পরিচর্যা ছাড়া ভাষা শুধু শুধু বাঁচে না

পরিচর্যা ছাড়া ভাষা শুধু শুধু বাঁচে না

ব্লগ/BLOG
Spread the love


সন্দীপন নন্দী

দিবসরজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি! কী সেই দুর্লভের আহ্বান? কসমোপলিটান শিলিগুড়িতে আজ ঋজু দাঁড়িয়ে নির্বিঘ্ন কিছু নার্সিংহোম। পথিকের রাত্রিবাসের আয়োজক বালুরঘাটের সরকারি দালানবাড়ি ক্ষণিকা কিংবা হিলি মোড়ে চিরকালের এককোণে গুম মারা দুর্দান্ত নামের দোকান, দিনের শেষে।

প্রশ্ন জাগে? কে দিয়েছে এই নাম? বার্তা রটে ক্রমে, শোরগোল আক্রান্ত সুভাষপল্লি বাজারেও আলোড়ন নামক বৈদ‍্যুতিক দ্রব‍্যের দোকানটি সগৌরবে চলিতেছে। কে বলে বাংলা ভাষা গৌরব হারিয়েছে?

এখানেই শেষ নয়! জলপাইগুড়ি প্রভাত মোড়ের ব‍্যস্ততম চৌমাথায় উইমেন গারমেন্টসের সঞ্চয় নিয়ে কালে কালে বেষ্টিত দোকানের নাম হয়েছিল আধুনিকা, মফসসলের বিহ্বল গিফট শপের নাম ছিল সবভালো।

তাই আশা জাগে। যখন বরিস্তা, আশিয়ানা নামক রেস্টুরেন্টের মাঝেও তিস্তাপাড়ে থমকে থাকা হোটেলের নাম হয়ে যায় যাযাবর আর সেই ছায়াবৃত ভাতডালের সাম্রাজ‍্য নিয়ে বসে থাকা বৃদ্ধ মালিকের ক‍্যাশ বাক্সের পাশে অবলীলায় অমিয়ভূষণ, দেবেশ রায়, সমরেশের সমাবেশ দেখে মনে হয়েছিল নেপথ‍্যে এ ভাষার আলো মরে নাই, এ ভাষা অনুপম!

তাইতো জলঘরের প্রত‍্যন্ত রুরাল এলাকায় ভরা বসন্তেও ব‍্যবসা করে যায় অনন্ত এক চায়ের দোকান চুমুক। কোন নক্ষত্রবীথিতলের রায়গঞ্জ বিদ্রোহী মোড়ে ধাবমান মানবের ভেসে আসা ডাকনামে ঝিলমিল লাগে নাইটবাস চালকের। সহন মার্ডি। ভাবি কী অপূর্ব জন্ম তার।

এমনই এক নিখুঁত বিশ্বের চৈতালি দ্বিপ্রহরে কুসুমতোড় গ্রামের ট্রাইবাল ভিলেজে ঝরে পড়া সজনে ফুল কুড়োয় কিশোরী কন‍্যা তীব্রতা মুর্মু। বাংলার বাড়ি এনকোয়ারি টিমের সঙ্গে আলাপ করতে এগিয়ে আসে কৃষ্ণকায় তরুণ চমক মুন্ডা। দেখি দরদি বাস্কে একমনে সহাস‍্য বদনে পুড়ে যাওয়া পাতিলের কালি তোলে ওই অদূর পুকুরপাড়ে।

ফলে জানার মাঝে অজানার সন্ধান মেলে এব‌ং যে ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে এ মর্মের বাংলায়। আবার সে পৃথিবীরই কোথাও জেগে থাকে মাধুর্যের আশ্চর্য গ্রাম তালমন্দিরা, হলদিডাঙ্গা, বিরহি, ফুলঘরা অথবা ঊষাহরণেরা। শতাব্দীর নামমুগ্ধতায় যারা ছিল অকল্পনীয়, খানিক অভূতপূর্ব! তবু বাংলা নামের শ্রেষ্ঠত্ব বিচারে প্রকৃতির কাছে গচ্ছিত থাকে কিঞ্চিত আজন্ম মায়া!

মায়ের এ ভাষাতেই নাকি গোপন ছিল আমাদের পূর্বপুরুষের অরহিত কান্নাহাসির পৌষফাগুনের গানগুলি, দেশভাগের স্মৃতিমালারা।

স্বাভাবিক। তবু দুনিয়া কাঁপানো দিনেও কীভাবে দূরে রাখা যায়, পূর্বাশা নামক ক্লাবকে! যে ধারায় অগ্নিশিখা, যাত্রিক, কবিতীর্থ, সৃজনী, উত্তমাশা, অভিযাত্রীও নামমাহাত্ম‍্যে শ্রেষ্ঠতম ক্লাব হতেই পারত।

শোনা যায়, একদিন এই বাংলাদেশ লাগোয়া শহরের ভাড়াবাড়িতে যমজ ভাই উষ্ণ আর স্পর্শকে একত্রে ভাত খেতে ডেকেছিল তাদের মা। কারণ ভাষা তো নদীর মতো, বয়ে যায় দুর্নিবার, হেঁটে যায় মুখে মুখে।

কোথায় নেই সে কৃষ্টি? আগরতলায় নগণ‍্য চাল, চিনি, ডাল বিক্রেতার দোকানের মাথায় লেখা ছিল শঙ্খচিল। যাদবপুরে এক বিচিত্র গৃহবাসীর মুক্তদুয়ার পেরিয়ে অন্দরমহল সেজে ওঠে সমৃদ্ধ বাংলা ভাষায়। যার ঐশ্বর্যের শু র‍্যাকের নাম জুতোর বাড়ি। কিচেনের ডাকনাম পাকস্থান আর বাতানুকূল যন্ত্রের পাশে গৃহকর্তা সাদরে লিখেছেন মা শীতলা। এ-ও হয়? যে বাড়ির কন‍্যার নাম বিভাবরী আর পুত্র বৈভব। এটুকুই তো বঙ্গভাণ্ডারের বিবিধরতন।

তবু তনুশিয়া, আরুথিরা, ফ্রেয়া, আদ্ভিকা, আইলিতার বঙ্গে নাম বিপর্যয়ের তালিকা দীর্ঘ হয় রোজ। যে নামের অর্থ খুঁজতে হন‍্যে হয় সরল অভিধান থেকে নাটোরের বনলতা সেন। আসলে ভাষা এমনি এমনি বাঁচে না, তাকে ইতস্তত জলবাতাসের লালনে, আদরে বাঁচিয়ে রাখতে হয়।

(লেখক বালুরঘাটের বাসিন্দা, প্রবন্ধকার)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *