ন হন্যতে

ন হন্যতে

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


  •  শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ

সমুদ্রে কিংবা নদীতে অথবা পাহাড়ে মাখামাখি সূর্যোদয় দেখলে, মনে হয় না, জীবন এত ছোট কেন? তারাশঙ্করের উপন্যাসের প্রসিদ্ধ উক্তির মতো? একটুকরো মেঘ, একটি ফুল, গুল্ম থেকে গান–কত কিছুই পারে আমাদের চিরন্তন বেঁচে থাকার ইচ্ছেকে জাগিয়ে তুলতে। সেই চিরন্তন বেঁচে থাকার ইচ্ছেই অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা। তারও বোধহয় শ্রেণিভেদ আছে। দরিদ্র তাঁর অসহনীয় জীবনকে দীর্ঘায়িত করতে খুব কম চাইবে। কিন্তু যার সম্পদ প্রচুর? সে তো আরও ভোগের ইচ্ছেতেই লিপ্ত থাকবে। সেজন্যই হয়তো অমরত্বের সন্ধান করেছে সব প্রাচীন সভ্যতা নানা মিথে।

প্রথম মিথ, প্রাচীন মানবের নানা অনুসন্ধিৎসার উত্তর খোঁজার পদ্ধতি ও পরিক্রমা। সৃষ্টিরহস্য থেকে জন্ম-মৃত্যু, সবই তার আওতাধীন হয়েছে তাই। তার একটি ভাগ যদি কল্পনার ব্যবহার হয়, অন্য ভাগটি অবশ্যই কল্পনা নির্ভর কৃত্যের। সেগুলি যাগযজ্ঞ, পূজার্চনার জন্ম দিয়েছে।

একদম প্রাথমিক স্তরের মিথে মানুষ কোনওভাবেই অমর নয়। কিন্তু দেবদেবীরা? দেবদেবীদের বা কোনও এক দেবতা বা দেবীকে বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা সৃষ্টির মূলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা বা তিনি অমর কি না, এ প্রশ্ন উঠছে পরের দিকের মিথগুলিতে। আমাদের এখানকার মিথ বা পুরাণে যেমন আমরা জানছি দেবদেবীরা চিরজীবী নন, তাঁদেরও মৃত্যু হয় প্রলয়কালে। আবার ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ক্ষেত্রে অবিনাশী ভাবনাটিই মুখ্য।

এক প্রলয় থেকে আরেক প্রলয়কালের মধ্যেকার যে দীর্ঘসময়, তাতেও দেবদেবীদের বাঁচতে হয় দুটি পদ্ধতিতে। প্রথম ধাপে ছিল মৃত-সঞ্জীবনী সুধা, যা দানবগুরু শুক্রের থেকে জেনে আসবেন কচ, দেবযানীর দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে। দেবাসুরের যুদ্ধে মৃত্যু হলে দেবতারা সেই সুধায় বাঁচবেন আবার। লক্ষণীয়, যুদ্ধ ছাড়া ভিন্ন কারণের কথা কিন্তু নেই এখানে। দ্বিতীয় ধাপে, সমুদ্রমন্থন করে অমৃত উত্থাপনের কাহিনী, যাতে অমৃত একবার পান করলেই অমরত্ব হাতে। কিন্তু তা এক প্রলয় থেকে অন্য প্রলয়ের সময়কাল অবধি।

যে মানুষ দেবদেবীদের অমরত্ব সৃষ্টি করেছে, সে নিজের অমরত্বের কথা ভাববে না তা তো হয় না। অতএব মানুষ, না-মানুষ এবং রাক্ষসদের মধ্যে থেকেও অমরত্বপ্রাপ্ত চরিত্র এসেছে আমাদের পুরাণে। রামায়ণে অমর রাক্ষস বিভীষণ এবং না-মানুষ হনুমান। রামকে কিন্তু অমর করা হয়নি। তিনি মরমানুষই, বিষ্ণুর অবতারত্বের মহিমাবৃদ্ধি যাঁর কাজ। ওদিকে রামভক্তির পরাকাষ্ঠা হনুমান এবং রামমৈত্রীর পরাকাষ্ঠা বিভীষণকে অমর করে পুরাণকারেরা জানিয়ে দিয়েছেন রাম-ভক্তি ও রাম-মৈত্রীর মাহাত্ম্য।

মহাভারতে চিরঞ্জীবী হওয়ার অধিকার পেয়েছেন বেদব্যাস, অশ্বত্থামা ও কৃপাচার্য। ভার্গব ঋষি মার্কণ্ডেয়র কথা মহাভারতে থাকলেও বলা চলে ভার্গব ব্রাহ্মণদের সমগ্র মহাভারতজুড়ে প্রক্ষেপ ঘটানোর ফল সেটি। যেমন, পুনের ভাণ্ডারকর ইনস্টিটিউটের ভি এস সুকথংকর বলেছিলেন। কিন্তু দেখার বিষয় এই তিনজন প্রথমত মানুষ। দ্বিতীয়ত, তাঁদের অমরত্বের কারণগুলির বিভিন্নতাও আকর্ষণীয়।

বেদব্যাস, অনেক ব্যাসদের মধ্যে একজন হলেও, বেদ বিভাজন ছাড়াও মহাভারত এবং অন্যান্য নানা শাস্ত্র প্রণয়নের জন্য প্রসিদ্ধ। অন্যান্য ব্যাসেরা কেউ মহাভারতের মতো মহাকাব্য প্রণয়ন করেননি, যা যুগে যুগে মানুষ পাঠ করবে। অতএব, তিনি তাঁর সৃজনকর্মের ফলেই অমরত্বের দাবিদার। অশ্বত্থামাও কর্মফলে অমরত্বের দাবিদার, কিন্তু সে কর্ম দুষ্কর্ম।

কথিত যে অশ্বত্থামা, বেদব্যাসের পরের ব্যাস হতে পারতেন, ব্যাস পরম্পরায়। কিন্তু তিনি ব্রাহ্মণ হয়েও শুধু অস্ত্রধারী নয়, নিরস্ত্র এবং ঘুমন্তদেরও হত্যা করেছেন পাণ্ডবশিবিরে, পিতার মৃত্যু এবং দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের প্রতিশোধ নিতে। একে ব্রাহ্মণোচিত কর্ম বলে সম্ভবত পুরাণকারদের মনে হয়নি। যেমন উত্তরার গর্ভের সন্তানকে হত্যা, যেহেতু তিনি তাঁর অস্ত্রের প্রত্যাহার জানতেন না। এমন কর্মের জন্য তিনি অমরত্ব পেলেন, কিন্তু আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ রূপে।

ওদিকে আরেকজন, কৃপাচার্য। তিনি অমরত্ব পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে তাঁর গুণের জন্য। তিনি কোনও ছাত্রের প্রতি পক্ষপাত করতেন না। দ্রোণাচার্যও অস্ত্রশিক্ষক, বীর যোদ্ধা ইত্যাদি। কিন্তু তাঁর স্পষ্ট পক্ষপাত ছিল অর্জুনের প্রতি। শিক্ষকের পক্ষপাতী হওয়া অনুপযুক্ত কাজ বলে কৃপকেই শিক্ষকের আদর্শ হিসেবে চিরঞ্জীবী করা হয়েছে বলে মনে হয়।

আবার রামায়ণ-মহাভারত ব্যতীতও পুরাণের আরেকজন চিরঞ্জীবী বলি রাজা। সেই রাজা, যাঁর থেকে বিষ্ণু বামন অবতাররূপে ত্রিভুবন অধিকার করেছিলেন ত্রিপাদে। বলি অসুর, কিন্তু প্রজাদের প্রিয় রাজা। তাঁর মহানুভবতা, প্রজাপক্ষীয় হয়ে শাসন, তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে ব্রাহ্মণ্য আখ্যানে। সঙ্গে এ ভাবনাও হয়তো থেকেছে, দেবতার ভাবনা থাকলে প্রতিদ্বন্দ্বী অসুরাদির ভাবনাও চিরজীবীই হবে। তবে সঙ্গে একথাও বলা প্রয়োজন, এই অষ্ট চিরঞ্জীবী কলিযুগ অবধিই অমর। অতঃপর এঁদেরও মৃত্যু হবে। অর্থাৎ পুরাণকাররা যুগ পরিবর্তন এবং যুগাদর্শ পরিবর্তনে এঁদের স্থান অপহৃত হবে একথাও ভেবেছেন।

অন্যান্য দেশের পুরাণেও রয়েছে অমরত্ব খোঁজার কথা। আধা-ঐতিহাসিক, আধা-পৌরাণিক গিলগামেশ থেকে গ্রিক সাম্রাজ্যবিজেতা আলেকজান্ডারও নিজেদের সম্ভোগের জন্য অমরত্ব চেয়েছেন, পাননি। গিলগামেশের পূর্বজ উটনাপিশটিম, প্রলয় বন্যার সময় প্রাণীদের রক্ষা করেছিলেন দেবতাদের আদেশে। তিনি, তাঁর স্ত্রী এবং নৌকার মাঝি তাই অমর। উটনাপিশটিমের সুমেরীয় মিথটি পরবর্তী নোয়া কিংবা মনুর মিথের পূর্বসূরি। আবার গ্রিক পুরাণের দেবদেবীরা, টাইটান বা অলিম্পিয়ান, সকলেই অমর। যদিও তাঁদের ব্যথা-যন্ত্রণা, দুর্বলতা রয়েছে, কিন্তু অমরত্বও রয়েছে। আমাদের দেবদেবীদের মতো তাঁরা প্রলয়ে ধ্বংস হবেন না।

অসাধারণদের কথা হল, কিন্তু সাধারণের অমরত্ব কি তাহলে অসম্ভব? উত্তর দিতেই সম্ভবত গ্রিক এবং আমাদের পুরাণে ভাবনা এসেছে আত্মার। যে অজড় অমর অবিনাশী। তৈরি হয়েছে গীতার প্রসিদ্ধ শ্লোক, ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।’ বাস্তবে না-হোক আত্মার কল্পনাতে, পুনর্জন্মের কল্পনাতে অমর হলেও তো সান্ত্বনা জোটে।

The publish ন হন্যতে appeared first on Uttarbanga Sambad.



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *