নেতারা পাশে থাকলে গুরুদের কী চিন্তা!

নেতারা পাশে থাকলে গুরুদের কী চিন্তা!

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


রূপায়ণ ভট্টাচার্য

একদল আপ্রাণ খুঁজে বেড়াচ্ছে একটা প্লাস্টিকের শিরদাঁড়া। অসীম কৌতূহল তাঁদের, লালবাজারে পুলিশকর্তাদের টেবিলে ডাক্তারদের রেখে আসা শিরদাঁড়াটা এখন কোথায়?

কোথাও রাখা আছে, না একেবারে ফেলেই দেওয়া হয়েছে?

আর একদল খুঁজে বেড়াচ্ছে পুলিশের লাথি আর কোথাও পড়েছে কি না। লাথির বাজার এখন চমৎকার। আরেক দল খুঁজে বের করেছে অন্য লাথি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে লাথি ওমপ্রকাশ মিশ্রকে মেরেছিল এক ছাত্র।

একদল সেই লাথিমারা পুলিশ অফিসারকে খুঁজছে। আর একদল খুঁজে বের করেছে লাথি খাওয়া শিক্ষককে।

এসবের মাঝে দোলনায় দোল খেতে খেতে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি অন্য একটা প্রশ্নের উত্তর।

আজকের এই আবহে কে ঋষি, কে সাধু? কে সন্ত, কে মুনি? কে সন্ন্যাসী, কে যোগী?

তিনজোড়া প্রশ্নের ব্যাখ্যা খুঁজতে বসার পর খেয়াল হল, এই যে রাম রহিমের মতো বহুচর্চিত আসামি, তাঁর তো নামের সঙ্গে এসব নেই। পুরো নাম গুরমিত রাম রহিম সিং। একবার তিনি সাধু, একবার শোম্যান। একবার খুনি, একবার ধর্ষক।

রাম ও রহিম– দুটো নাম বুদ্ধি করে মিশিয়েছেন নামের মাঝে। নিজের প্রচারে বেশ কিছু ফিল্ম ও গান বানিয়েছেন। তাতে অভিনয়ও করেছেন। কনসার্ট করতেন। নাম ছিল– রুহানি রু-বা-রু। গিনেসে নাম তুলেছিলেন সবচেয়ে বেশি রক্তদান শিবির ও গাছ লাগিয়ে। আজকের গুরুরা জানেন, কীভাবে প্রচার নিতে যায়।

এই রাম রহিম মানে ‘আরআর’-এর জীবন দেখলে এখন একবার মনে হয়, যতই ভিআইপি হও, তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে। আরেকবার ভাবি, আইন আজও আসলে সবার জন্য সমান নয়। না হলে লোকটা এত ঘনঘন প্যারোলে ছাড়া পায় কী করে? আরেকটা বিস্ময়। প্রচুর মহিলাকে ধর্ষণ ও খুনের দায়ে অভিযুক্ত রাম রহিমকে কেন ছুড়ে ফেলে না মানুষ?

মনে রাখা ভালো, রাম রহিম একদা ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমিই অতীতে ছিলাম কৃষ্ণ। আমি সবার রোগ সারিয়ে দিতে পারি।’ অথচ নিজের কুকীর্তির রোগগুলোর সমাধান করতে পারেননি। রাজস্থানের যে গ্রামে তাঁর বেড়ে ওঠা, সেখানে রাজস্থান-হরিয়ানা-পঞ্জাবের সীমানা মিশেছে। ভারত-পাক সীমান্তও কাছে। সেখানে মানুষ ভক্তিরসে ডুবুডুবু। কেউ ‘অতীতের কৃষ্ণ’কে ব্যঙ্গ করেননি। বরং উথলে উঠেছে ভক্তিরস।

৮ বছর আগে রাম রহিমের ২০ বছর জেল ঘোষণা করেছিল সিবিআই আদালত। প্রথমদিকে বেশ ঠিকঠাক চলছিল। ২০২০ সালের অক্টোবরে অসুস্থ মাকে দেখার জন্য একদিনের প্যারোলে মুক্তি পান। সেদিন থেকে আজ, দশবার প্যারোলে মুক্তি পান। সব সরকারি উদ্যোগে। সংখ্যার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, মাঝে মাঝেই মুক্তির দিনের সংখ্যাটা বেড়ে চলেছে। একবার ৩০ দিনের প্যারোল, একবার ৪০ দিনের, একবার ৫০ দিনের। সব মিলিয়ে ৩২৬ দিন। হরিয়ানার সিরসায় তাঁর সংস্থা ডেরা সচা সৌওদাতে উৎসব হবে বলে একবার মুক্তি পেয়েছেন ৩০ দিনের জন্য। এসব কোন পথে সম্ভব? উমর খালিদদের মতো বন্দি অ্যাকটিভিস্টরা এমন সুযোগ পান না তো!

বিরোধীরা যা হিসেব দিচ্ছে, তা ভয়ংকর। নির্বাচনের ঠিক আগে প্যারোলে মুক্তি পান রাম রহিম। তাঁর কয়েক লক্ষ ভক্তের অধিকাংশই, প্রায় সত্তর শতাংশ দলিত। তাঁদের ভোটের জন্যই আরআর-কে ফিরিয়ে আনা। হরিয়ানায় বিজেপি সরকার চলছে। তারা ঠিক কোনও না কোনও কারণ দেখিয়ে বের করে আনছে। ভোট বড় জ্বালা। সরকারের তরফে সওয়াল হয়েছিল, জেলে নাকি তাঁর খুব ভালো ব্যবহার।

আরআর-এর রাজনৈতিক খুঁটির জোর কোথায়, জানতে চান? পালটা প্রশ্ন হবে, খুঁটি কোথায় নেই? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেই তাঁর ভালো চেনাশোনা। মোদি প্রকাশ্যে প্রশংসা করেন তাঁর। হরিয়ানার আগের মুখ্যমন্ত্রী মনোহর খাট্টার এখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তিনিই ‘আরআর’কে প্যারোলে ছুটি দেওয়ার রাস্তা সোচ্চারে বাতলে দিয়েছেন। যুক্তি সরবরাহ করেন রাজ্যের কারামন্ত্রী রঞ্জিৎ সিং চৌতালা, প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী দেবীলালের ছেলে!। হরিয়ানার ক্রীড়ামন্ত্রী অনিল ভিজ একবার ৫০ লক্ষ টাকা অনুদান দেন রাম রহিমের সংস্থার জন্য। সেখানে নাকি খেলার উন্নতিতে কিছু হবে! প্রচুর বিতর্ক ওঠে। নো তোয়াক্কা।

শেষ নয় এখানেই। কেন্দ্রের ক্ষমতাবান মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখরের সঙ্গে জান পহেচান আরআর-এর। হরিয়ানার দলবদলিয়া বিজেপি নেতা (আগে তিনবারের কংগ্রেস বিধায়ক) হরমিন্দর জাসসির মেয়ের বিয়ে হয় রাম রহিমের ছেলের সঙ্গে। সেই বিয়েতে পর্যন্ত গিয়েছেন চন্দ্রশেখর।

এসব ক্ষমতাবান-যোগ শুনলেই স্পষ্ট, কুড়ি বছর জেলে ঘানি টানা সাজাপ্রাপ্ত এত ঘনঘন প্যারোলে মুক্তি পান কী করে।

কুম্ভমেলার সৌজন্যে আমরা অদ্ভুত অদ্ভুত সাধুর ছবি দেখলাম এবার। ল্যাপটপ বাবা, ফেসবুক বাবা, সেলফি বাবা, বুলেট বাবা, এয়ারপ্লেন বাবা, ড্রোন বাবা, আয়ুর্বেদ বাবা, মোটর সাইকেল বাবা, হেলমেট বাবা, এফ সিক্সটিন বাবা, ইন্টারনেট বাবা, ক্যামেরা বাবা, সিনেমা বাবা, গঙ্গা বাবা, গীতা বাবা, রামায়ণ বাবা, মহাভারত বাবা।

যাক, রাম রহিম অন্তত কুম্ভমেলা যেতে ৫০ দিনের প্যারোলে মুক্তি পাননি!

তাঁর সম্পত্তির তালিকায় চোখ বুলোচ্ছিলাম সেদিন। দেখলাম, মোট সম্পত্তি ১০০ কোটি ছাপিয়ে গিয়েছে বহুদিন। হরিয়ানাজুড়ে তাঁর মন্দিরগুলো তো রয়েছেই। বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত গুরুর অজস্র বিদেশি-দেশি গাড়ি। মার্সেডিজ-বেঞ্জ এবং বিএমডব্লিউও পাবেন।

এক আধ্যাত্মিক গুরুর এত গাড়ি লাগবে কেন? মানুষ কিন্তু প্রশ্ন তোলেননি। গুরুমশাই সে সুযোগও দেননি। ভক্ত মিডিয়াকে ব্যবহার করে, জনমতই বদলেছেন বারবার।

পাঁচ বছর আগে তখনও খুন-ধর্ষণের দায়ে ধরা পড়েননি হরিয়ানার মহাগুরু। তখন খবর এল, রাষ্ট্রসংঘের জলসম্পদ দপ্তর নাকি রাম রহিম ও তাঁর পালিত কন্যা হানিপ্রীত ইনসানকে বিশ্ব টয়লেট দিবস উপলক্ষ্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। হইহই ব্যাপার। পরে জানা গেল, খবরটা ঠিক নয়। রাষ্ট্রসংঘের ওই বিভাগের সরকারি অ্যাকাউন্ট থেকে টুইট করা হয়েছিল খবরটা— রাম রহিমের কত লম্বা হাত ভাবুন। তারপর মুছেও দেওয়া হয়। ততদিনে রাম রহিমের প্রচারের কাজ সারা।

সিরসায় এই আধ্যাত্মিক গুরুর প্রধান আশ্রমে মাটির নীচে টানেল ও বাংকার রেখে দেওয়া হয়েছে অনেক। কেন এসব দরকার? বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী খাট্টার ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সাইনি গুরুত্বই দেননি। চাপা পড়ে গিয়েছে ফাইল। এই ভদ্রলোক যে এত ঘনঘন প্যারোলে মুক্তি পাবেন, জেলে বসেই বিলাসী জীবন কাটাবেন, এটাও কি বলে দিতে হবে? আইন সত্যি সত্যিই সবার জন্য এক নয়।

রাম রহিম নিজে ক্লাস টেনে লেখাপড়া ছেড়ে সংসারী হয়ে গিয়েছিলেন। বিয়ে করেন হরজিৎ কাউরকে। ভদ্রমহিলা আড়ালেই থাকেন। এবার রাম রহিমের অনুপস্থিতিতে কে চালাবে তাঁর ডেরা? দুই মহিলার লেগেছে দ্বন্দ্ব। রাম রহিমের পালিতা কন্যা হানিপ্রীত ও ডেরা চেয়ারপার্সন বিপাসনা ইনসানের। হানিপ্রীতকে নিয়ে আবার প্রচুর জল্পনা। নিজের সন্তানরা থাকতে হঠাৎ পালিতা কন্যা নেওয়ার দরকার হল কেন রাম রহিমের, প্রশ্নটা বারবার ওঠে।

এখন যে এতবার তিনি জেলে যান, প্যারোল পান– সব সময় পাশে থাকেন হানিপ্রীত। লোকে নানা কথা বলে। ওঁরা পাত্তা দেন না। তবে এটুকু জেনে রাখা ভালো, রাম রহিম গ্রেপ্তার হওয়ার সময় তাঁর ‘ফেভারিট অ্যাঞ্জেল’ ৩৬ দিন উধাও ছিলেন। অভিযোগ ছিল, তিনি দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করছেন রাম রহিমের ভক্তদের প্রভাবিত করে।

বাস্তব সত্য হল, বহু বছর ধরে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে এমন সাধুবাবাদের সংখ্যা প্রচুর। ভক্তও অসংখ্য। তথাকথিত বাবাদের ভক্তরা মানবেনই না, এঁরা ধর্ষক। বরং সাংবাদিকদের ধরে পেটাবেন। কংগ্রেস, বিজেপি, এসপি– সব পার্টি এঁদের ব্যাপারে নীরব থাকে। ভোটব্যাংকের কথা ভেবে।

বহু আলোচিত আসারাম বাপুই যেমন। ২০১৩ সালে তিনি এক ষোড়শীকে ধর্ষণ করেন। খবর বেরোনোর পর সাংবাদিকদের বেধড়ক মার জোটে। আসারামের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ ছিল নানারকমের। শেষপর্যন্ত জেল হয়।

আর একজন তামিলনাডুর নিত্যানন্দ। বিশাল অর্থ, সম্পত্তির মালিক ২০১৯ সাল থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রেপ্তারের ভয়ে। বেপাত্তা। দীক্ষা নিতে ধর্ষিতা হন বহু মহিলা। তামিল অভিনেত্রী রঞ্জিতার সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় দেখা যায় তাঁকে। সে ছবি ভাইরালও হয়ে যায় পুরো দক্ষিণ ভারতে।

তাঁকে গ্রেপ্তার করা অনিবার্য ছিল। হঠাৎ গুজরাট পুলিশ বিবৃতিতে জানায়, নিত্যানন্দ বিদেশে পালিয়েছেন। তখন শোনা যায়, ইকুয়েডরে থাকবেন ভেবেছিলেন ওখানে ভারতের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই বলে। সেখানে গিয়েও তিনি ঢুকতে পারেননি। অনেক পুলিশ অফিসারই বলেন, নিত্যানন্দ ভারতেই আছেন। এবং ক্ষমতাবান নেতাদের সাহায্যে।

তালিকা বানাতে বসলে দেশে এমন প্রচুর অসৎ সাধু মিলবে, যাঁরা রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগসাজশে অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন।

ওডিশায় ছিলেন ভারতী কৃষ্ণ তীর্থ। অনেককে ধর্ষণের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। অকথ্য গালাগাল দিতেন। তাতেও ভক্তরা তাঁকে ভগবান মানত। সাতের দশকে বীরেন্দ্র দীক্ষিত নামে এক সাধুর আশ্রম ছিল বিহারে। তাঁকে নিয়েও ছিল প্রচুর অভিযোগ।

ইন্দিরা গান্ধির গুরু ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীকে ঘিরেও ছিল অশেষ কৌতূহল, সীমাহীন বিতর্ক। বাড়তি ক্ষমতা পেয়ে এঁরা অজস্র নারী-পুরুষকে ভাতে মারেন। রোজগার করেন বিশাল। তারপর হারিয়েও যান। এখন যেমন লোকে জানে না, মৈথিল ব্রাহ্মণ ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীর গুরুগ্রাম, জম্মু, কাটরা, মানতালাইয়ের বড় বড় আশ্রমগুলোতে কী হয়। কে চালায়।

এসব ইতিহাস আরও একবার বলে দিয়ে যায়, ভারতের আইন সবার জন্য সমান নয়।

সুপ্রিম কোর্ট চত্বরের ন্যায়ের দেবীর নতুন প্রতিমূর্তি, তুমি কী বলো?



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *