি কুলভূষণকে পাক পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল বালোচিস্তানেই। র-এর এজেন্ট, ভারতীয় চর ঘোষণা করে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয় পাকিস্তান। আন্তর্জাতিক কোর্ট অফ জাস্টিসে আবেদন করে ভারত ওই প্রাক্তন নেভি অফিসারের মৃত্যু ঠেকাতে পেরেছে। দেশে ফেরাতে পারেনি আজও।

চর হিসেবে বন্দি সরবজিৎ সিংকে তো পাকিস্তানের জেলেই মেরে ফেলে অন্য বন্দিরা। প্রধান অভিযুক্ত আবার খুন হয়েছেন ক’দিন আগেই। ঠিক যেভাবে কুলভূষণকে অপহরণের পান্ডা মুফতি শাহ মীরকে ক’দিন আগে বালোচিস্তানেই খুন করেছে একদল অজ্ঞাতপরিচয় বাইকধারী। শুধুই পরতে পরতে রক্ত ও গুলি, সন্দেহ ও প্রতিহিংসা মাখা গল্পগুলোতে। মরুভূমিতে ক্রমাগত পালটে যায় বিপ্লবী ও জঙ্গিদের সংজ্ঞা, রহস্যময় গতিতে।

অপার রহস্যের অন্য নাম হয়েই আপাতত থাকবে রুক্ষ বালোচিস্তান, মরুতীর্থ হিংলাজের পূণ্যভূমি।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *