যাঁকে বীরের সম্মান দিয়ে বাংলায় হাজির করানোর কথা ঘোষণা করেছিলেন খোদ দলের সুপ্রিমো, তাঁরই কী অবস্থা! সিংহ মূষিক হয়েছেন। এই তো সেদিনও তার প্রশংসায় নেত্রী ছিলেন পঞ্চমুখ, তাঁর এমন অধোগমন কেন, কে বলতে পারে। প্রকাশ্যে দলের কেউ কারণটা জানাননি, তা নিয়ে কথাও হচ্ছে কম নয়। কেউ বলছে দলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের নাপসন্দ ছিলেন তিনি, কারও মতে তাঁর দাদাগিরিতে দলেই ছিল তীব্র আপত্তি। তাই বীরের সম্মান নিয়ে ঘোরাফেরাটা আপাতত বন্ধ। তিনি আর একচ্ছত্র নন, ন’জনের একজন।
বুঝতেই পারছেন বলছি কেষ্টর কথা। অনুব্রতই মণ্ডল এই নামেই বেশি পরিচিত। দলনেত্রীও তাঁকে ডাকেন এই নামেই। দু’বছর জেলে ছিলেন তিনি গোরু পাচারের দায়ে। জেলে থাকার সময়ই সভায় সভায় নেত্রী বলতেন তাঁকে বীরের সম্মান দেওয়ার কথা। একসময় দিল্লির জেল থেকে জামিনে বাড়ি ফিরেছেন বটে অনুব্রত, তাঁর সমর্থকরা পুষ্পবৃষ্টিও করেছেন, তিনি আর সমর্থকরা কেঁদেছেন, সবই হয়েছে কিন্তু কোথাও একটা তাল কেটেছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তিনি নিজগৃহে ফেরার কয়েকদিনের মধ্যে মমতা বীরভূমে গিয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে গীতাঞ্জলি প্রেক্ষাগৃহে প্রশাসনিক বৈঠক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই মঞ্চ থেকে একবারের জন্যও মুখে আনেননি কেষ্টর নাম।
তার আগে বীরভূমে গেলে প্রতি সভায় মমতা নিয়ম করে বীরভূমের এই বীরের কথা বলেছেন। বলেছেন, চক্রান্ত চলছে। কেষ্টকে কতদিন ধরে জেলে ভরে রেখেছে। কিন্তু মানুষের মন থেকে ওকে দূর করতে পারেনি। অনুব্রতর বিরুদ্ধে যদি কোনও অভিযোগ থাকেও, বিজেপির বহু নেতার বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? আজ পর্যন্ত একটা ব্যাপারেও ব্যবস্থা নিয়েছেন? ভরা নেতাজি ইন্ডোরের সভায় তিনি বলেছিলেন, অনুব্রত জেল থেকে বেরোলে তাঁকে বীরের সম্মান দেওয়া হবে।
কেষ্ট জেল থেকে বেরোনোর পর উলটে তাঁর জেলা সভাপতির পদটাই তিনি খুইয়েছেন। অথচ যে দু’বছর তিনি জেলে ছিলেন, সেই সময়ে কেষ্টই ছিলেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি। তাঁর সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মমতা নিজে। বীরভূমের দলের মধ্যেকার গোলমালে তিনি যে কেষ্টকে এগিয়ে রাখছেন তা খোলাখুলি বুঝিয়ে দিতেন তিনি। অনুব্রত মণ্ডল দলের সংগঠনের ওলটপালটে আর সভাপতি নেই। ওই পদই তুলে দিয়েছে তৃণমূল। দলের স্পষ্ট নির্দেশ, জেলায় সাংগঠনিক কাজকর্ম দেখবে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গড়ে দেওয়া কোর কমিটিই।
শুক্রবারের সেই নির্দেশের পরেই রবিবার কোর কমিটির বৈঠক ডেকেছিলেন জেলায় দলের চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার সেই বৈঠকের মাঝেই এসেছে দিদির ফোন। সেই ফোনে কেষ্টর সঙ্গে সভানেত্রীর কী কথা হয়েছে কে জানে। দেখা গেল নিজে থেকে অনুব্রত জেলায় যে তিনটি কর্মসূচি নিয়েছিলেন তা এ যাত্রায় রক্ষে পেলেও এখন থেকে কোর কমিটিতে ঠিক না করে আলাদা করে কেউ কোনও কর্মসূচি নিতে পারবেন না। কার্যত কেষ্টর মাথায় বসানো আশিসবাবু জানিয়েছেন, এবার থেকে কোর কমিটির বৈঠক হবে মাসে দু’বার।
ঘটনা হল, গত দেড় মাস বীরভূমে তৃণমূলের কোর কমিটির বৈঠক হয়নি। তা নিয়ে কোর কমিটির সদস্যদের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল। প্রকাশ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ উগরেও দিয়েছিলেন কট্টর অনুব্রত-বিরোধী বলে সর্বত্র পরিচিত কাজল শেখ। তারই মধ্যে কেষ্টর চেয়ার কেড়ে নেওয়ায় তা নিয়ে জল্পনাও কম নয়। আবার যে সময়টা কেষ্ট জেলে ছিলেন সেই সময় পঞ্চায়েত আর লোকসভার ভোটে দল ভালো ফল করেছে। জেলায় খুনখারাবি, মারদাঙ্গা কমে গিয়েছে। অতএব অনুব্রত ছাড়া বীরভূমের তৃণমূলের কোনও গতি নেই এই ধারণাটাও আর টিকছে না। তাই কেষ্টকে সরিয়ে দেওয়া যায় পদে থেকে। তাই তাঁকে কোর কমিটির ন’জনের একজন করে দেওয়া যায় অনায়াসেই। কেষ্ট আর বীরভূমের একচ্ছত্র নন। তিনি জেল থেকে বেরোনোর পর তাঁর অনুগামীরা অফিসে চড়াও হয়ে অন্য নেতাদের ছবি সরিয়েছেন। কেষ্ট-কাজলের লড়াইয়ে তেমন ভাটাও পড়েনি।
অনুব্রত মণ্ডল কবে থেকে বীরভূমে তৃণমূলের জেলা সভাপতি পদে রয়েছেন, জেলায় দলের পুরোনো নেতারাও তা মনে করে বলতে পারছেন না৷ তৃণমূলের অনেক নেতার উত্থানপতন ঘটেছে৷ কিন্তু ভালো-মন্দ কোনও সময়ই আঁচ পড়েনি কেষ্টর গায়ে৷ কেননা কেষ্টকে পাস দিদি হ্যাঁয়। সেই দিদি কি এবার ‘মাথায় কম অক্সিজেন যাওয়া’ কেষ্টর মাথা থেকে হাত সরালেন? কে জানে কী হয়েছে। শুধু এই বার্তাটুকু জেলায় গিয়েছে, কেষ্ট এখন ক’জনের একজন। এখন এই তৃণমূলের নবরত্ন সভায় তিনি মান সিং হবেন নাকি বীরবল তা সময়ই বলবে। তবে চড়াম চড়াম ঢাক বাজানো নকুলদানা খাওয়ানো সেই বাহুবলীকে বোধহয় আর দেখা যাবে না।