নাবালিকার বিয়ে আর পাচারচক্র

নাবালিকার বিয়ে আর পাচারচক্র

ব্লগ/BLOG
Spread the love


  • ছন্দা বিশ্বাস 

দোয়েলের শিসে দিন শুরুর পরিবর্তে সেদিন কলিং বেলের শব্দে উঠে পড়ি। দরজা খুলতেই দেখি কল্পনা, আমার পরিচারিকা।

কী রে এত সকালে?

ও জানাল, কাজ সেরে ওকে একটু অঞ্চল অফিসে যেতে হবে।

মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ বিমর্ষ। কিছুদিন আগে কল্পনা মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। ফুটফুটে মেয়ে পরি আমার কাছে মাঝেমধ্যে আসত। ওদের গ্রামের স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ত। বয়স যাই হোক চেহারায় বাড়ন্ত বেশ। পড়াশোনায় ভালো। ভালো নাচতে পারে। পাড়ায় ফাংশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ওর ডাক আসে। কল্পনা খুশি হয়ে জানায় আমাকে। কিছুদিন ধরে হুজুগ তুলেছে মেয়ের বিয়ে দেবে।

অতটুকু মেয়েকে বিয়ে দিবি কেন? ওকে লেখাপড়া শেখা। আঠারোর আগে বিয়ে দেওয়া আইনবিরুদ্ধ জানিস না?

কল্পনা যুক্তি দেখায়, ‘বড্ড চিন্তা হয় গো দিদিমণি। আমি লোকের বাড়িতে কামকাজ করি, কেউ যদি ফুসলাইয়া নিয়া যায়’।

বনের ধারে বাস, ভাবনা বারো মাস। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পথ ধরে নিত্য যাতায়াত ওদের। বড় রাস্তা ধরে এলে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ। তাই সময় বাঁচাতে অধিকাংশ সময়ে বনের ভিতরের শর্টকাট রাস্তা ধরতে হয়। ‘জঙ্গলের জন্তুগুলানের থে’ দু’পেয়েদের ডর করি’।

এই ভয় শুধু অল্পবয়সিদের নয়। সাত থেকে সত্তর কেউ বাদ যায় না।

সেদিন নাকি স্কুল থেকে ফেরার পথে পরিকে টোটোচালক কী সব অশ্লীল কথাবার্তা বলেছে। কু ইঙ্গিত করেছে। পরির মতো অনেকেরই সমস্যা এটা। সেদিন সবাই নেমে গেলে ও একাই আসছিল। ভয়ের চোটে পরি গন্তব্যের আগেই টোটো থেকে নেমে যায়। পরিচিত একজনের সাইকেলে চেপে তবে ঘরে ফেরে।

পরি, কল্পনাদের এই জাতীয় সমস্যা নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। কল্পনার স্বামী তিন, চার বছর হল বাইরে আছে। করোনায় কাজ হারিয়ে ওদের গ্রামের অনেক পুরুষ এখন পরিযায়ী শ্রমিক।

সংসার চালানোর জন্যে মহিলারা নানা কাজ করছেন।

মেয়ে বড় হলে তাই মায়েদের ঘুম ছুটে যায়। কয়েকজন পরোপকারী তরুণ প্রত্যন্ত গ্রামে ঘুরে অল্পবয়সি বৌ-মেয়েদের কাজ পাইয়ে দেবার কথা বলছে। দূরে নয়, কলকাতার আশপাশে। কয়েকজনের সঙ্গে ফোনে কথাও বলিয়ে দিয়েছে। চাকরিজীবী দম্পতিদের বাচ্চা মানুষ করা, কেউ চাইছে বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখভালের জন্যে। মাইনেপত্র ভালোই দেবে। কথাও বলিয়ে দিচ্ছে।

দুই মাস আগে কল্পনার বর এসেছিল। তখনই মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে পাকা কথা বলে এসেছে। ছেলের বাড়ি পঞ্জাবে, ‘বিরাট ধনী’। এক পয়সা লাগবে না।

স্বামীর খুশিতে সেদিন কল্পনা না বলতে পারেনি।

একদিন শুনি পরির বিয়ে হয়ে গেছে।

বিয়ে দিয়ে ক’দিন বেশ মনমরা ছিল।

সেদিন বলল, মেয়েটার বহুদিন হল কোনও খবর পাচ্ছি না।

কল্পনার মন ভালো নেই বুঝতে পারি। কাজের ভিতরে কতবার যে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

আজ পরির কথা জিজ্ঞেস করতেই কেঁদে ফেলল।

ওর কথাগুলো শুনে চমকে উঠি, কী বলছিস?

হ্যাঁ গো, সত্যি।

কল্পনার বর নাকি ওর একজন পরিচিত বন্ধুর কাছে মেয়ের বিয়ের কথা বলেছিল। সে এই পাত্রের সন্ধান দেয়।

একদিন মেয়েকে মালদায় নিয়ে যায় দেখাতে। সেদিনই পাত্রপক্ষ নাকি বিয়ে করে মেয়েকে নিয়ে সোজা পঞ্জাবে চলে যায়। পরানের হাতে ত্রিশ হাজার টাকা দিয়েছে।

কল্পনা পরে জানতে পেরেছে সেদিন পরান ওর মেয়েকে দালালদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আদৌ মেয়ের বিয়ে হয়নি। এটাও মেয়ে পাচারকারীদের একটা চক্রান্ত।

ভাটিখানায় আসত ওই তরুণ দুজন। এরাই খোঁজখবর নিত কাদের ঘরে সুন্দরী মেয়ে আছে। পুরুষমানুষগুলো কে কখন কোথায় থাকে।

শহরের মেয়েদের কথা বাদ দিলে মফসসলের দিকে মেয়েদের অবস্থা বেশ খারাপ। করোনার পরে স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েছে, বাল্যবিবাহ এবং মেয়েদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামের পুরুষরা কাজ হারিয়ে ভিনদেশে পাড়ি দিয়েছে। অভিভাবকশূন্য প্রায় গ্রামগুলোতে হিংস্র হায়নারা থাবা বসিয়েছে। অল্প বয়সে বিয়ের কারণে জনন অঙ্গ পরিপুষ্ট হওয়ার আগেই মাতৃত্বের আগমন ঘটছে। এর ফলে কত মেয়ে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছে, কেউ অপুষ্ট শিশুর জন্ম দিচ্ছে। বিয়ের পরে কত মেয়ে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হচ্ছে। নয়তো নারী পাচারচক্রের নজরে পড়ে জীবন নদীর বাঁক বদল হয়ে যাচ্ছে।

প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে এবং চা বাগানের কতশত মেয়ে এভাবে নিত্য হারিয়ে যাচ্ছে।

কঠিন সংগ্রামের ভিতর দিয়ে উত্তরবঙ্গের মেয়েদের এগিয়ে যেতে হয়। পদে পদে নানা বাধা। নদী, জঙ্গলে ভরা পথ দুর্গম হয়ে পড়ে। বিপদের ঝুঁকি নিয়ে স্কুল-কলেজে যাতায়াত করতে হয়। শিক্ষিত মেয়েদের এদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ খুব কম। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হয়রানি হতে হচ্ছে। কাজে সেরে রাতে ঘরে ফিরতে কত অপ্রীতিকর ঘটনার সাক্ষী তারা।

সাধারণ ঘরের মেয়েদের এই গল্প প্রতিনিয়ত রচিত হচ্ছে।

মেয়েদের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্যে নানা প্রকল্প, আইন, প্রস্তাবনা আনা হয়েছে। সেগুলো কার্যকরী হয়েছে কি না, কতটুকু পাচ্ছে সেটাও দেখা দরকার। শুধু খাতায়-কলমে থাকলে চলবে না। নারী-পুরুষের সমতা অর্থাৎ লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে হবে।

মেয়েদের জীবনচক্রের তিনটি ধাপ হল- শৈশব, বয়ঃসন্ধি এবং প্রজননকাল। এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ  সময়ে তাদের প্রতি যত্নবান হওয়া দরকার। এতদিন যে বিধাতাকে কৃপণ মনে হয়েছিল সেটা যে সত্য নয়, সেই বিশ্বাসটুকু পেতে কেবলমাত্র সরকারি সাহায্যই যথেষ্ট নয়, সাধারণ মানুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

সামান্য মেয়েরাই অসামান্যা হতে পারে একপশলা বৃষ্টি পেলে।

পরিশেষে একটা কথা বলা দরকার, মেয়েদের সার্বিক উন্নতির জন্যে ছেলেদের উপযুক্ত শিক্ষা ও কর্মসংস্থান জরুরি। এই দুইয়ের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মেয়েদের পাশে দাঁড়াবে ছেলেরা, দুটিতে মিলে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঠেলে বলবে,- ‘কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয়, তুমি আছ, আমি আছি।/পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,/মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ, আমি আছি।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *