নাকে খত আমলাদের, মেধা পচে ‘মধুভাণ্ডে’

নাকে খত আমলাদের, মেধা পচে ‘মধুভাণ্ডে’

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


গৌতম সরকার

বিজেপি ক্ষমতায় এলে নাকি জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের বিডিওকে দলের কোন মণ্ডল সভাপতির পায়ের তলায় বসে থাকতে হবে। হুমকিটা দিয়ে রাখলেন বাপি গোস্বামী। জলপাইগুড়ির বিজেপি নেতা। তৃণমূলের বিরুদ্ধে আমলাকুলকে দলদাসে পরিণত করে রাখার অভিযোগটা তোলে বিজেপিই। শাসনদণ্ড হাতে পেলে বাংলায় তাঁরা যে একই পথে হাঁটবেন, তারই আভাস দিলেন বাপি।

রাজনৈতিক নেতাদের মুখঝামটা, এমনকি লাথি-ঝাঁটা খাওয়ার উদাহরণ কম নেই অফিসারদের। বেচারা আইএএস, আইপিএস আধিকারিকরা। যাঁরা একেকজন পড়াশোনায় উজ্জ্বল নক্ষত্র। সর্বভারতীয় কঠিন পরীক্ষায় উতরে প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়েছেন। সেই তাঁরাই কি না ক্ষমতাসীন দলের তল্পিবাহক। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ সত্ত্বেও চার অফিসারকে সাসপেন্ড না করাটা তৃণমূলের অ্যাজেন্ডা। সেই অ্যাজেন্ডা পূরণে কমিশনের সঙ্গে সংঘাতে যেতে বাধ্য করা হল রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থকে।

নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ আছে। কিছু কিছু অভিযোগ অমূলক নয় বলেই মনে হয়। কিন্তু কমিশন তো সাংবিধানিক সংস্থা। তার নির্দেশ অমান্য করলে সাংবিধানিক পরিকাঠামোটিই যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। রাজনৈতিক দল যা খুশি বলতে পারে। কিন্তু আমলারা সংবিধানের বিধি ব্যবস্থায় চলতে আইনত বাধ্য যে। মনোজ পন্থ সুভদ্র, অমায়িক। যাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার প্রশংসা করে থাকেন বিরোধী দলের নেতা অধীর চৌধুরীও।

পন্থের মতো মেধাবী অফিসারকুলের সরকারি দলের এই দাসত্ব আখেরে তাঁদের শিক্ষার প্রতিই অবিচার! সাংবাদিকতায় জীবনের ৩৬টি শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম কাটিয়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, নাকে খত দিয়ে চলার পিছনে থাকে মতলব। আমলাকুলের মেরুদণ্ডটা সোজা থাকলে উত্তরবঙ্গে জমি, বালি-পাথর, কয়লার কারবার, গবাদিপশু পাচার, বন ধ্বংস করে বেআইনি রিসর্ট, চা বাগানের জমির বাণিজ্যিক ব্যবহার ইত্যাদি সম্ভবই হত না।

সেদিন অনুসন্ধিৎসু এক সাংবাদিকের মুখে শুনলাম, একটি বেআইনি রিসর্ট নিয়ে খোঁজখবর করতে যাওয়ায় একজন জেলা শাসক তাঁকে বলেছেন, তাঁর ওপরের অনেকে সেটিং হয়ে আছেন। তাঁর আর কিছু করার নেই। এরপর কি আর আইএএস, আইপিএস, ডব্লিউবিসিএসদের ওপর সম্ভ্রম থাকে? মেরুদণ্ডটা সোজা নেই বলেই শুধু শাসকদল নয়, বিরোধীরাও এত শিক্ষিত মানুষগুলিকে নির্দ্বিধায় গাল দিতে পারে, হেনস্তা করতে পারে।

রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ ভার্মার নামের সঙ্গে বরাহনন্দন শব্দটি কী অবলীলায় জুড়ে দিতে পারেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বাপি চৌধুরী তো শুভেন্দুদের রাজনীতিরই ছাত্র। শুধু অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে নয়, বিচার ব্যবস্থাতেও ঘুণ ধরার হাজার উদাহরণ। প্রশাসনিক কোনও আধিকারিক কিংবা বিচারপতির ইচ্ছা করলে রাজনীতিতে যাওয়ার অধিকার নিশ্চিত আছে ভারতীয় গণতন্ত্রে। কিন্তু রাজনীতিতে যাওয়ার সঙ্গে স্ব স্ব ক্ষেত্রে কার্যকালের পদক্ষেপগুলির যোগসূত্র যদি স্পষ্ট হয়ে যায়?

‘ভগবান’ বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় একটি দলের সাংসদ হওয়ার জন্য চাকরি থেকে ইস্তফা দিলে কি আর নিজের উদ্দেশ্য আড়াল করতে পারেন? প্রধান বিচারপতির কার্যকাল শেষে তাঁকে সংসদ সদস্য মনোনয়নে সরকারের ইচ্ছায় সায় দেওয়ায় দায়িত্বে থাকাকালে রঞ্জন গগৈয়ের রায়গুলি কাঁটাছেঁড়ার আতশকাচের তলায় চলে আসে বৈকি। আইপিএসের দায়িত্ব ছেড়ে হুমায়ুন কবীরের মন্ত্রিত্ব, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলের প্রার্থী হওয়া কিংবা ডব্লিউপিএস জেমস কুজুরের মন্ত্রী হওয়া- উদাহরণ অনেক।

আবার দলীয় অ্যাজেন্ডা পূরণের কাজটা ভালোভাবে করার পুরস্কার হিসেবে এতজন আইএএস, আইপিএস অবসরের পর রাজ্যের উপদেষ্টা হয়ে গেলেন যে, সংখ্যাটা গুনে বলতে হয়। সংবিধান অনুযায়ী যাঁদের নিরপেক্ষভাবে প্রশাসন চালানোর কথা, দলদাস তকমাটা শুনলে তাঁদের নিজের প্রতি লজ্জা, ঘৃণা হয় কি না জানতে ইচ্ছা করে। বলা হয়, চাপ থাকে, চাপ। সরকার, ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছায় না চললে গ্যারেজ পোস্টিং। যাকে পানিশমেন্ট পোস্টিংও বলা হয়।

কম গুরুত্বের পদে বা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ব্রিটিশের কালাপানিতে নির্বাসন দেওয়ার মতো কোনও এলাকায় বদলি সেইসব শাস্তির রকমফের। আরও আছে- কম্পালসারি পোস্টিং। কোনও দায়িত্ব না দিয়ে বসিয়ে রাখা। একজন উচ্চশিক্ষিতের পক্ষে এর চেয়ে ভয়ানক শাস্তি আর কী হতে পারে! তাঁর মেধাকে অসম্মানও বটে। বিরোধীদের মুখোমুখি হতে চান না অফিসাররা। পাছে অসত্যের পক্ষে যুক্তি সাজানো তো কঠিন হয়ে যায়, অথবা বিরোধীদের কথা শুনলে শাসক রুষ্ট হয়। শাসকদলের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর কাছ থেকেও পালিয়ে বেড়ান আমলারা। শিলিগুড়ির অদূরে ফাঁসিদেওয়ার একটি গ্রাম পঞ্চায়েতে দলীয় প্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছে তৃণমূলের একাংশ। সেই প্রধানকে অপসারণের বৈঠক ডাকছেন না বিডিও। অনাস্থার প্রস্তাবকরা তৃণমূলের সদস্য হলেও তাঁদের সঙ্গে দেখাই করছেন না তিনি। ওই সদস্যরা তাঁর অফিসে গেলে বিডিও অন্যত্র ‘ব্যস্ত’ হয়ে পড়ছেন। শাসককে আইন মনে করিয়ে দেওয়ার সাহসটুকু খুইয়ে ফেলেছেন অধিকাংশ আমলা।

সরকারের পরিচালক দলের হতে পারে, কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী প্রশাসনের রাজনৈতিক রং থাকতে পারে না। সহজ এই সত্যটি ভুলে যাওয়ার ফলে মেধাকে জলাঞ্জলি দিয়ে মেরুদণ্ড বিকোনো আমলাকুলকে কবজা করছে শাসকদল। বিরোধীরাও যা নয়, তাই বলে গাল দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। যেমন, আলিপুরদুয়ার জেলায় কর্মরত অবস্থায় তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে তিনি বালির বেআইনি কারবারে যুক্ত ছিলেন বলে জলপাইগুড়ি সদরের বিডিও’র বিরুদ্ধে নির্দ্বিধায় অভিযোগ করতে পারলেন বিজেপি নেতা বাপি।

এমন নয় যে, শুধু তৃণমূল জমানায় প্রশাসন দলদাস হয়ে আছে। বাম রাজত্বে একই অভিযোগ ছিল। এখন বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাংলার এই ছবির রেপ্লিকা দেখা যায়। শুধু এই ভূমিকায় আমলাদের শিক্ষার অমর্যাদা দেখে লজ্জায়, ঘৃণায় অধোবদন হয়ে যেতে হয় আমাদের।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *