- অর্ক ভাদুড়ি
বহু শতক আগেই আমরা জেনে গিয়েছি, এই দেশ স্বপ্ন দিয়ে তৈরি নয়। বরং তার সত্তার গহনে দুঃস্বপ্নের নিয়ত আনাগোনা৷ এই দেশ স্মৃতির চাদরে মোড়া ঠিকই- মাড়ি ও মড়কের স্মৃতি, মন্বন্তর ও গণহত্যার স্মৃতি৷ ভিটেছাড়া মানুষের যোজন যোজন ব্যপ্ত মহামিছিলের পা থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা এই মাটির শরীরে যে চিরন্তন আলপনা এঁকে দিয়েছে, তার স্মৃতি বাঙালির মনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জিইয়ে রাখে ভয়। দুঃসহ খরায় ফুটিফাটা মাটির মতো পদতল এই দেশের, তার শরীরময় দগদগে ক্ষত, কপালে কুঞ্চন- এই বুঝি চাল শেষ হয়ে এল। ছেলেমেয়েগুলো খাবে কী আগামীকাল? গেরস্ত কপালের ভাঁজ এই বঙ্গভূমির চিরকালীন মানচিত্র৷ অন্নচিন্তা থেকে বাঙালির মুক্তি নেই, মুক্তি ছিল না কোনওদিন।
ফুটন্ত চালের গন্ধের থেকে সুন্দর আর কী আছে এই ধরাধামে? ছেলেমেয়েদের পাতে উপচে পড়বে ভাত, উনুনে উথলে উঠবে দুধ। গোয়ালে গোরু ডাকবে। উঠোন পেরিয়ে দাঁড়ালে যেদিকে দু’চোখ যায়- ধান আর ধান। তারা দোল খাচ্ছে খাওয়ায়, কেঁপে উঠছে অনাগত ভাতের জন্মসম্ভাবনার কথা ভেবে। খুব বড় কিছু নয়, শুধু এইটুকু চেয়েছি আমরা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চেয়েছি প্রাণপণ। প্রার্থনা করেছি রাজারাজড়া ও ব্যক্তিগত ঈশ্বরের কাছে। অনিঃশেষ ভাতের হাঁড়ি আমরস কখনও পাইনি, তবু একদিন যে পাব, তা নিশ্চিত করে জানি। আমি না পাই, আমার সন্ততি পাবে, অথবা আরও দূরবর্তী কোনও বঙ্গভাষী স্বজন আমার। তাই তো বেঁচে থাকা। তাই তো নতুন বছর এলে তাকে পরম আদরে কোলে নিয়ে, চুমু দিয়ে তুলে রাখা পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারীদের যত্নে সাজানো কুলুঙ্গিতে। জানি, এই বছরটিও হয়তো তার পূর্বসূরিদের মতোই মিথ্যেবাদী ও প্রবঞ্চক। তাদের মতোই ক্রুর ও খল। কিন্তু আমরা যে অনন্ত আশাবাদী৷ বুকভরা আশা আর চোখভরা স্বপ্ন বাদে এই জাতির আর কী বা আছে?
ভাতের স্বপ্নে ভর দিয়ে আমাদের হেঁটে চলা শতকের পর শতক। এই হাঁটার শুরু নেই, শেষ নেই৷ আদি নেই, অন্ত নেই। আছে শুধু প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে নতুন করে চেনা৷ আমরা মাৎস্যন্যায় জানি। জানি মহারাজাধিরাজ গোপালের নাম। জানি শশাঙ্কের গৌড়। জানি সমৃদ্ধির আলোয় আলোকিত বাংলা সুলতানি। অথচ অন্নকষ্ট ঘোচে না কখনও। ভয় কাটে না। ওই তো ঈশ্বরী পাটনি উঠে বসলেন নৌকায়। ফুল্লরা আর কালকেতু সংসার পাতল। সেই সংসার যেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। অপারেশন সার্চলাইটে ঝলসে যাওয়া চোখ থেকে যে রক্ত পড়ে, তার স্রোত গিয়ে মেশে বুড়িগঙ্গায়৷ তবুও আমরা বেঁচে থাকি। আমরা কখনও মরিনি৷ কখনও মরি না৷ আমাদের আঙুল কেটে নিয়েছে নীলকর সাহেবের দল, আমাদের বিদ্রোহীরা ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে বুলেটে, তবুও আমরা বেঁচে থেকেছি প্রাণপণ। পলাশির ময়দানে যে সূর্য অস্ত গিয়েছিল, তাকে বেনিয়ানের তলায় লুকিয়ে রেখে কলকাতা আর ঢাকা শাসন করেছে অগ্নিযুগের ধুতি পরা তরুণের দল। তারা ফাঁসিতে ঝুলেছে, তবু সেই সূর্য সমর্পণ করেনি কারও হাতে। রডা কোম্পানির অস্ত্রগুলিকে ঘষেমেজে সাজিয়ে দিয়েছেন সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহীরা, তাদের কপালে জয়তিলক এঁকে দিয়েছেন দেবী অন্নপূর্ণা। আমরা ‘ফ্যান দাও’ বলে ঘুরে মরেছি মহানগরের পথে। আমাদের তখন মরা মরা চোখ, কঙ্কালসার দেহ। সেই বছরও নবান্ন এসেছিল পরম অশ্লীলতায়। আমরা সহ্য করেছি সব, শুধু বেঁচে থাকব বলে। আমরা বেঁচে আছি৷ বাঁচব আরও সহস্র সহস্র বছর।
সহস্রাব্দ আসে, চলে যায়৷ প্রতিটি নবান্নের কপালে একটি বছর পেরিয়ে আসার দাগ৷ এক বছরের গ্লানি, মৃত্যু, আঘাত ও পরাজয়ের টিকা। এত ক্ষয়, এত দুঃখ, এত পরাজয়ের পরেও এই অনিঃশেষ বেঁচে থাকা, এই নাছোড় বাঁচিয়ে রাখার অবিশ্বাস্য স্পর্ধা- এটুকুই এই জনপদের সর্বোচ্চ অর্জন৷ আমার মাথায় হিমালয়ের মুকুট, আমার পা ধুইয়ে দেয় বঙ্গোপসাগর- আমি কি এত সহজে হারতে পারি?
কলকাতার ওয়েলিংটন মোড়ের নাম এখন সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার। কয়েক পা হাঁটলেই সন্তোষ মিত্রের বাড়ি। এখন অবশ্য আর বাড়ি নয়, বাড়ির কঙ্কালটুকু রয়ে গিয়েছে। নববর্ষের প্রাক্কালে এক অলৌকিক বিকেলে সেই বাড়ির সামনে ঝড় উঠল আচমকা। ধুলো উড়ছে। ভিড় বাড়ছে ফুটপাথে। হলুদ হয়ে যাওয়া ইতিহাসের বই থেকে পৃষ্ঠাগুলি বাসাভাঙা পাখির মতো উড়তে লাগল আকাশে। মরা জ্যোতি সিনেমাকে টপকে যেতেই বৃষ্টি এল। প্রথমে টিপটিপ৷ মিনিট তিনেকে ঝমঝম৷ সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পার্ক সার্কাসের অটো। বড্ড হাওয়া৷ ছাতা উড়িয়ে নিয়ে যায়। চাঁদনি মার্কেটের ভিতরে গুমোট। বাইরে শুনসান। এই রাস্তাকে মাঝখানে রেখে খাঁড়ির মতো অসংখ্য গলি-উপগলি ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। হরেন ঘোষের টুকরো টুকরো লাশের গল্প শুনে বড় হল যে ছেলেটি, যে শুনল আমেদ খানের অলৌকিক ড্রিবল, শুনল পুড়ে যাওয়া ভিটে পূর্ব বাংলায়- সে কি এমন সন্ধ্যায় মলঙ্গা লেনের দিকে যাবে? রডা কোম্পানির বন্দুক যে গলিপথে পৌঁছে যায় বুড়িবালামে, তার খোঁজে যাওয়া যায় এমন হলুদ আলোর আল বেয়ে? চরাচরজুড়ে বৃষ্টি নামল। নাটোরের এক ছোট গ্রামে জল ঢুকছে হয়তো এখনই৷ যে গ্রামে এককালে পুজো হত মহাধুমধামে। সাড়ে সাত দশক আগের সেই পুজোর আরতির গন্ধ এসে লাগে নাকে এই বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া কলকাতায়। আমরা কোথা থেকে এসেছি এখানে? আমাদের শিকড়ে জল দেয় কোন গণহত্যার ইতিহাস?
প্রতিটি নববর্ষ আসে রামেশ্বরের লাশ ছুঁয়ে। আসে বৌবাজারের মোড়ে পাথর হয়ে থাকা লতিকা-প্রতিভা-অমিয়া ও গীতাকে ছুঁয়ে। ছুঁয়ে দেয় সাতের দশক, ৭১ সাল, তিনের দশকে জালালাবাদের লাশগুলি। ছুঁয়ে দেয় বেনিয়ান পরা ছেলেদের বেপরোয়া মৃত্যুছুট আগুনের দিকে। প্রতিটি নববর্ষের বুকে সেই মরণজয়ী সন্তানদের স্মৃতি। পকেটে পিস্তল আর দু’চোখে বাঙাল স্পর্ধা নিয়ে দীনেশ, রবি ঠাকুরের গান বুকে নিয়ে লিখতে গেল অলিন্দ রূপকথা। বিনয়, বাদল ও প্রীতিলতার দিকে তাকিয়ে থাকে প্রতিটি পয়লা বৈশাখ। কিংসফোর্ড মরেনি, তবে গুলি খেয়ে ছিটকে পড়েছে পেডি। নববর্ষের সকাল হয় বিমল দাশগুপ্তের নামে।
মেঘ ও বৃষ্টির নীচে, এই রুক্ষ ফুটপাথে বোধন হচ্ছে বাঙালির নতুন বছরের। এই আশ্চর্য জনপদ- তার অতীত ও বর্তমান, ভাঙাচোরা বাড়ি, বেদখল রাস্তা, প্যাচপেচে কাদা, কান্নায় পাথর হওয়া কৃষিজমি, টলোমলো এক পুকুর রাগ ও নিঃসীম হতাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধু আমাদের চক্ষুদ্বয় চিরতরে অন্ধ করবে বলে। কোদালিয়ার নরেন ভটচাজ একখানা ম্যাভেরিক চেয়ে চষে ফেলল তামাম দুনিয়া। ফেভারিট কেবিনের সুড়ঙ্গ বেয়ে কারা যায়- বিভি না অনুশীলন? বৃষ্টি বাড়ছে। ইতিহাসের প্রতিটি জানলাকে অন্ধ করে দেওয়া এই পাগলপারা বৃষ্টিতে ছাতা খুলে লাভ নেই। চশমাও ঝাপসা হয়ে আসে।
প্রাক নববর্ষের টলোমলো বিকেলে যারা হেঁটে যাচ্ছে বাঙালির ইতিহাসের এক অধ্যায় থেকে অন্য অধ্যায়ের দিকে, তাদের বাড়ি সতত চঞ্চলা। বাড়ি সেজে ওঠে৷ বাড়ি ভেঙে যায়। মাথার ভিতরে শুধু খেলা করে ভাঙা ভাঙা স্মৃতি- প্রজন্মের পর প্রজন্ম। যে নবান্নের কাছে আরও কখনও যাওয়ার উপায় নেই, যে পয়লা বৈশাখের চারদিকে রুক্ষ কাঁটাতার, তাদের সবার স্মৃতি বুকে নিয়ে ঘরে আসে নতুন বছর৷ এই পথচলার কোনও শেষ নেই, শুরু নেই৷ আছে শুধু হেঁটে যাওয়া- শতকের পর শতক।