- চিরদীপা বিশ্বাস
‘ওহ দো দিনমে সিখ লিয়া থা, পর ম্যায় তো…’
‘আপ পাঁচ দিনমে সিখেঙ্গে, কেয়া দিক্কত, কম্পিটিশন করনা হ্যায় তো খুদসে করিয়ে না…খুদকো ব্যহতর বনানা হ্যায় তো দুসরোসে কেয়া মতলব!’
কথাটার অর্থ প্রথমবারে বুঝতে পারিনি। আর ভিনরাজ্যের প্রত্যন্ত এক গ্রামে বসে কারও মুখে এধরনের কোনও কথা শুনব, সে আশাও কোনওদিনও করিনি। তাই শব্দগুলো কানে একটু বেশিই লেগেছিল হয়তো, তবে শিখিয়েছিল অনেকটা। অপরের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই নিজের দক্ষতাগুলি। ‘আমি অমুকের মতো করে কেন পারছি না?’ এই প্রশ্নের ঘায়ে নিজেই নিজেকে হতাশার গভীরে ঠেলে দিই, ভুলে যাই পুরোনো সফলতার মাইলফলক। তবে অদ্ভুতভাবে আশা করি পুরো দুনিয়া তা উদযাপন করবে সমারোহে।
দীর্ঘদিনের ক্লাসরুমের আবদ্ধতায় অভ্যাসবশত আমরা সত্যিই নিজেদের একই ট্যাগ লাগানো ইঁদুর ঠাওরে ফেলি। সহজ-সরল, আপাতদৃষ্টিতে প্রথাগত শিক্ষার আলোয় আলোকিত নয় এরকম বহু মানুষ আমাদের জীবনযাপনের এমন সব মন্ত্র শিখিয়ে যান অনায়াসে, যা লাখ টাকা খরচ করেও কোথাও কোনও বইয়ের পাতায় পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমরা সেই শিক্ষার কদর করি না। নিজেকে সফলতার শীর্ষে দেখতে চাইলে ‘অন্যের সঙ্গে তুলনা করে কী হবে’ এই সহজ কথাটা, সত্যিই আমরা বুঝতে চাই না। আমরা ভুলে যাই, মিনিটখানেকের জন্য দাঁড়িয়ে, পেছনে ঘুরে, নিজের পুরোনো আমিকে এক ঝলক দেখতে এবং প্রশ্ন করতে ‘পুরোনো আমিটার থেকে বর্তমানের আমি কিছুই কি উন্নতি করিনি?’
এই প্রশ্ন করার দক্ষতা, বাঁধাধরা সিলেবাস আর ক্লাস-রুটিনের ছকের মধ্যিখানে বসে অর্জন করা বেশ দুষ্কর। এসব শিখতে হলে মুখোমুখি হতে হয় কঠিন পরিস্থিতির। যেমন, বাসে করে মিনিট দশেক চললে পড়ে গা গুলিয়ে ওঠা ছেলেটা যখন বাধ্য হয়ে ঘণ্টা দশেকের বাসজার্নি করে ফেলে নির্ঝঞ্ঝাটে, তখন এক অসীম আত্মবিশ্বাসে বুক ভরে ওঠে তার। কিংবা, অচেনা নম্বর দেখলে সটানে মোবাইল উলটে রেখে পালিয়ে যাওয়া ইন্ট্রোভার্ট মেয়েটি যখন দাপিয়ে বেড়ায় অজানা শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত, একদল অচেনা পথচারীকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে করতে পৌঁছে যায় গন্তব্যে, সেখানে পৌঁছে অপরিচিত মুখের ভিড়ে আত্মবিশ্বাস না খুইয়ে অনাবিল আনন্দে শেখাতে থাকে এমন কিছু যা তার নিজের কাছেও দু’দিন আগে পর্যন্ত অজানা ছিল; তখন তার অনুভূতিটা ঠিক কীরকম হতে পারে তা ওই ক্লাসরুমবন্দি ইঁদুরেরা আন্দাজ করতে পারবে না। আবার ‘এসব ছুটকো ঘটনা’ বলে নাক সিটকানো সবজান্তারাও বুঝতে পারবে না, যে এই ‘ছুটকো ঘটনা’গুলোই পুরোনো আমি থেকে নতুন আমিতে উত্তরণের এক-একটা ধাপ।
তাই অন্যের দিকে না তাকিয়ে, প্রতিনিয়ত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নম্বর দেওয়া দরকার। নিজের মধ্যে কী কী বদল আমি দেখতে চাই, সেজন্য কীভাবে আমি কাজ করছি এবং অবশ্যই আমি কেন সেটা চাইছি তার উত্তরও নিজের কাছে থাকা ভীষণই জরুরি। জীবনের একটা সময় পর্যন্ত নানা স্তরে নানা শিক্ষক যেভাবে আমাদের গ্রেড কার্ড সাজায়, একটা সময় সেই গ্রেড কার্ডে নম্বর দেওয়ার ভার নিজের হাতে তুলে নিতে হয়, আর নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে বলে যেতে হয় ‘আই অ্যাম রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ’।
(লেখক কোচবিহারের ভূমিকন্যা। পূর্ণিয়াতে গান্ধি ফেলো হিসেবে কর্মরত।)