পাকিস্তানের দুর্বলতাই কমাচ্ছে উন্মাদনা

পাকিস্তানের দুর্বলতাই কমাচ্ছে উন্মাদনা

খেলাধুলা/SPORTS
Spread the love


 

  • অলোক দাশগুপ্ত

বাইশ বছর আগের ছবিটা এখনও যেন চোখের সামনে ভাসে। একটু আগে বিশ্বকাপের ম্যাচে দারুণ খেলে পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়েছে ভারত। সেঞ্চুরিয়ান মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে অগণিত ভারতীয় সমর্থক যাচ্ছেন। তার মধ্যে দিয়ে এক হাতে কিশোর পুত্রকে ধরে, অন্য হাতে জাতীয় পতাকা ওড়াতে ওড়াতে ছুটে এলেন অভিনেতা সুনীল শেঠি।

ক্রিকেট মাঠে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ ঘিরে অদ্ভুত এক উন্মাদনা দেখা দেয়। বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে এই দুই দেশের মধ্যে খেলা হোক না কেন, সব টিকিট আগাম বিক্রি হয়ে যায়। দর্শকাসন কানায় কানায় ভর্তি থাকে। রবিবার দুবাইয়ের ম্যাচটায় তার ব্যতিক্রম হয়নি।

তবে দুবাইয়ে ভারত অনায়াসে পাকিস্তানকে হারানোর পর কয়েকটা শহরে এদিক-ওদিক দু’চারটে বাজি ফাটলেও তৃপ্তির সেই উন্মাদনা যেন চোখে পড়ল না।

আসলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি তো আর ২০ বা ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ নয়। ১৯৯৮ সালে আইসিসি নক আউট টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছিল অ্যাসোসিয়েট দেশগুলোর আর্থিক ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য। ১৯৯৮ সালে আয়োজক ছিল বাংলাদেশ, ২০০০ সালে কেনিয়া। পরবর্তীতে এই প্রতিযোগিতা নাম বদলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হয়। প্রথমে এক বছর অন্তর প্রতিযোগিতা হলেও ২০০৬ সালের পর চার বছর অন্তর সংগঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৭-র পর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হয়।

যুক্তি ছিল, প্রতিটি ফর্ম্যাটে আইসিসি পরিচালিত একটাই টুর্নামেন্ট থাকবে। যেহেতু ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ আছে, তাই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রয়োজন নেই। তারপর হঠাৎই সিদ্ধান্ত বদল করে আইসিসি। দীর্ঘ আট বছর পর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আবার চালু হয়েছে বিশ্বকাপের সেরা আটটি দলকে নিয়ে। চার বছর পর পরের টুর্নামেন্ট হবে ২০২৯ সালে।

এখন টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ আছে। ৫০ এবং ২০ ওভারের বিশ্বকাপ আছে। তাছাড়াও রয়েছে আইপিএল, বিগব্যাশ সহ বিভিন্ন দেশের কুড়ি-কুড়ির প্রতিযোগিতা। সারা বছর ধরে ঠাসা সূচির মধ্যে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আবার নতুন করে শুরুর আদৌ কি প্রয়োজন ছিল?

আসলে এখন টেলিভিশনে অসংখ্য স্পোর্টস চ্যানেল। এদের সিংহভাগ চ্যানেলে মূলত ক্রিকেট খেলাই দেখানো হয়। ২৪×৭ চ্যানেল আকর্ষণীয় করে রাখতে হলে যত বেশি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা (ভারতকে অবশ্যই থাকতে হবে)  এবং আইপিএলের মতো জমাটি ক্রিকেট দেখানো যাবে, চ্যানেলগুলোর ততই পোয়াবারো। আর আইসিসি, বিসিসিআই এবং অন্য দেশগুলোর কাছে অর্থ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হওয়ার রাস্তা খুলে যাওয়া।

শেষবারের বিজয়ী পাকিস্তানকে এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয় ২০২১ সালে। নিরাপত্তার কারণে ভারত যে পাকিস্তানে খেলতে যাবে না, চার ধছর আগেই সেটা পরিষ্কার ছিল। বাস্তবকে উপেক্ষা করে চুপচাপ বসেছিল সংশ্লিষ্ট পক্ষ। ২০২৩-এর নভেম্বরে আইসিসির সঙ্গে কথা বলে পাকিস্তান বোর্ড ভারত ওদেশে খেলতে না গেলে ক্ষতিপূরণ দাবি করে। গত ডিসেম্বরে, প্রতিযোগিতা শুরুর দু’মাস আগে বিসিসিআই জানিয়ে দেয় নিরাপত্তার কারণে ভারতের পক্ষে পাকিস্তানে খেলতে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রথমে জোরালো আপত্তি জানালেও শেষপর্যন্ত ভারতের দাবির কাছে মাথা নত করে পাকিস্তান। ভারতের সব ম্যাচের আয়োজন করা হয় দুবাইয়ে।

’৯৬ বিশ্বকাপে নিরাপত্তার কারণে শ্রীলঙ্কায় খেলতে না গিয়ে ম্যাচ ছেড়ে দেয় অস্ট্রেলিয়া। প্রায় একই কারণে ২০০৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবোয়েতে খেলতে যায়নি ইংল্যান্ড আর কেনিয়ায় খেলেনি নিউজিল্যান্ড। ওদের ম্যাচ কিন্তু স্থানান্তরিত করা হয়নি।

ফুটবলের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ভাবাই যায় না। ফিফার কোনও প্রতিযোগিতায় আয়োজক দেশে খেলতে না যাওয়ার সাহস কোনও দেশই দেখাতে পারে না।

কিন্তু ক্রিকেটের গণ্ডি অনেক ছোট। আইসিসি ফিফার মতো শক্তিশালীও নয়। ‘বড়দাদা’ ভারতকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয় আইসিসি এবং সদস্য দেশের ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষে। ভারতকে বাদ দিয়ে প্রতিযোগিতার কথা অর্থনৈতিক এবং আনুষঙ্গিক কারণে সম্ভবই নয়।

পাশাপাশি ভারতের দাবি খুবই ন্যায়সংগত। অন্যান্য খেলায় ভারতীয় দল পাকিস্তানে মাঝেমধ্যে খেলতে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ক্রিকেটের কথাটা একেবারেই আলাদা। এদেশে ক্রিকেটের মতো উন্মাদনা অন্য কোনও খেলায় নেই। আর শুধু খেলোয়াড়দের নয়, সমর্থকদের খেলা দেখতে যাওয়ার বিষয়টিও আছে। বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে রকম সম্পর্ক, পাকিস্তানের যা পরিস্থিতি, তাতে কেন্দ্রীয় সরকার এবং নিরাপত্তা এজেন্সির সবুজ সংকেত না পেলে ভারতীয় বোর্ডের পক্ষে পাকিস্তানে দল পাঠানোর কথা ভাবাই যায় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

এই পরিস্থিতিতে দেরিতে হলেও সঠিক এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইসিসি। ২০২৭ সাল পর্যন্ত তাদের কোনও টুর্নামেন্টে ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হলে খেলা হবে নিরপেক্ষ কেন্দ্রে। যেমন ২০২৬ সালে টি২০ বিশ্বকাপের যুগ্ম আয়োজক ভারত ও শ্রীলঙ্কা। মনে হয়, পাকিস্তান তাদের সব ম্যাচ শ্রীলঙ্কায় খেলবে।

দীর্ঘ ১৭ বছরের ব্যবধানে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট যুদ্ধ আবার শুরু হয়েছিল ১৯৭৮-’৭৯ মরশুমে, ভারতীয় ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর দিয়ে। সেই সময় পাকিস্তান ছিল খুবই শক্তিশালী দল। ভারতের বিরুদ্ধে সামগ্রিকভাবে তাদের রেকর্ড ছিল একটু বেশি উজ্জ্বল। কিছুদিনের মধ্যে সমানে সমানে হয়ে দাঁড়ায় লড়াই। ভারতে খেলতে আসত পাকিস্তান, আবার পাকিস্তানে যেত ভারতীয় ক্রিকেট দল। দুই দেশের মানুষ অপেক্ষা করে থাকতেন ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের জন্য।

আর এখন দুই দেশের মধ্যে সিরিজ বন্ধ। ২০০৮ সালে পাকিস্তানে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের ওপর সন্ত্রাসবাদী হামলার পর বেশ কয়েকটি বছর পাকিস্তানে খেলতে যায়নি ক্রিকেট খেলিয়ে দেশগুলো। আর তার প্রভাব পড়েছে ওদের ক্রিকেটে। পিছিয়ে পড়েছে পাকিস্তান। সমর্থকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে ভারতের জয়ের সম্ভাবনা ক্রমশ যেন আরও উজ্জ্বল হচ্ছে। আর পাকিস্তান এক-আধবার ভারতকে হারালে সেটা অঘটন হিসেবেই ধরে নেওয়া হচ্ছে।

’৯৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের ২৯ বছর পর কোনও আইসিসি প্রতিযোগিতার দায়িত্ব পেয়েছে পাকিস্তান। ওদের দেশে প্রতিভার অভাব নেই। অভাব অর্থ, পরিকাঠামো, এক্সপোজার ও দেশের মানুষের আস্থা অর্জনের। পাশাপাশি বিদেশি দলগুলো যাতে ওদেশে খেলতে যেতে নিরাপদ মনে করে সেটা দেখা। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি তাদের কিছু সমস্যার সমাধান হয়তো করবে, কিন্তু পরপর দুটো ম্যাচ হেরে পাকিস্তান কার্যত গ্রুপ স্তর থেকেই বিদায় নেওয়ায় পাক সমর্থকদের হতাশই করবে।

সন্দেহ নেই রবিবার সন্ধ্যায় দুর্দান্ত জয় পেয়েছে ভারত। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং- সব বিভাগেই রিজওয়ানদের ওপর টেক্কা দিয়েছে রোহিতের দল। মানসিকভাবেও বেশি শক্তিশালী এবং ফোকাসড মনে হয়েছে টিম ইন্ডিয়াকে।

অবশ্যই এই ম্যাচের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বিরাট কোহলির ফর্মে ফিরে শতরান হাঁকানো। একটার পর একটা ম্যাচে বড়ই ছন্দহারা মনে হচ্ছিল বিরাটকে। অনেকে বলছিলেন, ওঁর এবার সরে দাঁড়ানোর সময় হয়েছে। ঠিক সময় চমৎকার কর্তৃত্বময় ইনিংস খেলে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন বিরাট। যে কোনও তরুণ ক্রিকেটারের চেয়ে তিনি ফিট। পুরোনো ছন্দে ফিরে তিনি আবার দলের প্রধান ভরসা হয়ে উঠলেন।

গ্রুপ লিগে ভারতের শেষ ম্যাচ নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে। শীর্ষে থেকে গ্রুপের খেলা শেষ করতে ওই ম্যাচ জিততেই হবে। ছন্দে আছে টিম ইন্ডিয়া। তার ওপর একই মাঠে সব ম্যাচই খেলছে। এই বাড়তি সুবিধাটা অন্য কোনও দল পাচ্ছে না। দুবাইয়ে প্রচুর ভারতীয় সমর্থক খেলা দেখতে মাঠে হাজির থাকেন। বিদেশে খেলা হলেও জনসমর্থন এবং মাঠ ও পরিবেশের কথা বিবেচনা করলে, ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’ রোহিত-বাহিনীই পাচ্ছে।

(লেখক সাংবাদিক)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *