রণহুংকারের আবহে ভারতীয় উপমহাদেশে আরও একটি ইঙ্গিতপূর্ণ কাণ্ড ঘটে গেল সন্তর্পণে। বিশ্বের চোখ যখন ভারত-পাকিস্তানের সংঘাতের দিকে, তখনই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়ে গেল আওয়ামী লিগের সমস্ত তৎপরতা। জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র ও ইসলাম ধর্মের নাম নিয়ে সক্রিয় মৌলবাদী নেতাদের ইচ্ছাপূরণ হল। তাঁরা কার্যত চাপ দিয়ে ইউনূস সরকারকে বাধ্য করলেন এই সিদ্ধান্ত নিতে। পড়শি দুই দেশের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই খবরটি তেমন গুরুত্বই পেল না।
অথচ আওয়ামী লিগের ওপর নিষেধাজ্ঞা উপমহাদেশের ভূ-রাজনীতিতে নিঃশব্দে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা। যার প্রভাব শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা উপমহাদেশে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। যদি না জুলাই অভ্যুত্থানের মোকাবিলা করার মতো আরও একটি শক্তি জন্ম নেয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লিগ গণতন্ত্রকে পদদলিত করার দিকে চলে গিয়েছিল বটে। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঝোঁক তৈরিও হয়েছিল।
কিন্তু এতে তো কোনও সন্দেহ নেই যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধ্বজা তুলে একসময় আওয়ামী লিগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সেই দলের নেতৃত্বে বিখ্যাত ছয় দফা দাবিসনদ অবিভক্ত পাকিস্তান জমানাতেও ছিল গণতন্ত্রের ঐতিহাসিক দলিল। যার ভিত্তিতে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বীজ রোপণ করে পরিচর্যা চলেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। তারপর বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম থেকে শুরু করে স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠা, ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্তত সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে ও মৌলবাদের বিরোধিতায় সক্রিয় ভূমিকা ছিল দলটির।
আওয়ামী লিগকে নিষিদ্ধ করার দাবি ও তার বাস্তবায়নকে এই নিরিখে বিচার করা প্রয়োজন। দলটিকে ফ্যাসিবাদী অজুহাতে নিষিদ্ধ করা হল। তবে সেটাই সব কারণ নয়। ফ্যাসিবাদী তকমাটি দিয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িতরা এবং তাদের সমর্থনে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন উপদেষ্টাদের সরকার। যে সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে। একবার দেখে নেওয়া যাক, সরকারকে চাপ দিয়ে এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করার পিছনে কী কী কারণ থাকতে পারে।
প্রথমত, আওয়ামী লিগের প্রতি এখনও বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে টিকে থাকা সমর্থন। শুধু ধান্দাবাজ, দালাল, পরজীবী কিছু নেতা-কর্মী নয়, দেশটার আমজনতার মধ্যে এখনও দলটাকে নিয়ে আবেগ কম নয়। তাছাড়া যাঁরা আওয়ামী লিগের কর্মকাণ্ডে বীতশ্রদ্ধ, ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরাও ছাত্র জনতা নামের আড়ালে অগণতন্ত্রী কার্যকলাপ, দেশজুড়ে অরাজকতা পরিস্থিতি, তা ঠেকাতে সরকারের ব্যর্থতা শুধু নয়, অনিচ্ছা প্রকট হয়ে ওঠায় নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছেন।
দ্বিতীয়ত, যত দোষ ও অন্যায়ই নেতারা করে থাকুন, আওয়ামি লিগ টিকে থাকার অর্থ গণতন্ত্রের বীজ বাংলাদেশের মাটিতে থেকে যাওয়া। ভারতের সঙ্গে সহাবস্থানের পরিবেশ অক্ষুণ্ণ থাকা। ধর্মনিরপেক্ষতার আবহ কিছুটা হলেও প্রাসঙ্গিক থেকে যাওয়া। মৌলবাদী শক্তি এসবের ঘোর বিরোধী। মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রের বদলে শরিয়ত রাজনীতিতে দেশকে পরিচালনার মনোভাব যাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময়েও বজায় ছিল। তাদের সেই লক্ষ্যপূরণে বাধা একমাত্র আওয়ামী লিগ।
তৃতীয়ত, জুলাই অভ্যুত্থানকারী শক্তি ভোটে জেতার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী নয়। সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট হলে আওয়ামী লিগ আবার ক্ষমতায় চলে আসতে পারে বলে তাদের মনে ভয় আছে। প্রথমদিকে দলটিকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টির (বিএনপি) আপত্তি থাকলেও শেষপর্যন্ত সরকারের সিদ্ধান্তকে তাদের স্বাগত জানানোর পিছনেও আছে সেই একই ভয়।
চতুর্থত, ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি, সহাবস্থানের পরিবেশকে স্থায়ীভাবে বিনষ্ট করাও অন্যতম উদ্দেশ্য। যদিও সমর্থনের ভিত্তি ভালো থাকলেও আওয়ামী লিগ জিতে যাবে- এমন কথা হলফ করে বলা যায় না। সেই ভয়ে আওয়ামী লিগের কফিনে পেরেক পোঁতার এমন প্রয়াস। যদিও নিষিদ্ধ করলেই মানুষের মন থেকে কোনও শক্তিকে আমূল উৎখাত সম্ভব নয়। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসকে নিষিদ্ধ করার ফল ভুগেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার।