পশ্চিমী ঝঞ্ঝায় ব্রাত্য দার্জিলিং

পশ্চিমী ঝঞ্ঝায় ব্রাত্য দার্জিলিং

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


 

  • সানি সরকার

‘বসন্তের রং ফুলে, শীতের রং কল্পনায়’, কথাগুলি কে বলেছেন জানা নেই। কিন্তু শীত যেন ক্রমশ কল্পনার পৃথিবীতে চলে যাচ্ছে। এই তো সেদিন নিজের উপস্থিতি জানান দিতে কড়া নাড়ল শীত। কিন্তু কাঁপনের স্থায়িত্ব পাওয়া গেল না তেমনভাবে। শীতের পরশ গায়ে মাখার আগেই হাজির ঋতুরাজ বসন্ত। ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে এর আগেও বসন্ত এসেছে। শীত-বসন্ত হাতধরাধরি করে চলেছে অনেকদিন। এবছর সব গোলমেলে।

বাংলার ছয়টি ঋতুর মধ্যে শীত অন্যতম। হিমেল বাতাসে জীবনের ছন্দ খুঁজে পাওয়া যায়। পাতাঝরার মধ্যে প্রকৃতির নতুন রূপ ধরা পড়ে। বসন্তকে আহ্বান জানিয়ে পুরোনো পাতা ঝরিয়ে নতুনভাবে সেজে ওঠে গাছগাছালি, বনানী। তাই তো আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও ভ্রমণ লেখক পল এডওয়ার্ড থেরক্স লিখেছেন, ‘শীত হল পুনরুদ্ধার এবং প্রস্তুতির একটি ঋতু।’

শীতকে যে সকলে একটি ঋতু হিসেবে দেখেন তা নয়। অনেকের কাছেই শীত ঋতু নয়, উদযাপন। এর যথেষ্ট কারণ রয়েছে। হেমন্তের বেলা সাঙ্গ হলেই তো খোলা জানলায় চোখ রাখে বাঙালি। শুরু হয়ে যায় কাছে-দূরে বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি। মিঠে রোদে নদীতট থেকে বনাঞ্চলে জ্বলে ওঠে চড়ুইভাতির আগুন। যে আগুনে খাক হয়ে যায় বিভেদ। অজানাকে জানতে পর্যটকের ভিড় বাড়ে। ‘জনঅরণ্যে হারিয়ে যায়, না পাওয়ার যন্ত্রণা। আসলে ‘প্রকৃতির ঘুমের মাস শীতে আমরা নতুন করে জেগে উঠি। তাই তো ইতালিয়ান কবি পিয়েত্রো আরেতিনো বলেছেন, ‘শীত প্রতিভার বসন্ত।’

অথচ এই শীতই ক্রমশ ক্ষণস্থায়ী হয়ে উঠেছে ইমারতের জঙ্গলে। একটা সময় অক্টোবরের শেষ পর্ব থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত শীতের অনুভব পাওয়া যেত হিমালয় সংলগ্ন উত্তরে। এখন সেখানে ডিসেম্বরে এসে ফেব্রুয়ারির আগেই পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়েছে শীত। উত্তরবঙ্গেও শীত যেন হামিংবার্ড। দেখা দিয়েই ফুড়ুত করে পালিয়ে যায় দূর আকাশে।

কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। ডিসেম্বরে লা নিনার মতিগতি দেখে আবহবিদদের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, ‘এবছর শীত হবে দীর্ঘস্থায়ী।’ কিন্তু বাস্তবে এল নিনোর প্রভাবে শীতের ছুটির ঘণ্টা বেজেছে আগাম। পরিসংখ্যান বলছে, ১৮৫০-এর শিল্পবিপ্লবের আগে পৃথিবীর যে গড় তাপমাত্রা ছিল, এবছর জানুয়ারি মাসের তাপমাত্রা তার চেয়ে ১.৭৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেশি। ২০২৪ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি উষ্ণতম। এবছর কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। এর মূলেই রয়েছে গত জুলাই থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের চরিত্র বদল। জলের উপরিভাগের তাপমাত্রা বাড়ছে। এল নিনোর প্রভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তাপমাত্রা বাড়ছে। ভয়ংকর সময়ের মুখোমুখি আমরা।

কিন্তু শীতের আয়ু কেন ক্রমশ কমছে? সকলেই এক বাক্যে জলবায়ুর পরিবর্তনের কথা বলবেন। কিন্তু ক্লাইমেট চেঞ্জের জন্য কি আমরা দায়ী নই? তিলে তিলে প্রকৃতিকে তো ধ্বংস করেছি আমরা, উন্নয়নের বর্মকে সামনে রেখে। জলবায়ুর পরিবর্তন নগর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পড়লেও, আমাদের হুঁশ নেই। উন্নত দেশগুলি এবং উন্নয়নশীল বিশ্ব প্রকৃতি বাঁচাতে যখন তৎপর হয়ে উঠেছে, বিদ্যুতের ঘাটতি হতে পারে জেনেও একের পর এক থার্মাল পাওয়ার েপ্রাজেক্ট বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন আমরা সাধারণ মহানন্দা অভয়ারণ্যে ইকো সেনসিটিভ জোনের সীমানা নির্ধারণ করতে পারছি না। বৈঠকের পর বৈঠক শুধু হচ্ছে। কেন? প্রস্তাবমতো প্রথম এক কিলোমিটার সংরক্ষিত এবং পরবর্তী চার কিলোমিটার নিয়ন্ত্রিত হলে মাঠে মারা যাবে লগ্নি।

ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা তো বটেই শীতের মাপকাঠি সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়া দপ্তরের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ১৯৫১ সালের পরবর্তী সময়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি হিমালয় অঞ্চলে। এক্ষেত্রে প্রতিটি জায়গাকে টেক্কা দিয়েছে পড়শি সিকিম।  যার প্রভাব পড়ছে কালিম্পংয়ের পাশাপাশি ডুয়ার্স এবং তরাইয়ে।

স্নো গেইজ বা রেইন গেজের বার্ষিক যোগফলে বিষয়টি সেভাবে ধরা না পড়ায় উদ্বেগটা সহজে বোঝা যায় না। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিতে শোনা যায় ভবিষ্যতের অশনিসংকেত। এই যে এখন গত কয়েকদিন ধরে প্রবল তুষারপাত হচ্ছে পূর্ব বা উত্তর সিকিমে। দিনের পর দিন বন্ধ যান চলাচল। হোটেলবন্দি পর্যটকরা। একই পরিস্থিতি শ্রীনগর, হিমাচলপ্রদেশ, অরুণাচলে। এমনটা কিন্তু অতীতে দেখা যায়নি। এক দশক আগেও বৃষ্টি এবং তুষারপাতের ডিস্ট্রিবিউশন ছিল মরশুমের দিনগুলিতে কার্যত সমপরিমাণ। ফলে বিপদের মুখোমুখি হতে হত না। এখন যখন বৃষ্টি বা তুষারপাত হচ্ছে, তার পরিমাণ এতটাই বেশি যে বিপদের মুখে পড়তে হচ্ছে।

সিকিমে যেখানে দিনের পর দিন তুষারপাত ঘটছে, সেখানে কেন ব্রাত্য থাকছে পড়শি দার্জিলিং পাহাড়? এবছরের পরিস্থিতি দেখে অনেকেই এমন প্রশ্ন করছেন।  আসলে তুষারপাত নির্ভরশীল কিছু শর্তের ওপর। যার অন্যতম জলীয় বাষ্পের জোগান। এবছর শক্তিশালী যে ক’টি পশ্চিমী ঝঞ্ঝা এই অঞ্চলে এসে নিম্নচাপ সৃষ্টি করেছে, তার প্রতিটির অভিমুখ উত্তরমুখী। ফলে উত্তর সিকিম হয়ে অরুণাচলে চলে গিয়েছে ঝঞ্ঝাগুলি। ব্রাত্য থেকেছে দার্জিলিং।

একসময় স্থানীয় স্তরে জলীয় বাষ্পের জোগান ঘটত দার্জিলিংয়ে। কিন্তু এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না জোগানের উৎসস্থল পরিচিত ঝরনাগুলিকেও। একের পর এক ঝরনা পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে বাড়ি-দোকান তৈরিতে। ফলে ঝরনাগুলি থেকে জলীয় বাষ্পের জোগান ঘটছে না। তেমনভাবে বৃষ্টি পাওয়া যাচ্ছে না। যে কোনও পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টিছায়া এবং বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা থাকে। সিকিম ও দার্জিলিংয়েও রয়েছে। বৃষ্টিছায়া অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে কম বৃষ্টি হয়। কিন্তু এখন দুই অঞ্চলের মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য নেই। সর্বত্রই শুষ্ক আবহাওয়া।

উত্তরের শীত কিন্তু অনেকটা নির্ভরশীল পাহাড়ি আবহাওয়া এবং বৃষ্টির ওপর। সাধারণত এই অঞ্চলে শীতের দরজা খুলে দেয় পশ্চিমী ঝঞ্ঝা। ঝঞ্ঝা যত শক্তিশালী, ততই ঠান্ডার প্রকোপ। কিন্তু প্রকৃতির খামখেয়ালিতে এবছর ঝঞ্ঝা তেমনভাবে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে না। পাহাড়ের পাশাপাশি শুষ্ক থাকছে সমতল। ছুটির ঘণ্টা বাজার আগেই পাততাড়ি গুটিয়েছে শীত।

বর্তমান সময়টা কি আগাম টের পেয়েছিলেন পেশায় সাংবাদিক-লেখক আমেরিকার হ্যারাল্ড গ্লেন বোরল্যান্ড? না হলে কয়েক দশক আগে তিনি কেনই বা লিখবেন, ‘শীত চিরকাল স্থায়ী হয় না।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *